চৌষট্টির খোপে বিদ্রোহী! নজরুলের দাবাপ্রেম রয়ে গেছে অগোচরেই

Kazi Nazrul Islam: ১৯৩১ সালে প্রকাশিত বইয়ের নাম-রচনা ‘শিউলিমালা’। এটি কোনওভাবে দাবাকেন্দ্রিক কাহিনি নয়। নিখাদ প্রেমের গল্প।

“অনেক চেষ্টা করেও টিকিট পাইনি। যদি অন্তত একটা টিকিটের ব্যবস্থা করে দেন তাহলে আমার কিছু কবিতার স্বত্ব আপনাকে দিয়ে দিতে পারি।”

চিরকুটে কথাগুলো লিখে খোদ গোষ্ঠ পালের কাছে পাঠিয়েছিলেন কট্টর মোহনবাগানী কাজী নজরুল ইসলাম। যদিও, এত কিছুর পরেও ‘বিদ্রোহী কবি’-র হাতে জোটেনি ডার্বির টিকিট! নজরুলের ফুটবল-উন্মাদনা নিয়ে ছোট-বড় নানা মাপের চর্চা হয়েছে। কীভাবে মোহনবাগান বনাম এরিয়ান ম্যাচে ব্রিটিশ রেফারির পক্ষপাতদুষ্ট সিদ্ধান্তের বিরোধিতায় ক্রোধোন্মত্ত নজরুল গোরা ঠেঙিয়ে ‘শান্ত’ হয়েছিলেন, তা আজ বহুশ্রুত। কিন্তু ফুটবলের তালেগোলে অলক্ষ্যে রয়ে গেছে দাবা নিয়ে নিবিড় অনুধ্যান ও আসক্তির কথা৷ স্মৃতিচারণ কিছু আছে, তবে স্বল্প। বদলে নজরুলের লেখা একটি গল্পকে তাঁর দাবা-প্রেমের বিশদ সাক্ষ্য হিসেবে দেখা যেতে পারে। গল্পের নাম ‘শিউলিমালা’।

১৯৩১ সালে প্রকাশিত বইয়ের নাম-রচনা ‘শিউলিমালা’। এটি কোনওভাবে দাবাকেন্দ্রিক কাহিনি নয়। নিখাদ প্রেমের গল্প। কিন্তু দাবা খেলা রয়েছে আলম্বনের মতো, তৈরি করেছে পটভূমি। গল্পের নির্যাস সংক্ষেপে এরকম: কলকাতার এক নামকরা তরুণ ব্যারিস্টার মিস্টার আজহার। অবিবাহিত। অগাধ সম্পত্তির মালিক। পেশায় প্রভূত উন্নতির সুযোগ থাকলেও স্রেফ দাবার নেশার কারণে তিনি তা হেলায় হারান। পসার জমুক না জমুক, প্রতি সন্ধ্যায় দাবার আসরটি বসা চাই-ই-চাই। একদিন বন্ধুদের সঙ্গে ঘরোয়া আড্ডায় আজহার অনেক বছর আগে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার গল্প বলেন। শিলংয়ে বেড়াতে গিয়ে প্রফেসর চৌধুরি, পেশায় কেমিস্ট, তাঁর সঙ্গে দাবা খেলায় মেতে উঠেছিলেন আজহার। সেই সময় মিস্টার চৌধুরির মেয়ে শিউলির সঙ্গে আলাপ। শুরুতে দাবা। তারপর গান শেখানোর সূত্রে দু'জনের মধ্যে সম্পর্ক ক্রমশ গাঢ় হয়ে আসে। পূর্বরাগ পেরিয়ে অনুরাগ। কিন্তু শেষমেশ বিরহে গল্পের সমাপ্তি। শিউলিকে না-পাওয়ার বেদনা বুকে নিয়ে আজহারকে ফিরে আসতে হয়। শুধু রয়ে যায় অপ্রাপ্তির স্মৃতি— “... আর তার সাথে দেখা হয়নি– হবেও না!... শিউলিফুলের আশ্বিন যখন আসে—তখন নীরবে মালা গাঁথি আর জলে ভাসিয়ে দিই!”

