'বিগ ফ্যাট ওয়েডিং'! সাধ্য না থাকলেও কেন সাধের মায়ার ফাঁদে পড়ছেন মধ্যবিত্তরা

Big Fat Wedding: ওয়েডিং ইন্ডাস্ট্রিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শীর্ষে আর এই দেশকে যদি কেউ টেক্কা দিতে পারে নিঃসন্দেহে ধরে নিতে হবে তা আর কেউ নয় আমাদেরই ভারতবর্ষ।

তোমাতে আমাতে দেখা হয়েছিল, জানিনা কবে কোথায়, মন দেওয়া নেওয়া, খেলা হয়েছিল, কী জানি কবে কোথায়?

এ যেন স্মৃতির পাতা উল্টে একপ্রকার প্রেমেরই উদযাপন। তবে এই যাপন তোমাতে আমাতে তো বটেই পাশাপাশি অর্থতেও। শীত পড়তেই শুরু হবে বিয়ের মরশুম। কিন্তু এ বিয়ে যেমন তেমন বিয়ে নয়, এ হলো ‘বিগ ফ্যাট ওয়েডিং সিজন’। আজকাল এই ইংরেজি শব্দকোলাজ হামেশাই শোনা যাচ্ছে, সৌজন্যে অবশ্যই বলিউড। এই নাদুসনুদুস বিয়ের আসল খরচ শুনলে বাঙালি পাঠকের চোখ রীতিমতো কপালে ওঠার জোগাড় হবেই। ভারতে এই সব বিয়েতে খরচ ছাড়ায় প্রায় ১০০ কোটি। কখনও বা ছুঁয়ে যায় ২০০ কোটি। আর বিদেশের মাটিতে বিয়ে হলে কোথাও কোথাও ৫০০ কোটিও ছাড়িয়েছে খরচ।

ভারতীয় বিবাহ অনুষ্ঠান সর্বদাই ঐতিহ্য, আচার, রীতি নীতির সংমিশ্রণ। তবে সময় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিবাহের সংজ্ঞাও কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে। শুধু সাতপাক, সিঁদুরদান নয় একাংশের মানুষের ঝোঁক এখন এই ‘বিগ ফ্যাট ওয়েডিং’-এর দিকেই। ফুলের সুগন্ধর থেকেও গান্ধী নোটের মন মাতানো সুবাসই এখানে ম-ম করে বেড়ায়। ওয়েডিং প্ল্যানার, ড্রেস ডিজাইনার থেকে ডেকোরেটর, ওয়েডিং ফটোগ্রাফার থেকে ক্যাটারার, ট্রাভেল এজেন্ট থেকে মেকআপ আর্টিস্ট পর্যন্ত সমস্ত বিষয়গুলি নিখুঁত ভাবে সম্পন্ন করার জন্য রয়েছে পেশাদার বিয়ের দল।

সমীক্ষায় দেখা গেছে, একজন ভারতীয় তাঁর জীবনের সঞ্চয়ের প্রায় এক পঞ্চমাংশই ব্যয় করে ফেলেন বিয়েতে। ওয়েডিং ইন্ডাস্ট্রিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শীর্ষে আর এই দেশকে যদি কেউ টেক্কা দিতে পারে নিঃসন্দেহে ধরে নিতে হবে তা আর কেউ নয় আমাদেরই ভারতবর্ষ।

প্রতিবছরই সবথেকে বেশি বিয়ের দিন নির্ধারিত হয় নভেম্বর থেকে মার্চ মাস অবধি। এই চার পাঁচ মাস জুড়ে জোর কদমে চলে ব্যাবসা। কোভিডের কারণে গত দু’বছর ব্যবসায় অনেক ক্ষতি হলেও বর্তমানের ছন্দে ফেরা যাপন যে সেই ক্ষতি নিরাময় করে দেবে তা সন্দেহ নেই।

আরও পড়ুন- ঘুঁটের আগুন থেকে এলইডি ল্যাম্প, জগদ্ধাত্রী পুজো পাল্টে দিল চন্দননগরের চালচিত্র

ওয়েডিং প্ল্যানিং সংস্থা ‘স্যাফরন স্ট্রিং’য়ের সহ প্রতিষ্ঠাতা নেহা অরোরা জানান, গত দু’বছর অনেকেই জাঁকজমক করে বিয়ে করতে পারেননি, তবে বিলাসবহুলভাবে বিয়ে উদযাপন আবার ফিরে আসছে। বর্তমানে দেখা যাচ্ছে বিয়ের তারিখ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে সপ্তাহের ছুটির দিন অর্থাৎ উইকেন্ডই বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মধ্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দিক থেকেও অনেক পরিবর্তন এসেছে।

মুম্বইয়ের ‘ক্রেওন্স এন্টারটেইনমেন্ট অ্যান্ড ওয়েডিং প্লানার্স’-এর প্রতিষ্ঠাতা জানান, ২০২৩ এর বিয়ের সমস্ত বুকিং এখন থেকে শুরু হয়ে গেছে। ২০১৯ সালে বিগ বাজেট ওয়েডিংয়ের তুলনায় প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি লাভের মুখ দেখেছে ওয়েডিং ইন্ডাস্ট্রি। যার প্রধান কারণ বলা যেতে পারে, মানুষের চাহিদা। যে পরিমাণে মানুষ ‘বিগ বাজেটে ওয়েডিং’ ঘটাতে চাইছেন সেই পরিমাণ হোটেলের সংখ্যা নেই বললেই চলে। এছাড়াও, নিমন্ত্রিতদের সংখ্যাটাও অনেক বেশি।

একটি গ্র্যান্ড ওয়েডিংয়ের খরচ কত?

