মুহূর্তে ভেঙে পড়ে একের পর এক বিমান, কেন মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হল বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল?

Barmuda Triangle Mystry : ঠিক যেন ফেলুদার গল্প, বারমুডা রহস্যতেও রয়েছে এক মেঘরাজের ভিলেনগিরি!

টানটান উত্তেজনা, রহস্যময় প্লট তার সঙ্গে মেঘরাজের ভিলেনগিরি! তবে এটা কোনও ফেলুদার গল্প মোটেই নয়, এমনকী এই মেঘরাজের সঙ্গে মগনলালের বিশেষ কোনও সম্পর্কও নেই কিন্তু তবুও রহস্য আছে। না পাওয়া উত্তরের ভিড় আছে, আর তার সঙ্গে আছে দীর্ঘ একটা ইতিহাসও। কথা হচ্ছে, ওড়িশার রহস্যে ঘেরা বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল নিয়ে। জায়গার নামেই রয়েছে ত্রিভুজের অস্তিত্ব, আকৃতির কথা মাথায় রেখেই এমন নাম বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের। বিশ্বের এই আশ্চর্য্য প্রাকৃতিক ত্রিভুজটিই যেন আস্ত একটা রহস্যের খনি। যার কিনারা করতে বছরের পর বছর সময় লেগে যায় বিজ্ঞানীদের। এখনও যে সবটুকু উত্তর মিলেছে, সে কথাও জোর দিয়ে বলা যায় না।

বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল মানেই একটা অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ। কন্সপিরেসি থিয়োরি অর্থাৎ যাঁরা উদ্ভট সব তত্ত্বে বিশ্বাসী, তাঁদের কাছে এই ট্রায়াঙ্গলের স্থানমহিমা বলে বোঝানোর নয়। আটলান্টিক মহাসাগরে তিনটি বিন্দু দ্বারা সীমাবদ্ধ ত্রিভুজাকৃতি একটি বিশেষ অঞ্চলকে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল বলে। এই অঞ্চলে এখনও পর্যন্ত যে ঠিক কত রহস্যময় দুর্ঘটনা ঘটেছে তার ইয়াত্তা নেই। সঙ্গত কারণেই তাই পৃথিবীর রহস্যময় অঞ্চলের তকমা জুটেছে এই অঞ্চলটির। স্থানীয় অধিবাসীরা এই অঞ্চলটিকে ড্রেভিলস ট্রায়াঙ্গেল বা শয়তানের ত্রিভুজ বলে থাকেন। আদতে ক্যারিবিয়ন সাগরে অবস্থিত এই ত্রিভুজ এলাকাই হল বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল।

আরও পড়ুন - হাজার বছর ধরে জলের গভীরে লুকিয়ে আছে দানব? যে রহস্যের কিনারা হয়নি আজও…

কিন্তু কেন এমন নাম? আর এই শয়তান আসলে কে? এর উত্তর খুঁজতে হলে ফিরে যেতে হবে বেশ কিছু বছর আগে। সময়টা ১৯৪৪ সাল। পৃথিবী জুড়ে তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গনগনে আঁচ। সেই আঁচের হাত থেকে রেহাই মেলেনি ভারতেরও। গোটা দুনিয়া ফুটছে যুদ্ধ নামক আগুনে। ঠিক এরকম সময় শুরু রহস্যের। ৪ মে, আমারদা রোড বিমানঘাঁটির কাছে মার্কিন লিবারেটর যুদ্ধবিমানের সঙ্গে হার্ভার্ড দ্য হাভিল্যান্ড বিমানের মুখোমুখি এক মারাত্মক সংঘর্ষ হল। শুধু তাই নয়, এই দুর্ঘটনায় দুই বিমানের ৪ জন সদস্যেরই মৃত্যু হয়। যদিও ঠিক কী কারণে সংঘর্ষ, এর উত্তর মেলে না। কিন্তু সেই উত্তর খুঁজে পাওয়ার আগেই পরপর নেমে আসে আরও বেশ কিছু দুর্যোগ।ঠিক তিন দিনের মাথায় ৭ মে ফের দুর্ঘটনা। খবর পাওয়া গেল, আরেকটি লিবারেটর যুদ্ধবিমান টেক অফ করার মাত্র ২০ মিনিটের মধ্যেই কোনও এক রহস্যময় কারণে চুরমার হয়ে ভেঙে পড়ে। মারা যান বিমানে থাকা ১০ জন! আবারও সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই ১৩ মে আমারদা রোড থেকে টেক অফ করার পরই ফের ভেঙে পড়ে আরেকটি হাভিল্যান্ড বিমান।

রহস্য ক্রমশ ঘনীভূত হচ্ছে ঠিকই তবে উত্তর মিলছে না কিছুতেই। অথচ ঘটে যাচ্ছে একটার পির একটা ভয়াবহ দুর্ঘটনা। যার সবথেকে মারাত্মক ফলশ্রুতি হল ১৯৪৫ সালের ২৬ জুলাই। এটিই এই অঞ্চলে ঘটা সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা। সেদিন দু’টি চার ইঞ্জিনের বোমারু বিমান এবং ব্রিটিশ রয়্যাল যুদ্ধবিমান বি-২৪ লিবারেটরের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। নেহাতই প্রশিক্ষণে ব্যস্ত থাকার সময়ই ওই দুর্ঘটনা ঘটে যায়। মারা যান ১৪ জন। বিমানের ধ্বংসাবশেষ এসে পড়ে এই বাংলায়।

সেই থেকেই একের পর এক দুর্ঘটনার সাক্ষ্য দিচ্ছে রহস্যময় এই মৃত্যু উপত্যকা। সময়ের সঙ্গে কেবল ঘনীভূত হয়েছে আতঙ্ক। গবেষণাও চলেছে নিরন্তর। ওড়িশার আমারদা রোড বিমানঘাঁটি, ঝাড়খণ্ডের চাকুলিয়া ও বাঁকুড়ার কাছে পিয়ারডোবা, এই তিনটি বিন্দুকে যোগ করলে যে ত্রিভুজাকৃতি এলাকা তৈরি হয় সেখানে বারবার ভেঙে পড়েছে বিমানের ধ্বংসাবশেষ। একটা দুটো নয়, মত ১৬ টি ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনা ঘটেছে এ যাবৎ। সেস্টি ঘটেছে ২০১৮ সালে। যার জের আজও বইছে গোটা বিশ্ব। কিন্তু কেন বারবার এই পরিস্থিতির শিকার হতে হয়েছে বিমানগুলোকে?

আরও পড়ুন - আবিষ্কার করেছিলেন বাঙালি প্রত্নতাত্ত্বিক, শতবর্ষ পেরিয়েও যে রহস্য বয়ে বেড়াচ্ছে ‘মৃতের শহর’

১৯৪০ সালে ৩ কোটি টাকা খরচ করে তৈরি হওয়া বিমানবন্দরটি আজ প্রায় পরিত্যক্ত। কীভাবে মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হল এই জায়গাটি তা নিয়ে অবশ্য বিভিন্ন সময়ে নানান থিয়োরি সামনে এনেছেন বিজ্ঞানীরা। এই বিমানঘাঁটির কাছেই রয়েছে ঝাড়খণ্ডের জাদুগোরা ইউরেনিয়াম খনি। ফলে নির্গত তেজস্ক্রিয় ইউরেনিয়ামের প্রভাবেও যন্ত্র বিকল হয়ে যেতে পারে, বলে দাবি করেছেন অনেক বিজ্ঞানীরাই। যে কারণে বিমানের র‌্যাডার বিকল হয়ে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটা বিচিত্র কিছুই নয়। যদিও এটি কেবল একটা থিয়োরি হিসেবেই থেকে গিয়েছে দীর্ঘ প্রায় আশি বছর ধরে। আজও সঠিক কোনও প্রমাণ মেলে না। এ যেন ‘টপ সিক্রেট’! খোঁজ মেলেনি ধ্বংস হয়ে যাওয়া বিমান গুলির। মনে করা হয়, অদৃশ্য হয়ে যায়নি মোটেই, আজও লীন হয়ে রয়েছে বঙ্গোপসাগরের গভীর কোনও তলদেশে।

আবার অনেকের গবেষকদের মতে, এখানে নাকি চুম্বকীয় তত্ত্ব কাজ করে। যার ফল স্বরূপ এই অঞ্চলে আকাশ ও সমুদ্রের মধ্যে তড়িতাহত ক্রিয়া বিক্রিয়া ঘটে। যেটিকে দুর্ঘটনার মূল কারণ হিসেবে সূচিত করে হয়েছে বেশ কিছু গবেষণায়। পাশাপাশি, উড়িয়ে দেওয়া যায়নি ট্রায়াঙ্গাল অঞ্চলে সমুদ্র ভূপিষ্টে থাকা এক অনন্ত ফাটলের রহস্যকেও। এটিও কারণ হতে পারে বলে অনেকেরই বিশ্বাস। তবে সম্প্রতি এই সব তত্বকে উড়িয়ে বিজ্ঞানীরা এক নতুন তত্ত্ব দিয়েছেন। এবং জোর দিয়েই দাবি করছেন অবশেষে বারমুডা ট্রায়াঙ্গালের রহস্যে সমাধান হয়েছে। এই নয়া গবেষণায় উঠে এসেছে মেঘরাজের কথা। প্রথমেই উল্লেখ করা হয়েছে যেটি। বারমুডা রহস্যের ভিলেন সাব্যস্ত করা গিয়েছে ষড়ভূজাকৃতি মেঘকে। আটলান্টিক মহাসাগরের বারমুডা দ্বীপের কাছে প্রায় পঞ্চাশ মাইল এলাকা জুড়ে রয়েছে এই মেঘ। যার গতি ঘণ্টায় একশ সত্তর মাইল। মনে করা হয়েছে, এই মেঘের ঝড়েই নাকি যাবতীয় দুর্ঘটনার আসল কারণ। যদিও এতো বছর ধরে জমাট বাঁধা রহস্যের সহজ সমাধান নিয়ে কতটা বিশ্বাস মানুষের মধ্যে পাকাপোক্ত হয়েছে, তা সময়ই বলতে পারবে।

More Articles