"যে পেনাল্টিটা আটকালাম, ইতিহাসে খোদাই করা থাকবে", চিঠিতে লিখেছিলেন কোচ চে গেভারা
Che Guevara and Football: গেভারা তার দোস্তকে ডাকত ‘পেদেরনেরিতা’ বলে, এর চেয়ে আদরের ডাক আর কীই বা হতে পারে!
আতিলিয়োর সেই গোল
সেটা ১৯৩৯ সাল। মন্তেভেদিয়োর নাসিওনাল আর বুয়েনস আইরেসের বোকা জুনিয়ার্সের মধ্যে একটা ম্যাচে দু' দলই দুটো করে গোল করে ফেলেছিল। সবাই যখন ধরেই নিয়েছে খেলা ড্র হবে এমন সময় নাসিওনাল ফের আক্রমণ শানাল, বোকার খেলোয়াড়েরা সঙ্গে সঙ্গে নীচের দিকে নেমে এসে নিজেদের রক্ষণ জমাট করতে ব্যস্ত হলো। এভাবে এক সময় বল এল আতিলিয়ো গার্সিয়ার পায়ে। বেচারা আতিলিয়ো বল পায়ে সামনে তাকিয়ে বিপক্ষ খেলোয়াড়ের পায়ের জঙ্গল দেখে শুধু। চারদিকে শুধু বিপক্ষের খেলোয়াড় দেখে সে রাগে গরগর করতে করতে মাঠের ডানদিক ঘেঁষে একটা রাস্তা বানিয়ে এগিয়ে চলে।
আতিলিয়ো মাঠে নামলেই সবাই সর্বশক্তি দিয়ে তার পেছনে পড়ে যেত। খেলতে নেমে প্রতিপক্ষের লাথি খাওয়ার অভ্যেস তার বহুকালের। ফলে ওর পায়ের দিকে তাকানো যেত না, দুটো পা যেন হাজারও ক্ষতচিহ্নের মানচিত্র। বোকা জুনিয়ার্সের সঙ্গে খেলায় সেদিন বিকেলে সে যখন গোলের দিকে দৌড় দিয়েছে, তখন অ্যাঙ্খেলেতি আর সুয়ারেজ় তাকে কড়া ট্যাকল করল। কিন্তু আতিলিয়ো দু'জনকেই দু'বার করে বোকা বানাল। ভালুসি তার জার্সি ধরে বেমক্কা টান মেরে জামাটার দফরফাই শুধু করল না, তাকে হাত ধরে টেনে রেখে ক্রমাগত লাথি মেরে চলল। আতিলিয়ো যখন ধনুকের মতো বেঁকে গোলের দিকে যাচ্ছে, বিশালকায় ইবানিয়েস এসে সামনে রাস্তা রুখে দাঁড়াল। কিন্তু আতিলিয়ো তখন অপ্রতিরোধ্য। বলটা ততক্ষণে ওর শরীরেরই অংশ হয়ে উঠেছে, আর দেহে বইছে টর্নেডো। আতিলিয়ো এমনভাবে বোকা জুনিয়ার্সের খেলোয়াড়দের ধাক্কা মেরে এগোতে লাগল যেন ওরা মানুষ নয় সব কম্বল দিয়ে বানানো পুতুল। এভাবে প্রায় ছেলেখেলার ভঙ্গিতে সে গোলের সামনে পৌঁছে এমন জোরে শট নিল যে জাল প্রায় ছিঁড়ে যায় আর কী!
বাতাসে তখন বারুদের গন্ধ। বোকার এগারোজন যথারীতি উত্তেজিত হয়ে রেফারিকে ঘিরে বোঝাবার চেষ্টা করছিল, তারা এতবার ফাউল করা সত্ত্বেও রেফারি কেন বাঁশি বাজাল না! এ গোল তো বাতিল করতেই হবে। কিন্তু রেফারি ওদের কথায় পাত্তাই দিল না। বিফল মনোরথ হয়ে বোকা জুনিয়ার্সের খেলোয়াড়রা রেফারিকে খিস্তি করতে করতে মাঠ ছাড়ে।
চুমু কী আর একঘেয়ে হয়!