আরও পড়ুন- বিশ্বভারতীর আপত্তি, রবীন্দ্রনাথ সেদিন দাঁড়িয়েছিলেন নজরুলের পাশে

কেন্দ্রীয় বিষয় না হলেও গল্পের কাঠামো আর চরিত্র নির্মাণে দাবার অনুষঙ্গ নিপুণভাবে প্রয়োগ করেছেন নজরুল— “আজহারের সবচেয়ে দুঃখ, ক্যাপাব্লাঙ্কার মতো খেলোয়াড় কিনা অ্যালেখিনের কাছে হেরে গেল। অথচ অ্যালেখিনই বোগোল-জুবোর মতো খেলোয়াড়ের কাছে অন্তত পাঁচ পাঁচবার হেরে যায়!” এখানে তিনজন প্রবাদপ্রতিম দাবাড়ুর কথা এসেছে: জোসে রাউল ক্যাপাব্লাঙ্কা (কিউবা), আলেকজান্ডার অ্যালেখিন (ফ্রান্স) এবং এফিম বোগোল-জুবো (জার্মানি)। স্পষ্টতই, উদ্ধৃতির গোড়ায় ১৯২৭ সালে আর্জেন্টিনার বুয়েনস আইরেসে আয়োজিত বিশ্ব দাবা প্রতিযোগিতার ইঙ্গিত রয়েছে। রেকর্ড সময় ধরে চলা চ্যাম্পিয়নশিপে মুখোমুখি হয়েছিলেন ক্যাপাব্লাঙ্কা-অ্যালেখিন। দীর্ঘ ছয় বছর সেরার শিরোপা ধরে রেখেছিলেন ক্যাপাব্লাঙ্কা। এর আগেও একাধিকবার অ্যালেখিনের মুখোমুখি হয়েছিলেন তিনি। প্রতিবার একপেশে লড়াইয়ে ফ্রান্সের দাবাড়ু পরাস্ত হন। তাই সেবারও মনে করা হয়েছিল, ক্যাপাব্লাঙ্কাই শেষ হাসি হাসতে চলেছেন। কিন্তু সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত চলা ম্যারাথন ম্যাচে ছ-বার জয়, তিনবার পরাজয় আর পঁচিশ খানা ড্রয়ের দৌলতে অ্যালেখিন কিস্তিমাত করেন।

“...ক্যাপাব্লাঙ্কার মতো খেলোয়াড় কিনা অ্যালেখিনের কাছে হেরে গেল”—আজহারের দু:খের মধ্যে নিহিত রয়েছে বিস্ময়বোধ। আর ক্যাপাব্লাঙ্কার পরাজয়জনিত এই ‘বিস্ময়’-কে কেন্দ্র করে দীর্ঘ সময় যাবৎ দাবার দুনিয়ায় চর্চা চলেছে। ক্যাপাব্লাঙ্কার মৃত্যুর পর অ্যালেখিন স্বীকার করেন, তিনি নিজেও জেতার ব্যাপারে খুব একটা আশাবাদী ছিলেন না! তাঁর মতে, একটানা জয়লাভ প্রতিদ্বন্দ্বী ক্যাপাব্লাঙ্কাকে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছিল। সেবার কোনওরকম শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি ছাড়াই নাকি টেবিলে বসেছিলেন কিউবার দাবাড়ু। যে কারণে দান দিতে সহজ কিছু ভুল করে বসেন। অন্যদিকে অ্যালেখিন এসেছিলেন পুরোদমে হোমওয়ার্ক সেরে। ঘরে বসে ক্যাপাব্লাঙ্কার প্রতিটি মুভ নিয়ে খুঁটিয়ে প্রস্তুতি চালিয়েছিলেন তিনি। গ্যারি কাসপারভের মতো কেউ কেউ এই পরাজয়ের নেপথ্যে ক্যাপাব্লাঙ্কার মনোসংযোগের অভাবকেও দায়ী করেন। লুডেক পাচম্যানের মতে, এগারো নম্বর গেমে অহেতুক ভুল চাল দিয়ে বসায় খেলা চলাকালীনই নাকি অবসাদের শিকার হন ক্যাপাব্লাঙ্কা! মোট কথা, ১৯২৭ সালের এই চ্যাম্পিয়নশিপ দীর্ঘদিন আলোচনায় থেকেছে। অ্যালেখিনের জয়কে বেশিরভাগ দাবা বিশেষজ্ঞ ‘অঘটন’ হিসেবে দেখেছেন। আজহারের বিস্ময়ও তাই ভিত্তিহীন নয়, যুক্তিযুক্ত। বিশ্বদাবার হালহকিকত নিয়ে নজরুল কতটা ওয়াকিবহাল ছিলেন, তার প্রমাণও এই সূত্রে পাওয়া যায়।

