ব্রিটেনের ইতিহাসে প্রথমবার! মাত্র দু'মাসের মধ্যে কেন তিনবার বদল হল প্রধানমন্ত্রীর
Rishi Sunak: এরপর বরিসকে ঘিরে ফের বিতর্ক ওঠে 'ওয়ালপেপারগেট কন্ট্রোভার্সি' নিয়ে। বরিস তাঁর প্রধানমন্ত্রী আবাসস্থানে কারুকার্য করলে, সেই বিলের মধ্যে বড় অঙ্কের হিসেবের গরমিল পাওয়া যায়।
২৪ অক্টোবর ২০২২, দীপাবলির দিন, একদিকে যেখানে ভারতে ধুমধাম করে দীপাবলি পালন করা হচ্ছিল, অন্যদিকে ব্রিটেনের মাটিতেও বলা চলে ভারতেরই বিজয়পতাকা উত্তোলিত হচ্ছিল। ব্রিটিশ কনজারভেটিভ পার্টির ভারতীয় বংশোদ্ভূত নেতা ঋষি সুনাককে, ব্রিটেনের নতুন প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করা হয়। আসলে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত বা চয়ন করা হয়নি, ঘোষণা করা হয়েছে। অর্থাৎ তিনি কোনও নির্বাচনে বিজয়ী হননি, তাঁর দলই তাঁকে বেছে নিয়েছে নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসাবে। এর আগে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন লিজ ট্রাস, যিনি কেবল ৪৪ দিনের জন্যই প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এবং তারও আগে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বরিস জনসন। বলাইবাহুল্য, মাত্র দু'মাসের মধ্যে তিনজন প্রধানমন্ত্রী পরিবর্তন হয়ে গেছে ব্রিটেনে, যা সাড়া ফেলে দিয়েছে সমগ্র বিশ্বে। হঠাৎ কেনই বা এত কম সময়ের মধ্যে বদল হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর পদ? সেই কারণেই কি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে ব্রিটেন ? প্রশ্ন তুলেছে গোটা বিশ্ব।
ফিরে যাওয়া যাক, ২০১৯ সালে। একদিকে ভারতে লোকসভা নির্বাচনের অয়োজন হচ্ছিল, অন্যদিকে ব্রিটেনেও জেনারেল ইলেকশন হয়। এই নির্বাচনটি বিশেষত দু'টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে লড়াই হয়েছিল- কনজারভেটিভ পার্টি ও লেবার পার্টি। কনজারটিভ পার্টিকে টোরি নামেও ডাকা হয়, যার নেতা ছিলেন বরিস জনসন এবং লেবার পার্টির নেতা ছিলেন জেরেমি কর্বিন। এই নির্বাচনে কনজারভেটিভ পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে জয়ী হয়। মোট ৬৫০ টি আসন আছে 'হাউজ অব কমন'-এ, যেমন লোকসভায় এই আসনের সংখ্যা ৫৪৩। অর্থাৎ 'হাউজ অব কমন'-এ সংখ্যাগরিষ্ঠর সীমা ৩২৬ টি আসন। সেই নির্বাচনে কনজারভেটিভ পার্টি ৩৬৫ ভোটে জেতে এবং লেবার পার্টি থেকে যায় মাত্র ২০২টি আসনে। সুতরাং বরিস জনসন হন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী। তবে কী এমন হলো যাতে মাত্র তিন বছরের মধ্যেই বরিস জনসনকে পদত্যাগ করতে হল?
সহজ ভাষায় বলতে গেলে, বরিস জনসন নিজের 'ক্রেডিবিলিটি' হারিয়ে ফেলেছিলেন সাধারণ মানুষের কাছে এবং নিজের দলের কাছেও। টোরি বা ব্রিটেনের আম নাগরিক কেউই তাঁকে আর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চাইছিল না। গত বছর নভেম্বরে তাঁর দলের একজন মুখ্য সদস্য ওয়েন পিটার্সনকে নিয়ম ভাঙার অপরাধে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। বরিস সেই বহিষ্কার রোধ করার অনেক চেষ্টা করেন। এমন করতেই তিনি সকলের প্রশ্নের মুখে পড়ে যান। সাধারণ মানুষের কাছেও এই বিষয়েটি অজানা ছিল যে হঠাৎ কেন একজন দুর্নীতিগ্রস্ত সদস্যর জন্য তিনি এতো রুখে দাঁড়িয়েছেন। এই প্রথম তাঁকে কেন্দ্র করে জনতার মধ্যে বিতর্ক ও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়।
আরও পড়ুন- গীতা ছুঁয়ে শপথ, ঋষি সুনককে কেন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মানল ব্রিটেন