আরহেন্তিনীয়রা অনেকেই বুকে হাত রেখে হলফ করে বলবে যে এনরিক গার্সিয়াই সর্বকালের সেরা। চতুর ফুটবলার, লোকমুখে ‘এল চুয়েকো’, গার্সিয়া বাঁ দিকের উইং ধরে ছুটত। আবার উরুগুয়ের লোকেরা একই রকম আবেগে হাতের তর্জনী আর মধ্যমায় কাটাকুটি করে ঠোঁটের সামনে এনে বলবে তাদের প্রিয় খচ্চরটি, ‘এল মুয়েলরো’, পেদ্রো লাগোর কথা। লাগো ছিল পেনারলের স্ট্রাইকার। ওদের দু'জনের মধ্যেই কেউ একজন সর্বকালের সেরা হবে, হয়তো দু'জনই সেরা।
অর্ধ শতাব্দী বা তারও কিছুটা আগে লাগো আর গার্সিয়া একের পর এক নিখুঁত গোল করত। এমন গোল, যা দেখে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়রা রাগে অথবা অনুরাগে অসাড় হয়ে যেত। গোলের পর দু'জনেই বলটা জাল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বগলে চেপে পা টেনে টেনে মাঝমাঠে ফিরে অসত। ধীর গতিতে এমন পা টেনে টেনে হাঁটায় আবিরের মতো ধুলো উড়ত। তারা ধুলো উড়িয়ে নিজেদের পায়ের ছাপ মুছে দিত, যাতে পায়ের ছাপ লক্ষ্য করে কেউ তাদের খেলা নকল করতে না পারে।
আরও পড়ুন- “জয় অথবা মৃত্যু”! বিশ্বকাপ ফাইনালের আগে ফুটবলারদের টেলিগ্রাম করলেন মুসোলিনি
নমো যন্ত্র
গত শতাব্দীর চারের দশকের শুরুতে আরহেন্তিনার রিভার প্লেট ক্লাব তাদের সর্বকালের সেরা দলটি গড়েছিল। ক্লাবের ইতিহাসে এমন অপ্রতিরোধ্য দল আর কখনও হয়নি।
"কেউ আক্রমণে উঠে যেতাম, কেউ আবার নীচে নেমে আসতাম, সবাই একসঙ্গে ঝাঁপাতাম, রুখে দাঁড়াতাম, হেরে গেলে বিষণ্ণ মুখে বন্ধুর কাঁধে হাত রাখতাম"
ওই দলের অল্পবয়সী খেলোয়াড়দের অভিভাবকতুল্য ফুটবলার কার্লোস পেউচেলে এভাবেই পুরনো দিনের স্মৃতিচারণ করেছেন। রিভার প্লেটের সেই দলে খেলোয়াড়রা ক্রমাগত নিজেদের মধ্যে জায়গা বদল করত। রক্ষণভাগের খেলোয়াড় উঠে যেত আক্রমণে, স্ট্রাইকার নেমে যেত পেনাল্টি বক্সের কাছে। পেউচেলে বেশ আত্মতৃপ্তির ভঙ্গিতে রসিয়ে রসিয়ে বলেছেন,
"কোচের ব্ল্যাকবোর্ডেই হোক বা মাঠে নেমে খেলার সময়, আমাদের রণকৌশল সবসময়ই অভিনব হত। আমরা মান্ধাতার বাপের আমলের ১-২-৩-৫ ধরনের ছকে না খেলে সহজ সরল ভাবে ১-১০ ছকেই খেলতাম"।
রিভার প্লেটের ওই দলে সবাই সব জায়গায় খেলতে পারলেও, ওদের আক্রমণভাগের ঝাঁঝ যে বেশি ছিল তা মানতেই হবে। মুনোস, মোরেনো, পেদেরনেরা, লাব্রুনা, লুহ্তো একসঙ্গে তারা মাত্রই ১৮ টা ম্যাচ খেলেছে, কিন্তু ওতেই কামাল করে দিয়েছে। সেদিনের দলের কথা আজও লোকের মুখে মুখে ফেরে। এই পাঁচজন আবার নিজেদের শ্রবণশক্তিতে ভর করে খেলত। তারা শিস দিয়ে একে অন্যকে ইশারা করত উপরের দিকে উঠে আসতে, কিংবা বল বাড়াতে। আর বলের কথা কী বলব! সে তো ওদের পোষা হাসিখুশি সারমেয়, পায়ে পায়ে ঘোরে, কক্ষনও চোখের আড়াল হয় না।
ভক্তরা রিভার প্লেটের খেলোয়াড়দের সলমা জরির কাজের মতো নয়নাভিরাম ফুটবল দেখে ওই রূপকথার দলকে ‘যন্ত্র’ বলে ডাকত। এই প্রশংসায় খানিক ব্যজস্তুতির নুন-গোলমরিচ ছড়ানো। ওই দলের স্ট্রাইকাররা খেলার সময় এত মজা করত যে মাঝে মাঝে গোলে শট নিতেও ভুলে যেত। যন্ত্রের চাষাড়ে যান্ত্রিকতার সঙ্গে তাদের আদৌ কোনও মিল ছিল না। কিন্তু ভক্তরা যে তাদের বীরত্বকে যথেষ্ট উদ্বেগের সঙ্গে হজম করত তা নিয়েও কোনও সংশয় নেই। কেন না, শালার ব্যাটা শালা, ওই ফুটবলাররা কোথায় একটা গোল করে দর্শকদের নিশ্চিন্ত করবে, উলটে প্রত্যেকবার উৎকণ্ঠায় দম বের করে ছাড়ত!