গল্পে নজরুল অ্যালেখিনের হয়েও সওয়াল করেছেন। তাঁর অ্যাডভোকেট মুখার্জিবাবু বলছেন,

“... কিন্তু তুমি যাই বল আজহার, অ্যালেখিনের ডিফেন্স–ওর বুঝি জগতে তুলনা নেই। আর বোগোল-জুবো? ও যে অ্যালেখিনের কাছ তিন-পাঁচে পনেরোবার হেরে ভূত হয়ে গেছে! ওয়ার্লড-চ্যাম্পিয়ানশিপের খেলায় অমন দু-চার বাজি সমস্ত ওয়ার্লড-চ্যাম্পিয়ানই হেরে থাকেন। চব্বিশ দান খেলায় পাঁচ দান জিতেছে। তা ছাড়া, বোগোল-জুবোও তো যে সে খেলোয়াড় নয়!”

প্রথম বাক্যে নজরুল ‘অ্যালেখিন-ডিফেন্সে’-র মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গে আমাদের নজর টেনেছেন। বিশের দশকে আলেকজান্ডার অ্যালেখিনের এই ওপেনিং চাল সমাদৃত হয়। ঠিক প্রথাবদ্ধ নয়, হাইপারমর্ডান ঘরানার স্টাইল হিসেবেই একে অনেকে দেখে থাকেন। কালো ঘুঁটির ঘোড়া দিয়ে গেম শুরু করে সাদা বোড়ের বিন্যাসকে চ্যলেঞ্জ ছুড়ে দেওয়ার কৌশল অভিনবত্বের কারণে প্রশংসা কুড়িয়েছিল। যা এখনও দাবার ওপেনিংয়ে অন্যতম মুভ বলে ধরা হয়। ১৯২১ সালে বুদাপেস্ট টুর্নামেন্টে অ্যালেখিন আন্দ্রে স্টেইনারের বিপক্ষে খেলতে বসে এই চালের প্রবর্তন করেন। পরের বছর এফিম বোগোল-জুবোর মুখোমুখি হন। তাঁকে পরাজিত করেন। এরপর ১৯২৯ সালের ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপেও জুবোকে হারিয়ে নিজের খেতাব ধরে রাখেন অ্যালেখিন। ফাইনাল রেজাল্ট- অ্যালেখিন সাড়ে পনেরো পয়েন্ট এবং বোগোল-জুবো সাড়ে নয়। গল্পে মুখার্জিবাবুর বয়ান আদত স্কোরলাইনকেই মান্যতা দিয়েছে।

যদিও এই বয়ানের প্রত্যুত্তরে প্রত্যাশিতভাবে তেড়েফুঁড়ে উঠেছে আজহার— “আরে রাখো তোমার অ্যালেখিন। এইবার ক্যাপাব্লাঙ্কার সাথে আবার খেলা হচ্ছে তার, তখন দেখো একবার অ্যালেখিনের দুর্দশা!” ‘আবার খেলা হচ্ছে’ বলতে ১৯২৭-এর চ্যাম্পিয়নশিপের রি-ম্যাচের কথা বোঝাতে চেয়েছেন নজরুল। বিশের দশকে যাকে ঘিরে দাবা-দুনিয়ায় বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। ক্যাপাব্লাঙ্কাকে হারানোর পরপরই রিটার্ন ম্যাচের প্রস্তাব দিয়েছিলেন অ্যালেখিন। কিন্তু আর্থিক শর্তকে কেন্দ্র করে দু'পক্ষে মতান্তর তৈরি হয়, যা আখেরে মনান্তরের চেহারা নেয়। ফলে একাধিকবার সুযোগ দেখা দিয়েও দুই কিংবদন্তির রিটার্ন ম্যাচ শেষমেশ ভেস্তে যায়। নজরুলও যে গোটা বিষয়টির উপর নজর রাখছিলেন, যুযুধান দ্বৈরথের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন, আজহারের বক্তব্যে তা স্পষ্ট। বস্তুত, আজহার-মুখার্জিবাবুর উক্তি-প্রত্যুক্তিকে বিশ-তিরিশের দশকে আন্তর্জাতিক দাবা মানচিত্রে ঘনিয়ে ওঠা বেশ কিছু স্মরণীয় দ্বৈরথের ভাষ্য হিসেবে পড়া যেতে পারে।

আরও পড়ুন- বিশু পাগলের চরিত্রে কাজী নজরুল! যে ‘রক্তকরবী’-র খোঁজ জানেন না অনেকেই

এরই সমান্তরালে খেলার বেশ কিছু প্রায়োগিক দিক গল্পের কাহিনিবস্তুর অন্দরে স্বচ্ছন্দে স্তরীভূত হয়েছে। যেমন, এক জায়গায় দাবাড়ু হিসেবে প্রফেসর চৌধুরির দক্ষতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে জনৈক ভদ্রলোক বলেন— “তাঁরও আপনার মতোই দাবা-খেলার নেশা। অদ্ভুত খেলোয়াড় বুড়ো, চোখ বেঁধে খেলে মশাই!” বোঝা যাচ্ছে, নজরুল এখানে ‘ব্লাইন্ডফোল্ড চেজে'-র কথা বলতে চেয়েছেন। এক্ষেত্রে কোনও ঘুঁটি না দেখে, না ছুঁয়ে দান দিতে হয়। পজিশনের নকশা আঁকতে হয় মনে মনে। নোটেশনের মাধ্যমে দু'পক্ষ নিজেদের মুভের জানান দিয়ে থাকে। স্মৃতিশক্তি ও ভিজুয়ো-স্পেশিয়াল দক্ষতা তুখোড় না হলে এই স্টাইলে সফল হওয়া কার্যত অসম্ভব। নজরুল দাবার এই জটিল অথচ অভিনব প্রকরণটিও গল্পে এনেছেন। পাশাপাশি কোনওরকম রাখঢাক না করে ঘরোয়া আসরে পুরুষদের সভায় দাবা খেলতে বসে পড়া হিন্দু মেয়ে শিউলির প্রশংসায় যখন আজহার বলেন— “দেখুন, মেয়েদের ওয়ার্ল্ড-চ্যাম্পিয়ান মিস মেনচিকের সাথেও খেলেছি, কিন্তু এত বেশি বেগ পেতে হয়নি আমাকে, আমি তো প্রায় হেরেই গেছিলাম” —তখন আখ্যানে ঐতিহাসিক চরিত্রের সঙ্গে কাল্পনিক চরিত্রের মিলমিশ ঘটিয়ে প্রকারান্তরে লিঙ্গবৈষম্যের বিরুদ্ধেও তির্যক মন্তব্য ছুড়ে দেন নজরুল। এই মন্তব্য প্রচ্ছন্ন নয়; স্পষ্ট ও জোরালো এক প্রতিবাদ। জন্মসূত্রে রুশ মহিলা দাবাড়ু ভেরা মেনচিকোভা ১৯২৭ সাল থেকে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত টানা বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের মুকুট ধরে রেখেছিলেন। পরাধীন ভারতের এক কিশোরী উপযুক্ত প্রস্তুতির সুযোগ পেলে যে মেনচিককেও কড়া টক্কর দিতে পারে— এই বাস্তবোচিত উচ্চাশী খোয়াব ফিকশনের পাতায় নজরুল সচেতনভাবে গেঁথে দিতে চেয়েছেন।

দাবার অনুষঙ্গ আগে-পরে নজরুলের কবিতাতেও ঘুরে-ফিরে এসেছে। ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত হয় ‘রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম’। ইরানের জীবনবাদী কবি ওমর খৈয়ামের ‘রুবাই’ বা কবিতা অবলম্বনে এই অনুবাদগ্রন্থ রচনা করেন নজরুল ইসলাম।

“আমরা দাবা খেলার ঘুঁটি, নাই রে এতে সন্দ নাই!/ আশমানি সেই রাজ-দাবাড়ে চালায় যেমন চলছি তাই।/ এই জীবনের দাবার ছকে সামনে পিছে ছুটছি সব,/ খেলার শেষে তুলে মোদের রাখবে মৃত্যু-বাক্সে ভাই!”

কিংবা

“আশমানি হাত হতে যেমন পড়বে ঘুঁটি ভাগ্যে তোর।/ পণ্ডশ্রম করিসনে তুই হাতড়ে ফিরে সকল দোর!/ এই জীবনের জুয়াখেলায় হবেই হবে খেলতে ভাই/ সৌভাগ্যের সাথে বরণ করে নে দুর্ভাগ্য তোর।”

নজরুলের অনুবাদে নিয়তিচালিত জীবননাট্য প্রত্যক্ষভাবে দাবা খেলার রূপকে উঠে আসে। এরই সূক্ষ্মতর ব্যঞ্জনা ধরা পড়ে ১৯৩৫ সালে লেখা বিশ্রুত গানটিতে— “খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে বিরাট শিশু আনমনে।/ প্রলয় সৃষ্টি তব পুতুল খেলা নিরজনে প্রভু নিরজনে॥”

More Articles