ওয়েডিং প্ল্যানার নিখিল ভিডে একটি বিগ ওয়েডিংয়ের পিছনে খরচের বিষয়ে বলেছেন, “বিয়েতে সবথেকে বেশি এবং প্রধান খরচ হয় খাবারে। বাকি সব কিছুর দাম নির্ধারিত করা যেতে পারে, কিন্তু খাবারের ক্ষেত্রে তা হয় না কারণ অতিথিরা পরিবর্তনশীল। একটি ডেস্টিনেশন ওয়েডিংয়ের ক্ষেত্রে ৫০০ জন অতিথির খাবারের প্লেটে ট্যাক্স বাদ দিয়ে বরাদ্দ থাকে ২৫০০ টাকা, যা কখনও কখনও ৩০ লক্ষ টাকাও ছাড়িয়ে যেতে পারে।”

গোয়ায় ৩০০ জন অতিথিকে নিয়ে একটি ডেস্টিনেশন ওয়েডিং আয়োজন করা হয়েছিল, যেখানে খাবারের বিল ছিল ১৮ লক্ষ টাকা। এছাড়াও রয়েছে ফ্লাইট বুকিং থেকে শুরু করে অতিথিদের আপ্যায়নের আয়োজন। সব মিলিয়ে মোট খরচ প্রায় ৪০-৫০ লক্ষ টাকা।

‘সেন্টার ফর সোশ্যাল রিসার্চ’ সংস্থার পরিচালক ডঃ রঞ্জনা কুমারী আলজাজিরাকে একটি সাক্ষাৎকারে জানান, সামাজিক প্রত্যাশা পূরণের জন্য পরিবারগুলি যে অপ্রয়োজনীয় চাপ বহন করেন তা একেবারেই নিষ্প্রয়োজন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে অনুষ্ঠানের পর প্রায় ৪০ শতাংশ খাবার ফেলে দেওয়া হয়। তবে শুধুমাত্র সাধারণ মানুষকে দোষ দেওয়া যায় না।

আরও পড়ুন- ইউনিসেফের বিস্ফোরক রিপোর্ট! কয়েক বছরেই তাপপ্রবাহের বলি হবে শিশুরা

সিনেমাটিক! এই শব্দটি আজকের কলকাতা শহরের বিয়েকে সবচেয়ে ভালোভাবে বর্ণনা করতে পারে। এ যেন খানিক যশ চোপড়া, করণ জোহরের সিনেমার বিশাল ঐশ্বর্য থেকে শুরু করে অনুরাগ বসুর চলচ্চিত্রের সূক্ষ্ম নীতির মতোন। সামাজিক ঐতিহ্যের উপর ভিত্তি করে আমাদের ধারণা তৈরি হওয়ায় পাশাপাশি জীবন গঠনের ক্ষেত্রেও সিনেমার এক বিশাল ভূমিকা রয়েছে। ‘দ্য বিগ ডে’ বা ‘মেড ইন হেভেন’-এর মতো শো এবং ‘ব্যান্ড বাজা বারাত’, ‘শানদার’, বা ‘ইয়ে জওয়ানি হ্যায় দিওয়ানি’-র মতো সিনেমাগুলি যার নিখুঁত উদাহরণ। ভারতবর্ষের সবথেকে বেশি ডেস্টিনেশন ওয়েডিং পালন করা হয় গোয়া, কেরল, তামিলনাড়ু, দিল্লি, মুম্বই ও কলকাতায়।

২০১৮ সালে, ভারতের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি মুকেশ আম্বানির কন্যা ইশা আম্বানির বিয়েতে খরচ হয়েছিল ১০০ মিলিয়ন ডলার। হিলারি ক্লিনটন এবং বেয়ন্সের মতো অতিথিরাও বাদ পড়েননি।

২০১৬ সালে রাজনীতিবিদ গলি জনার্ধন রেড্ডির কন্যার বিয়েতে প্রায় ৭৪ মিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছিল শুধুমাত্র আমন্ত্রণ কার্ড তৈরিতে।

২০০৪ সালে, স্টিল ব্যবসায়ী লক্ষ্মী মিত্তলের মেয়ের বিয়েতেও খরচ হয়েছিল ৬০ মিলিয়ন ডলার। যেখানে বলিউড তারকা সহ প্রায় ১০০০ অতিথিকে ফ্রান্সে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

এই একই ভারতে গ্লোবাল হাঙ্গার ইন্ডেক্সে ১২১ টি দেশের মধ্যে ভারতের জায়গা ১০৭! আবার এই ভারতেই আম্বানি, আদানি থেকে শুরু করে রণবীর আলিয়া, বিরাট অনুষ্কার ২ দিনের বিয়ের খরচ আকাশ ছুঁয়ে ফেলে। আর স্বপ্নের তারকাদের যাপনকে অনুকরণ করতে গিয়ে সাধারণ মানুষের স্বপ্নেও হানা দেয় বিগ ফ্যাট ওয়েডিংয়ের ঘোর। এই ঘোর সংক্রামক, এই ঘোরই এক অংশের ভাঁড়ার উপচে দেয়, এই ঘোরই জীবনের শেষ সঞ্চয়টুকুও শেষ করায়।

More Articles