মোরানো
ভক্তকুল মেহিকোর এক সিনেমা তারকার সঙ্গে তার মুখের মিল দেখে আদর করে ‘রাখাল’ বলে ডাকত। তার জন্ম বুয়েনস আইরেসের উত্তর দিকে নদীর উজানে যেতে হয় এমন একটা গাঁয়ে।
হোসে মানুয়েল মোরানো ছিল রিভার প্লেটের বিখ্যাত ‘যন্ত্র’ দলের সবচাইতে জনপ্রিয় খেলোয়াড়। মোরানো নিজের সম্পর্কে আজগুবি সব রহস্যময় কথা প্রচার করতে পছন্দ করত। যেমন, তার জলদস্যুর মতো পা দেখে যেদিকে মারতে চাইছে বলে মনে হবে, ও নাকি তার ঠিক উলটোদিকে মারতে পারত। এমনকী ওর ডাকাতে হেড গোলপোস্টের যেদিকে যাওয়ার কথা, শেষ পর্যন্ত নাকি তার উলটো অভিমুখে যেত।
প্রতিপক্ষ যতবার মাঠে তাকে লাথি মেরে ফেলে দিয়েছে, আঘাত যত গুরুতরই হোক, সে প্রত্যেকবার নিজে নিজেই উঠে দাঁড়িয়েছে। মুখে টুঁ শব্দটি করেনি, কোনও অভিযোগও নয়, খেলা শেষ না হওয়া পর্যন্ত মাঠও ছাড়েনি। মোরানোর স্বভাবে একটা গ্রাম্ভারি ভাব ছিল, যেন কোনও লাট-বেলাট হেঁটে বেড়াচ্ছে। অবিশ্যি তার গায়ের জোর কিছু কম ছিল না, চাইলে প্রতিপক্ষের গ্যালারিকে এক ঘুঁষিতে উড়িয়ে দিতে পারত। শুধু প্রতিপক্ষই বা বলি কেন, নিজের দলের সমর্থকদেরও সে রেয়াত করত না। তার ভক্তরা তাকে যেমন ভালোবাসত, তেমনই দল হারলে তাকেই আবার খিস্তি করে ভূত ভাগাত যে!
