অস্ট্রেলিয় কোচ আর সাঁতারুর যে কাহিনিবীজ রসদ জুগিয়েছিল মতি নন্দীর কোনিকে

Moti Nandi: এক অজ়ি ট্রেনার ও কোচের প্রথম আলাপ এবং তার ক্রমিক বিস্তার মতি নন্দীকে কাহিনিবীজের রসদ জুগিয়েছিল নিশ্চিত।

সাতের দশক আর উত্তর কলকাতার কমলদিঘিকে ঘিরেও আরম্ভ হতে পারত লেখাটা। যে দিঘির দু-পাড়ে দুটো সাঁতার শেখার ক্লাব মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। লেখার শুরুতে দেখানো যেত, কীভাবে সন্ধ্যা নামে মহানগরের বুকে—সন্তর্পণে, ধীরছন্দে। কুলফি মালাইওয়ালার হাঁকডাক, মোটরগাড়ির হর্ন, তাসের আড্ডার দমকা চিৎকার, পথশিশুর তীক্ষ্ণ কান্নায় সরগরম এক সন্ধ্যা। শেষবিকেলের মনখারাপ-করা-আলো যখন পুরোপুরি নিভে গিয়েছে, একে একে জ্বলে উঠছে স্ট্রিটলাইট, তখন ময়লা পাঞ্জাবি, মাথায় কাঁচাপাকা চুল, পুরু লেন্সের চশমা পরা একটি লোক আর দীর্ঘ, সরু দেহের এক কিশোরী কমলদিঘির ফুটপাথ ধরে মন্থর পায়ে হেঁটে চলে। লোকটি হাত-পা নেড়ে কিছু বোঝাতে চায়। কখনও উত্তেজিত, কখনও ক্ষিপ্ত, কখনও স্নেহাতুর- নানা ভঙ্গিমার ছায়ামূর্তি বিদায়ী বসন্ত-বাতাসে ক্রমশ মিলিয়ে যেতে থাকে।

এই সিলুয়েট-সান্ধ্য-বর্ণনা আপাতত মুলতবি রাখি বরং। আমরা কলকাতায় ফিরব। কিন্তু তার আগে ভারত মহাসাগর ডিঙিয়ে পাড়ি দেব অস্ট্রেলিয়া। বসন্ত নয়, উপকূলীয় গ্রীষ্মের কথা বলব। জায়গার নাম বালমেইন। সিডনির প্রান্তীয় শহরতলি। শান্ত, নিরুপদ্রব। কলকাতার যেমন কমলদিঘি, বালমেইনের তেমন এলকিংটন বাথস্‌। নামকরা সুইমিং পুল। ‘হোয়াইটহর্স পয়েন্ট বাথস্‌’, ‘কর্পোরেশন বাথস্‌’ বলেও লোকে চেনে। নিয়মকানুন মেনে প্রবেশ অবাধ হলেও, সম্ভবত পাড়াতুতো নৈকট্যের কারণে, বছর বারোর এক দস্যি মেয়ে পুলটিকে নিজের একচেটিয়া সম্পত্তি ভাবতে শুরু করেছিল। মেয়েটি চলত-ফিরত দঙ্গল বেঁধে। বলা বাহুল্য, দলের মাথা ছিল সে নিজে। যখন-তখন পুলে নেমে হইচই শুরু করত। তারপর দিন ফুরোলে সাইকেল চালিয়ে বাড়ির পথ ধরত।

রবিবারের সকাল। ব্রেকফাস্ট সেরে রোজকার মতো সেদিনও ভাই ডনি আর এলিক-কে নিয়ে এলকিংটন বাথসের সদর দরজা ঠেলে ঢুকে পড়েছে মেয়েটি। একেই ‘পাড়ার ছেলেমেয়ে’। তার উপর স্থানীয় সাঁতার ক্লাবের সদস্য। সবমিলিয়ে তিন ভাইবোনের দেমাকের কমতি ছিল না। ‘বালমেইন লিগ অব সুইমিং'-এ নাম তোলা, প্রতিযোগিতায় নামা কি চাট্টিখানি কথা? লাফাতে লাফাতে সবে সুইমিং পুলের কাছাকাছি পৌঁছেছে, এমন সময় তাঁদের নজরে আসে, পুলটি দখল করেছে বেপাড়ার ছেলেপুলে। অবস্থা দেখে মেয়েটি তো রেগে কাঁই! বিপক্ষ দল বয়সে বড়। হাতাহাতি অসম্ভব। তাই তিন ভাইবোন ডাইভিং বোর্ডে দাঁড়িয়ে বিষোদ্গার শুরু করে। মুখে যা আসে, বলে যায় লাগাতার। পরিস্থিতি সামাল দিতে এগিয়ে আসে পুলের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার—সম্পর্কে মেয়েটির দাদা। ধমক-ধামক দিয়ে জানায়, সুইমারের দল স্টেট চ্যাম্পিয়নশিপের প্রস্তুতি নিচ্ছে৷ আজ জলে নেমে দাপাদাপি বন্ধ! উপায় না দেখে রণে ভঙ্গ দিতে হয়। কিন্তু রাগ তো আর কমে না। খানিক বাদে মেয়েটির নেতৃত্বে ছড়া বাঁধে এলিক আর ডনি। দূরে দাঁড়িয়ে ঈল মাছ আর জেলিফিস-কে মিলিয়ে ছন্দোবদ্ধ দুয়ো দিতে থাকে ত্রিমূর্তি। সাঁতারুদের ট্রেনিং করানোর ফাঁকে সবকিছু খেয়াল করছিলেন তাঁদের ট্রেনার। দামাল মেয়েটিকে মনে ধরে তাঁর। খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, হৃদয়ে অবাধ্য সেই মেয়ে স্থানীয় সাঁতার প্রতিযোগিতার চ্যাম্পিয়ন। মৃদু হেসে কথা না বাড়িয়ে ফের কাজে নেমে পড়েন তিনি।

আরও পড়ুন- ছিলেন কাপড় কারখানার মজুর! যেভাবে বিশ্বফুটবলের কিংবদন্তি হয়ে উঠলেন গার্ড মুলার…

সন্ধ্যায় একে একে সবাই বাড়ি ফিরছে। পুশবাইক চড়ে মেয়েটিও যখন প্যাডেল ঠেলতে যাবে, তখন দেখে, সকালবেলার সেই ট্রেনার, যার উস্কানিতে অত সাধের জলক্রীড়া ভেস্তে গিয়েছে, হুডখোলা গাড়ির সিটে বসে তার দিকে মিটিমিটি চেয়ে আছে। পাত্তা না দিয়ে এগিয়ে যাবে ভাবছে, ঠিক তখনই ধেয়ে আসে প্রশ্ন— “সাইকেলের হেডলাইট ভাঙা। নতুন লাগাওনি কেন?”

দিন বরবাদ হওয়ায় মেজাজ এমনিতেই তিরিক্ষি। তাই সাত-পাঁচ না ভেবে বেরিয়ে আসে ঝাঁঝালো জবাব— “আপনি নিজের চরকায় তেল দিচ্ছেন না কেন বলুন তো?”

বলা মাত্র গতি বাড়িয়ে মেয়েটি সাইকেল চালাতে শুরু করে। বাড়ি পৌঁছে নামতে যাবে, হঠাৎ দেখে লোকটা কখন তার পিছুপিছু চলে এসেছে! শুধু তাই নয়। গাড়ি থেকে নেমে সটান সামনে এসেও হাজির।

“তোমার বাবা-মা বাড়ি আছেন? কিছু কথা বলব।”

“বেস্ট অফ লাক।”— কথার উত্তর না দিয়ে পেছনের দরজা দিয়ে মেয়েটি নিজের ঘরে ঢুকে যায়।

কিছুক্ষণ বাদে একতলা থেকে বাবার ডাক। এবার ভয় ধরে। বাবা প্রচণ্ড রাগী। হয়তো লোকটা আজকের কাণ্ডকারখানা নিয়ে যা নয় তাই বলেছে। বেদম মারধোর জুটবে নিশ্চিত। কাঁপা কাঁপা পায়ে মেয়েটি যখন ড্রইংরুমে আসে, সকলে খোশগল্পে ব্যস্ত। কী হলো ব্যাপারটা? সবকিছু যখন ধাঁধার মতো ঠেকছে তখন বাবা মুখ খোলেন।

“ইনি তোমায় সাঁতার শেখাতে চান। তুমি কি রাজি?”

আচমকা প্রস্তাবে হতভম্ব হয়ে যায় মেয়েটি। তারপর খানিক লজ্জা পেয়ে মাথা নেড়ে সায় দেয়। লোকটি উঠে দাঁড়ায়। বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলতে বলতে দরজা পর্যন্ত আসে। বেরনোর আগে তার দিকে তাকিয়ে বলে— “তাহলে সামনের সোমবার থেকে তুমি আসছ।” কিছুটা থেমে—“আর হ্যাঁ, সাইকেলের হেডলাইটটা অবশ্যই সারিয়ে নিও, কেমন?”

হ্যারি গ্যালাঘার ও ফ্রেজ়ার

বারো বছরের সেই মেয়ে আর প্রশিক্ষকের যুগলবন্দিতে এরপর সাঁতারের দুনিয়ায় তুফান উঠবে। ক্রীড়াবিশ্বে প্রবাদে পরিণত হবে আটবার অলিম্পিক পদকজয়ী সাঁতারু ডন ফ্রেজ়ার আর তাঁর কোচ হ্যারি গ্যালাঘারের অটুট সম্পর্ক। সিডনির এলকিংটনের এই গল্প বলার শুরুতে উত্তর কলকাতার কমলদিঘি, সন্ধ্যার আবছায়ায় মিলিয়ে যাওয়া বিস্রস্ত চেহারার ভদ্রলোক আর ছিপছিপে গড়নের কিশোরীর কথা কেন টেনেছিলাম, তা তন্নিষ্ঠ পাঠক আশা করি ইতিমধ্যে বুঝতে পেরেছেন। যাঁরা পারেননি, তাঁদের মতি নন্দীর লেখা, ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত উপন্যাস ‘কোনি’-র পাতা আরেকবার ওল্টাতে বলব। বারুণী উপলক্ষ্যে গঙ্গায় কাