খোদ মানুষের চামড়া দিয়ে বাঁধানো মলাট! আজও রহস্য বয়ে বেড়াচ্ছে ৫০০ বছরের পুরনো পাণ্ডুলিপি
Ancient Book : ন্যাশনাল অ্যাকাডেমিক লাইব্রেরির ‘রেয়ার পাবলিকেশন মিউজিয়াম’-এ প্রায় ৮ বছর ধরে বন্দি থাকার পর অবশেষে প্রকাশ্যে এসেছে এমন একটি বই যার বাইরের মলাটের দিকে তাকালেই রীতিমতো গায়ে কাঁটা দেয়।
আগের মতো নেই অনেক কিছুই, হয়তো বদলটাই দস্তুর। আমরা আধুনিক হয়েছি ঠিকই, তবে হারিয়ে গিয়েছে অনেক কিছুই। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বই নামক বস্তুটাই যেন বিষম হয়ে ঠেকেছে। ম্যাক বুক, ই বুক কিংবা হালফিলের পি ডি এফের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ক্রমশ পিছিয়ে পড়েছে মলস্ট দিয়ে বাঁধানো বই। অথচ ফি বছর বইমেলা হয়, উপচে পড়া ভিড় দেখে ভ্রম হয় বুঝি অনলাইন জগৎটা ঘোর মিছে। আর এই বইয়ের দুনিয়াটাই সত্যি। বইয়ের মধ্যে যে গন্ধটা আছে, সেই গন্ধটা নেই কোত্থাও আজকের ই-বুকের মধ্যে। তাই হঠাৎ করে যদি বহু বছরের প্রাচীন কোনও পুঁথি অথবা পাণ্ডুলিপি প্রকাশ্যে আসে তবে তাকে ঘিরে শুরু হয়ে যায় পর্যালোচনা।
প্রযুক্তির সঙ্গে বহু প্রাচীন পুঁথিতে ধুলো জমেছে ঠিকই তবে বইপোকারা আজও সুযোগ পেলেই সেই সমস্ত ধুলো ঝেড়ে অমূল্য রতন খুঁজতে শুরু করেন। কাজাখস্তানের রাজধানী আস্তানায় সম্প্রতি শুরু হয়েছে এমনই এক আশ্চর্য গ্রন্থের প্রদর্শনী। সে-দেশের ন্যাশনাল অ্যাকাডেমিক লাইব্রেরির ‘রেয়ার পাবলিকেশন মিউজিয়াম’-এ প্রায় ৮ বছর ধরে বন্দি থাকার পর অবশেষে প্রকাশ্যে এসেছে এমন একটি বই যার বাইরের মলাটের দিকে তাকালেই রীতিমতো গায়ে কাঁটা দেয়। প্রাচীন এই বইটির মলাট নাকি খোদ মানুষের চামড়ায় বাঁধানো।
বইয়ের মলাট নিয়ে অবশ্য আজকাল নানা রকমের নতুনত্ব বাজারে এসেছে। হ্যাণ্ডমেড পেপারের পাশাপাশি প্রিন্টেড মলাট, ভিন্ন ভিন্ন রকমে সাজিয়ে তোলা হয় বইকে। তাই বলে মলাট কিনা বাঁধানো এক্কেবারে মানুষের চামড়া দিয়ে! এই ঘটনা সত্যিই বিস্ময়ের।
আরও পড়ুন - মুহূর্তে ভেঙে পড়ে একের পর এক বিমান, কেন মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হল বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল?
গবেষণা থেকে জানা গেছে, প্রাচীন এই গ্রন্থটির বয়স প্রায় ৫০০ বছর। আনুমানিক ১৫৩২ সালে ইতালির পেত্রাস পুয়ার্দেস নামের এক নোটারি এই পাণ্ডুলিপিটি রচনা করেছিলেন। তবে ইতালীয় ভাষায় নয়, বরং ল্যাটিন হরফে ভিন্ন এক সাংকেতিক ভাষায় লেখা হয়েছিল এই গ্রন্থ। ফলে, এত বছর পরেও সম্পূর্ণভাবে পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়নি এই গ্রন্থের। মোট ৩৩০ পৃষ্ঠার এই পাণ্ডুলিপির মধ্যে মাত্র ১০টি পাতার বিষয়বস্তুকেই এখনও পর্যন্ত ডিকোড করতে সক্ষম হয়েছেন গবেষকরা। সংশ্লিষ্ট অংশের বিষয়বস্তু থেকে ধারণা করা হয়েছে, ঋণ প্রদান, বন্ধক, আর্থিক লেনদেনের মতো অর্থনৈতিক বিষয়েই লেখা হয়েছিল এই গ্রন্থ। যদিও কেন এমন সাংকেতিক ভাষায় লেখা হয়েছিল, কেনোই বা সাধারণের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখার জন্য এমন দুর্বোধ্য লিপির ব্যবহার করা হয়েছিল সেই বিষয়ে কোনও সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেননি কেউই।
বইয়ের মলাটে মানুষের চামড়া, অদ্ভুত এই রহস্যময় রীতিটা শুরু হয়েছিল মূলত সপ্তদশ থেকে অষ্টাদশ শতকের মধ্যে। একদিকে সমাজে গেঁড়ে বসা কুসংস্কার, অন্যদিকে চাপ চাপ ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্যই বইকে অস্ত্র করেছিল সে যুগের মানুষ। বউয়ের মলাতে মানুষের চামড়া ব্যবহারের চল শুরু হয় ফ্রান্স এবং ইতালিতে। শোনা যায়, ফরাসি বিপ্লবের সময় বাস্তিল দুর্গের নিকটেই তৈরি হয়েছিল মানুষের চামড়া প্রক্রিয়াকরণের জন্য বিশেষ ট্যানারি। এমনকী ব্রিটেনেও মানুষের চামড়ায় বাঁধানো বইয়ের হদিশ মিলেছে বলেই জানা যায়।
উনিশ শতকের সমাজে গোঁড়ামির বিরুদ্ধে সত্তিকারের অস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছিল মানুষের চামড়ায় বাঁধানো বইগুলি। আজ অব্দি গোটা বিশ্বে মোট প্রায় পঞ্চাশটির মতো মানুষের চামড়ায় বাঁধানো মলাটের বইয়ের হদিশ মিলেছে। যেগুলির বেশিরভাগেরই বয়স ৩০০ থেকে ৫০০ বছরেরও বেশি। তবে কিভাবে সমাজ থেকে একে একে হারিয়ে যেতে শুরু করল এই মানুষের চামড়ায় বাঁধানো মলাটের বইগুলি সেই প্রশ্নের উত্তর আজও অধরা। হদিশ মেলেনি উত্তরের তবে সম্প্রতি প্রকাশ্যে আসা কাজাখস্তানের জাতীয় গ্রন্থাগারের পাণ্ডুলিপি যে ভবিষ্যতের নতুন পথ খুলে দিতে পারবে তা বলাই বাহুল্য।