মোরানো সংগীতের সমঝদার ছিল, প্রিয় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারতে পছন্দ করত, বুয়েনস আইরেসের নৈশ জীবন তাকে টানত। সাধারণভাবে তার ভোর হতো নৈশ অভিযানে পৌঁছে যাওয়া পানশালার কাউন্টারে কোনও অপরূপা রাতপাখির বিনুনিতে জড়িয়ে কিংবা নিজের কনুইয়ের উপর ভর করে। সে সবাইকে বলত,
"ট্যাঙ্গো শেখো হে। ওটাই অনুশীলনের সেরা উপায়। কীভাবে খেলায় ছন্দ ধরে রাখবে, আবার আচমকা লম্বা দৌড় লাগাবার আগে কেমন করেই বা পালটে নেবে ছন্দের চাল। আশপাশের নকশাটা বুঝে নিতে শেখো আর নিজের কোমর আর পায়ের উপর নজর দাও। ও দুটোকে বশ মানাতে শিখতে হবে"।
রোববার দুপুরে, প্রতিটি ম্যাচের আগেই, সে প্রায় এক গামলা মুরগির স্টু সাবাড় করত, অনুপান হিসেবে কয়েক বোতল রেড ওয়াইনও শেষ হয়ে যেত চোখের পলকে। সেই সময় রিভার প্লেটের হর্তাকর্তারা তাকে বারবার সাবধান করেছে, উদ্ধত আচরণ সামলাতে বলেছে, আরেকটু পেশাদারিত্ব আনতে বলেছে। সে যে চেষ্টা করেনি তাও নয়। যতটা সম্ভব চেষ্টা করেছে। পুরো এক হপ্তা সে রাতের বেলা ঘরের দরজা লাগিয়ে ঘুমিয়েছে, দুগ্ধপোষ্য হয়ে থেকেছে। কপালের এমনই ফের যে তারপরের ম্যাচটাতেই সে জীবনের নিকৃষ্টতম ফুটবল খেলে। সুতরাং মোরানো ফের নিজের রাস্তায় ফেরে, সারারাত মদ্যপান আর যত অনাসৃষ্টি কাণ্ডে নিজেকে ব্যস্ত রাখে। কিন্তু এবার বিধি বাম ছিল, ক্লাব তাকে সাসপেন্ড করে। তার সহ খেলোয়াড়েরা এই ঘটনার প্রতিবাদে সংশোধনের অযোগ্য, পাক্কা বোহেমিয়ান মোরানের পাশে দাঁড়াতে ধর্মঘটেরও ডাক দেয়। ফলত রিভার প্লেটকে ন'টা ম্যাচে বদলি খেলোয়াড় দিয়ে কাজ চালাতে হয়।
আরে ধুর মশাই, অত দুঃখ পাবার কিছু নেই। খুল্লামখুল্লা জীবনযাপনের জয় হোক; মোরানোর খেলা মোটেই বন্ধ হয়ে যায়নি। বরং এত বেহিসেবি জীবন কাটিয়েও সে ফুটবলের ইতিহাসে সম্ভবত সবচেয়ে বেশিদিন খেলে গেছে। লোকটা আরহেন্তিনা, মেহিকো, চিলে, উরুগুয়ে এবং কলম্বিয়া মিলে কুড়ি বছর ধরে ফার্স্ট ডিভিশন ফুটবল খেলেছে। ১৯৪৬ সালে সে যখন মেহিকো থেকে ফিরে এল, রিভার প্লেটের সমর্থকেরা বাঁধভাঙা বন্যার মতো দলে দলে স্টেডিয়ামে গিয়েছিল তার ছলাকলা দেখতে। সেদিনের খেলায় সে তিন তিনটে গোল করে। দর্শকরা তখন আর কোনও বাধা মানেনি, স্টেডিয়ামের বেড়া ভেঙে মাঠের মাঝখানে ঢুকে তাকে কাঁধে করে বাইরে নিয়ে আসে। ১৯৫২-তে মন্তেভেদিয়োর নাসিওনাল তাকে অত্যন্ত লোভনীয় প্রস্তাব দিলেও সে তা প্রত্যাখ্যান করে উরুগুয়েরই একটি ছোট দল, ডিফেন্সারের সঙ্গে চুক্তি করে। ডিফেন্সার তাকে সামান্যই অর্থ দিতে পারত বা হয়তো কোনও টাকাপয়সার কথাই ওঠেনি। তবু মোরানো ওই ক্লাবেই গেল, কারণ সেখানে তার কয়েকজন বন্ধু ছিল। সেবছর মোরানো ডিফেন্সার ক্লাবের অবনমন রুখে দেয়।
শেষ পর্যন্ত ১৯৬১-তে খেলা ছেড়ে দেবার পর সে কলম্বিয়ার মেদেজিন ক্লাবের কোচ হয়। একদিন মেদেজিন খেলছিল বোকা জুনিয়ার্সের বিরুদ্ধে। খুব স্বাভাবিকভাবেই বোকা জিতছিল। মেদেজিন কিছুতেই ওদের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারছিল না। তখন আচমকাই, জার্সি-টার্সি ছাড়াই, স্রেফ সাধারণ প্যান্ট-শার্ট পরেই পঁয়তাল্লিশ বছরের মোরানো মাঠে নেমে পড়ে। সেদিনও সে দুটো গোল করেছিল। মেদেজিন ম্যাচটা জিতেও যায়।
আরও পড়ুন- মুরগির মাংস খেলেই ম্যাচে হার! ফুটবলের বিচিত্র কুসংস্কারের এই ইতিহাস অজানাই
পেদেরনেরা
"আজ যে পেনাল্টিটা আটকালাম, সেটা লেতিসিয়ার ইতিহাসে খোদাই করা থাকবে", এক তরুণ আরহেন্তিনীয় কলম্বিয়া থেকে নিজের দেশের কাউকে একটা চিঠিতে লিখেছিল। তার নামটা আপনাদের অচেনা নয়, এর্নেস্তো গেভারা, তখনও সে ‘চে’ হয়ে ওঠেনি। ১৯৫২ সালে যখন গেভারা লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে নিষ্কর্মার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছিল, তখন অ্যামাজ়নের পাড়ে লেতিসিয়ার একটি ফুটবল দলে কিছুদিনের জন্য কোচের দায়িত্ব পালন করে। গেভারা তার দোস্তকে ডাকত ‘পেদেরনেরিতা’ বলে, এর চেয়ে আদরের ডাক আর কীই বা হতে পারে!