এরপরে ৩০ নভেম্বরে 'পার্টিগেট স্ক্যান্ডেল' নামক একটি রিপোর্ট পেশ করা হয়। এই রিপোর্টে বলা হয় প্রধানমন্ত্রীর অফিসের কর্মীরা লকডাউন চলাকালীন মানুষের জমায়েত ঘটিয়ে পার্টি করেছেন। অর্থাৎ একদিকে যখন সাধারণ মানুষ নিজের অতি প্রয়োজনেও ঘরের বাইরে যেতে পারছেন না, তখন প্রধানমন্ত্রীর অফিসের কর্মীরা আমোদ উল্লাসে ব্যস্ত। একেই পার্টিগেট বলা হয়। ৭ ডিসেম্বর, মিডিয়াতে একটি ভিডিও ক্লিপ সামনে আসে যেখানে প্রধানমন্ত্রীর অফিসের প্রেস সেক্রেটারি আলেগ্রা স্ট্রাটন অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করছেন কনজারভেটিভ পার্টির অন্যান্য সদস্যদের। ভিডিওটি ভাইরাল হয়ে গেলে পরিস্থিতির চাপে পড়ে বরিস জনসনকে পদত্যাগ করতে হয়।
এরপর বরিসকে ঘিরে ফের বিতর্ক ওঠে 'ওয়ালপেপারগেট কন্ট্রোভার্সি' নিয়ে। বরিস তাঁর প্রধানমন্ত্রী আবাসস্থানে কারুকার্য করলে, সেই বিলের মধ্যে বড় অঙ্কের হিসেবের গরমিল পাওয়া যায়। তাই ব্রিটেনের ইলেকশন কমিশন কনজারভেটিভ পার্টির উপর ১৭৮০০ পাউন্ডের জরিমানা ধার্য করে। একের পর এক বিতর্কের শিকার হওয়ার পর, বরিসকে শেষমেশ মিডিয়ার মুখোমুখি হতেই হয়। একের পর এক এত বিতর্কের মধ্যে বিরোধী দল বরিসের পদত্যাগের আর্জি জানায়। এমনকি টোরির মধ্যেও ভাঙনের পরিস্থিতি তৈরি হয়। এর থেকেই বোঝা যায়, ব্রিটেনের ইলেক্টোরাল কমিশন এবং মিডিয়া যথেষ্ট স্বতন্ত্র এবং স্বাধীন। ১২ এপ্রিল, ২০২২ মেট্রোপোলিটন পুলিশ বরিস জনসন ও ঋষি সুনকের বিরুদ্ধে জরিমানা ধার্য করে 'পার্টিগেট স্ক্যান্ডেল'-কে কেন্দ্র করে। ঋষি সুনক সেই সময় দেশের অর্থমন্ত্রী ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী বরিস এতটাই দুর্নীতিগ্রস্থ হয়ে পড়েছিলেন যে সাধারণ মানুষ তো দূর অস্ত, তাঁর নিজের দলের কর্মীরাই তাঁকে সমর্থন করতে পারেনি। নিজের দলের সদস্যরাই তাঁর বিরোধিতা শুরু করলেন। প্রথমে ঋষি সুনক অর্থমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিলেন, তারপর ইস্তফা দিলেন সাজিদ জাভেদ। এই ভাবেই একে একে ৬০জন মন্ত্রী পদত্যাগ করলে, শেষে বাধ্য হয়ে ৭ জুলাই ২০২২ সালে বরিস প্রধানমন্ত্রীর আসন থেকে পদত্যাগ করেন।
আরও পড়ুন- সোশ্যাল মিডিয়ায় লাইক-কমেন্ট না পেলেই বিষণ্ণ! চরম আসক্তির দায় আসলে কার?
পরবর্তীতে রানী এলিজাবেথের মৃত্যু হলে, দেশ জুড়ে এক চরম বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। কিন্তু এবার প্রশ্ন, প্রধানমন্ত্রীর পদ কে সামলাবে? জুলাই মাসে বরিসের পদত্যাগের পর যে দু'টি নাম উঠে এসেছিল তার মধ্যে একজন হলেন লিজ ট্রাস এবং অন্যজন ঋষি সুনক। পার্টি এই দু'জনের মধ্যে নির্বাচন করে এবং নির্বাচনের ফলস্বরূপ লিজ ট্রাস ৫৭ শতাংশ ভোটে বিজয়ী হন। সুতরাং ব্রিটেনের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হলেন লিজ ট্রাস। এত সমস্যার মধ্যে লিজ ট্রাসের উপর দায়িত্ব কয়েকগুণ বেড়ে যায়। তিনি একটি নতুন প্রকল্প সামনে আনেন ২৩ সেপ্টেম্বর এবং সমস্ত অর্থনৈতিক সমস্যা দূর করার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু তাঁর নতুন প্রকল্প বিশেষ সুবিধা করতে পারল না। উল্টে, হিতে বিপরীত হলো, তাতে বাজারে ব্রিটিশ পাউন্ডের মূল্য আরও নেমে গেল। লিজ ট্রাসের স্থানও তাঁর দলে বেশ শোচনীয় হয়ে পড়ে এবং দেশের ৯০ শতাংশ জনতাই তাঁর বিরোধিতা শুরু করে। এইবারের অবস্থা বরিসের সময়ের থেকেও খারাপ হয়ে ওঠে। তাই পরিস্থিতির চাপে পড়ে অবশেষে লিজ ট্রাসকেও পদত্যাগ করতে হয়।
পরপর এমন কেলেঙ্কারির পর কনজারভেটিভ পার্টি নড়েচড়ে বসে। এবং তারা আশঙ্কা করে, ফের নির্বাচন হলে এত কিছুর পর তাঁদের বিরোধী দল জিতে যাবে এতে কোনও সন্দেহ নেই। সেই আশঙ্কা দূর করতে বিরোধী পার্টি ফের প্রধানমন্ত্রীর ভোটের ব্যবস্থা করে। ২৩ অক্টোবর সেই নির্বাচনের মাধ্যমে ঋষি সুনক ১০০ সাংসদের ভোটে বিজয়ী হন এবং ২৪ অক্টোবর তাঁকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করা হয়।