দেশের মুখ গুজরাত আর বিজেপিই! কেন ধামাচাপা পড়ে গেল আপ ও কংগ্রেসের জয়?

Gujarat BJP: গুজরাতের মতো একটি ‘উন্নত’ রাজ্যের বেশিরভাগ নির্বাচক যদি বিজেপিকেই বেছে নেন, তাহলে গণতান্ত্রিক আকাঙ্খার জন্য কেন আর অন্যদলকে ভোট দেওয়া?

আজকের সময়টা দৃশ্যের। কে কীরকম ভাবে নিজেকে উপস্থাপিত করছেন, কে কীরকম দৃশ্য তৈরি করছেন, তার উপর অনেক কিছু নির্ভর করে। দু’টি রাজ্যে নির্বাচনের ফলাফল এসেছে, একটিতে বিজেপি জয়ী হয়েছে, অন্যটিতে কংগ্রেস, এছাড়াও অবশ্য আরও একটি নির্বাচন হয়েছে, দিল্লি পুরসভার নির্বাচন, যেখানে জয়ী হয়েছে আম আদমি পার্টি। যদিও যে দুটো রাজ্যে বিধানসভা ভোট হয়েছে, সেই তুলনায় এই পৌরসভা নির্বাচনের গুরুত্ব অনেকটাই কম কিন্তু প্রচার যেভাবে হয়েছে, তা দেখে একবারও মনে হয়নি, এই নির্বাচনের ফলাফল এতটুকু কম গুরুত্বপূর্ণ, অন্তত এই শাসকদলের কাছে। যেদিন থেকে এই তিনটি নির্বাচনের ফল প্রকাশিত হয়েছে, সেদিন থেকেই শাসকদল এমনভাবে প্রচার করছে, দেখে মনে হচ্ছে যেন গুজরাতের নির্বাচনে জয়লাভের খবরটাই একমাত্র খবর, হিমাচল প্রদেশে হার বা দিল্লির পৌরসভা নির্বাচনের হার অত্যন্ত নগণ্য একটি বিষয়।

দেশের অন্যান্য রাজ্যের সাধারণ নাগরিকদের কী বার্তা দিতে হবে, তা শাসকদল জানে, আর জানে বলেই সেই অনুযায়ী প্রচার কীভাবে করতে হবে তাও অজানা নয়। নির্বাচনের ফলাফলের পরবর্তীতে যেভাবে শুধু গুজরাত নির্বাচনের জয়কে সামনে রেখে জাতীয় হিন্দিভাষী টেলিভিশন চ্যানেলগুলিতে আলোচনা চলেছে এবং শোরগোল ফেলার চেষ্টা হয়েছে, তা দেখেশুনে দেশের যেকোনও প্রান্তের যেকোনও সাধারণ নির্বাচকের কি কখনও মনে হবে, যে হিমাচল প্রদেশের নির্বাচনে এই শাসকদলই পরাজিত হয়েছে? এই মুহূর্তে ভারতের রাজনৈতিক মানচিত্র যদি দেখা যায়, বড় রাজ্যগুলোর মধ্যে- গুজরাত, উত্তরপ্রদেশ, অসম এবং মধ্যপ্রদেশ ছাড়া অন্য কোনও রাজ্যে কিন্তু বিজেপি এককভাবে ক্ষমতায় নেই। কর্ণাটকে এবং মহারাষ্ট্রেও যে তারা ক্ষমতায় আছে, তাও জোটসঙ্গীর বদান্যতায়। মধ্যপ্রদেশে কীভাবে ক্ষমতা দখল করা হয়েছিল কোভিডের মধ্যে এবং পরবর্তীতে মহারাষ্ট্রে যেভাবে শিবসেনা জোটকে সরিয়ে বিজেপি রাজ্যগুলোর রাজনৈতিক দখল নিয়েছিল, তা নিয়ে কিন্তু শাসকদলের বিশ্বস্ত এই চ্যানেলগুলোতে কোনও আলোচনাই হয় না, অথচ সমস্ত গণমাধ্যমে একটাই প্রচার, বিজেপির জয়রথ যেন থামতেই চাইছে না। নরেন্দ্র মোদির মতো অবিসংবাদিত আর একজনও নেতা নাকি ভারতবর্ষে নেই, মানুষকে আকর্ষণ করার ক্ষমতা তাঁর নাকি অপরিসীম, তিনি নাকি অসম্ভব বাগ্মী এবং তাঁর বাগ্মীতার জোরেই নাকি মানুষকে কাছে টানতে পারেন তিনি। 

আরও পড়ুন- আপই কি নয়া ‘কংগ্রেস’? গুজরাত নির্বাচন যে প্রশ্ন তুলে ধরছে বারবার

এমনকী দিল্লির পৌরসভা নির্বাচনে পরাজিত হয়েও বিজেপির নেতারা বুক ফুলিয়ে বলছেন, যদিও অধিকাংশ পুর প্রতিনিধি আম আদমি দলের, তাও দিল্লি পুরসভার মেয়র তাঁদের দলের থেকেই হবেন। এই বলার মধ্যে দিয়ে একটা কথা তাঁরা বুঝিয়ে দিচ্ছেন, যেনতেন প্রকারে ক্ষমতা দখল করাটাই তাঁদের উদ্দেশ্য। ঠিক যেভাবে তাঁরা মহারাষ্ট্র এবং মধ্যপ্রদেশে ক্ষমতায় এসেছেন, হিমাচল প্রদেশেও তাঁরা বিধায়ক কিনে সরকার গড়বেন কিছুদিনের মধ্যেই। এই সমস্ত কিছুর পিছনে একটা বিকল্প দৃশ্যকল্প তৈরির চেষ্টা চলে যাতে দেশের অন্য প্রান্তের নির্বাচকেরা বোঝেন বিজেপিকে ভোট না দেওয়াটাই বোকামি, অন্য রাজ্যের নির্বাচকেরা যাতে মনে করেন, গুজরাতের মতো একটি ‘উন্নত’ রাজ্যের বেশিরভাগ নির্বাচক যদি বিজেপিকেই বেছে নেন, তাহলে গণতান্ত্রিক আকাঙ্খার জন্য কেন আর অন্যদলকে ভোট দেওয়া?

অথচ তার পাশাপাশি যখন দেখা যাচ্ছে বিরোধী কংগ্রেস দলের অন্যতম নেতা রাহুল গান্ধীর ভারত জোড়ো যাত্রাতে দলে দলে মানুষ যোগ দিচ্ছেন এবং হাঁটছেন, সেই বিষয়ে কিন্তু কোনও আলোচনা বা খবর শোনা যাচ্ছে না। অন্যদিকে নির্বাচন পরবর্তী আলোচনা শুনলে মনে হবে, সমস্ত কিছুই ন্যায়সঙ্গত। অবশ্য মনে না হওয়ারই বা কী কারণ, যখন এই মুহূর্তে প্রায় সব স্বশাসিত সংস্থাগুলো বর্তমান শাসকদলের কব্জায়, তখন এই কথাগুলোই যুক্তিসঙ্গত মনে হতে বাধ্য।

আরও পড়ুন- হাই ভোল্টেজ প্রচারও ব্যর্থ! মোদির ম্যাজিকে কেন আস্থা নেই হিমাচল প্রদেশের?

নির্বাচনের দিন, নিজের ভোট দিয়ে প্রধানমন্ত্রী রীতিমতো মিছিল করলেন, বিরোধীরা অভিযোগ করলেন, এটা তো একধরনের প্রচার চলছে, নির্বাচন কমিশন বলল, না এইটা কোনওভাবেই প্রচার করার মিছিল বা রোড শো নয়, এটি একটি সাধারণ বিষয়। প্রধানমন্ত্রীকে দেখে মানুষ হাত নাড়িয়েছিলেন বলে, তিনিও উল্টে হাত নেড়েছেন। গুজরাত নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রচার চলাকালীন একটি মন্তব্য করেন এবং বলেন যে, “ওঁদের উচিত শিক্ষা দেওয়া হয়েছে ২০০২ সালে”। সারা পৃথিবীর মানুষ বুঝতে পারল, তিনি ২০০২ সালের গুজরাত গণহত্যার স্মৃতি উস্কে দিয়ে, নির্বাচনে হিন্দু-মুসলমান বিভাজন করে জিততে চাইলেন, অথচ সব কিছু শেষ হয়ে যাওয়ার পরে, ফলাফল বেরনোর পরে, নির্বাচন কমিশন জানাল যে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে কোনওভাবেই নির্বাচনের ‘আদর্শ আচরণবিধি’ লঙ্ঘিত হয়নি। তাহলে কি এই যে দুটো রাজ্যে নির্বাচন হয়ে গেল, কিংবা সামনে যে আরও কিছু রাজ্যে নির্বাচন হতে চলেছে, তা দিয়েই ২০২৪ সালের কেন্দ্রীয় নির্বাচন নির্ধারিত হবে? 

এই জটিল প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে ফিরতে হবে ২০১৪ এবং ২০১৯ সালের নির্বাচনের দিকে। অনেক নির্বাচকই হয়তো গত দু’বার বিজেপিকে ভোট দিয়েছিলেন এই ভেবে যে ‘গুজরাত মডেলে’র মতো সারা দেশে উন্নয়ন হবে, বিকাশ হবে। তাঁদের মধ্যে অনেকেই হয়তো ভাবেননি, তাঁদের ভোটের ফলে ক্ষমতায় এসে, বিজেপি গণতান্ত্রিক কাঠামোগুলোকে ধ্বংস করবে, অনেকেই হয়তো ভাবেননি এই ভাবে সারা দেশে ঘৃণা বিদ্বেষের আবহাওয়া বৃদ্ধি পাবে, এই ভাবে সংখ্যালঘু মানুষকে পিটিয়ে মারা হবে, এইভাবে সংবাদমাধ্যমের কন্ঠরোধ করা হবে। আসলে সবটাই কিন্তু তাঁদের ভোটের ফলেই সৃষ্ট দেশের এই মুহূর্তের পরিস্থিতি। আগামী নির্বাচনেও কি তাই হবে? হয়তো কিছুটা তাই হবে, গুজরাত থাকবে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। সংখ্যালঘু বিরোধী স্বর আরও উচ্চগ্রামে উঠবে সারা দেশজুড়ে। দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেই যেখানে সংখ্যালঘু বিরোধী সুর বেঁধে দিয়েছেন, সেখানে সারা দেশে সেই সুরেই গান হবে, সেটাই কি স্বাভাবিক নয়? বেশিরভাগ স্বশাসিত সংস্থা বাধ্য হবে জাতীয়তাবাদ এবং হিন্দুত্বের চাপে কাজ করতে। অন্যান্য রাজনৈতিক দলের উপরও চাপ তৈরি হবে, তাঁরাও আর সংখ্যালঘুদের উপর হওয়া অত্যাচার নিয়ে সরব হওয়ার আগে দু’বার ভাববে, যদি তাঁদের সংখ্যাগুরু ভোট কমে যায়। তখনই প্রয়োজন পড়বে নাগরিক সমাজের মানুষদের, তাঁদের দায়িত্ব আরও বাড়বে। গণতান্ত্রিক চেতনাকে শান দিয়ে রাখতে হবে হাতে হাত ধরে।

 

More Articles