আদোলফো পেদেরনেরা ছিল রিভার প্লেটের সেই রূপকথার দলটির আলম্বন বিন্দু, গোটা দলের ভারসাম্য রক্ষা করত। তাকে বলা যায় অর্কেস্ট্রা পার্টির একক বাজনদার, মাঠের যেকোনও জায়গায় খেলতে পারত। কখনও উপরে, কখনও নীচে, কখনও মাঝমাঠে যখন যেমন প্রয়োজন। পেছন থেকে শুরু করলে সে খেলাটা তৈরি করতে পারত, একেবারে ছুঁচে সুতো পরানোর মতো, ইচ্ছেমতো খেলার গতিও বদলে দিত, অকল্পনীয় সব গোলের সুযোগ তৈরি করতে পারত। আর আক্রমণে গেলে গোলমুখী শটে গোলকিপার সমেত উড়ে যেত।
তার মাথায় সবসময় খেলার পোকা কিলবিল করত। খেলা শেষ হবে এ তার একেবারেই না-পসন্দ ছিল। রাত নেমে গেলেও স্টেডিয়ামে তার অনুশীলন থামত না। স্টেডিয়ামের কর্মচারীরা যেনতেন প্রকারে তাকে বল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে চেষ্টা করত। কিন্তু মুশকিল হল, বলও তাকে ছেড়ে যেতে চাইত না।
বোম
যুদ্ধের সময় গোটা পৃথিবী যখন যন্ত্রণায় ছটফট করছে, সেসময় হিউ দে জেনেইরোর দৈনিক পত্রিকাগুলোয় বাঙ্গু অ্যাথলেটিক ক্লাবের মাঠে লন্ডনের মতোই বোমাবর্ষণের খবর ফলাও করে ছাপা হল। ১৯৪৩-এর মাঝামাঝি সময়ে বাঙ্গুর একটা ম্যাচ পড়েছিল সাও ক্রিস্তভোর সঙ্গে। বাঙ্গুর অন্ধভক্তরা ঠিক করেছিল সেদিন স্টেডিয়ামে চার হাজার বোম ফাটাবে। ফুটবলের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বোমাবর্ষণ।
বাঙ্গুর খেলোয়াড়রা মাঠে ঢোকামাত্রই এমন আতশবাজির রোশনাই শুরু হলো যে, বাতাসে বারুদের গন্ধ বুঝে নিতে সাও ক্রিস্তভোর খেলোয়াড়দের অসুবিধে হয়নি। কোচ নিজের ছেলেদের সাজঘরে আটকে রেখে তাদের কানে তুলো গুঁজে রেখেছিল। যতক্ষণ ধরে বোম-আতশবাজির খেলা চলল, বুঝতেই পারছেন খুব কম সময় ধরে কাণ্ডটা ঘটেনি, সাজঘরের মেঝে কাঁপছিল, দেওয়াল কাঁপছিল, সাও ক্রিস্তভোর খেলোয়াড়রাও কাঁপছিল। তারা গোল হয়ে মাথায় মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়েছিল দাঁতে দাঁত চেপে, চোখ বন্ধ করে বোধহয় ভাবছিল বুঝি বিশ্বযুদ্ধের ঢেউ ঘরের কাছেও আছড়ে পড়ল। ওরা অনেক পরে যখন মাঠে নামে, তখনও ঠকঠক করে কাঁপছে। দেখে মনে হচ্ছিল ওদের মধ্যে যারা মৃগিরোগী নয়, তাদের নিশ্চয়ই ম্যালেরিয়া হয়েছে। আকাশ তখন ঘন ধোঁয়ায় ঢেকে গেছে। বাঙ্গুর সমর্থকেরা আকাশে আচ্ছাসে কালো রঙের প্রলেপ লাগিয়ে দিয়েছিল!
আরও পড়ুন- উড়ন্ত গোল করতে করতেই মারাত্মক সংঘর্ষ, বাইসাইকেল কিক কেড়েছিল ফুটবলারের প্রাণ
কিছুদিন পরে হিউ দে জেনেইরো আর সাও পাওলোর দুই দলের মধ্যে ফের খেলা পড়ল। এবারও যুদ্ধের করাল ছায়া প্রলম্বিত হল। প্রভাতী দৈনিকগুলো আর একটা পার্ল হারবারের ভবিষ্যদ্বাণী করল। প্রায় ন'শো দিন ধরে অবরুদ্ধ লেনিনগ্রাদের যুদ্ধের কথা মনে করাল কেউ, কেউ বা অন্য কোনও বিপর্যয়ের কথা। সাও পাওলোর অধিবাসীরা বুঝে গেছিল হিউ শহরে তাদের জন্যে ফের অপেক্ষা করে আছে তুমুল বোমাবর্ষণ। তখনই তাদের কোচের মাথায় বুদ্ধিটা আসে। সাজঘরে না লুকিয়ে বরং হিউ দে জেনেইরোর খেলোয়াড়দের সঙ্গেই মাঠে ঢোকা ভালো। তাহলে বোম ফাটানোর আওয়াজে ছেলেরা ভয় পাবে না, উলটে যেন তাদের অভ্যর্থনা করতে ফাটানো হচ্ছে বলে মনে হবে।
তাই-ই হল, কিন্তু সাও পাওলো যথারীতি হারল, ৬-১।
সেই লোকটা, যে নিরেট লোহার শরীরে হাওয়ার বেগ এনে দিত
এদোয়ার্দো চিইদা বাস্ক শহর সান সেবাস্তিয়ানে রিয়াল সোসিয়াদের গোল সামলাত। লম্বা, একহারা চেহারা গোলের সামনে দাঁড়িয়ে বিষাক্ত শট সামলানোয় তার বিশেষ দক্ষতা ছিল। ফলে বার্সেলানা আর রিয়াল মাদ্রিদ দুই দলেরই নজর ছিল তার উপর। বিশেষজ্ঞরা বলাবলি করত, এই ছেলেটা একদিন সামোরাকেও ছাপিয়ে যাবে।
কিন্তু মানুষ ভাবে এক, আর হয় আরেক। ১৯৪৩-এ প্রতিপক্ষের স্ট্রাইকার সানুদো আক্ষরিক অর্থেই ‘সানুদো’, হিস্পানিতে যার মানে রগচটা-গোঁয়ার চিইদার হাঁটুতে এমন লাথি কষাল যে ওর মেনিস্কাস কার্টিলেজ গেল ছিঁড়ে। পাঁচ-পাঁচটা অপারেশন করিয়েও যখন কোনও লাভ হল না, তখন সে চিরতরে খেলা ছেড়ে দিয়ে ভাস্কর হবে বলে মনস্থ করল।
এভাবেই বিংশ শতাব্দীর এক মহান ভাস্করের জন্ম হয়। চিইদা তার ভাস্কর্যগুলিতে খুব ভারী উপকরণ ব্যবহার করত বলে সেগুলো মাটিতে নিজে থেকেই গেঁথে বসত। কিন্তু তার হাতের জাদুতে লোহার রড আর কংক্রিট শূন্যে এমন খেলা করত যে তারা নিজেরাই যেন নতুন নতুন পরিসর আবিষ্কার করে নিত। হাওয়ায় ভাসতে ভাসতেই তারা নতুন মাত্রা লাভ করত। যেমন সে নিজেও এক কালে মাঠে নেমে উড়ে উড়ে গোল বাঁচাত।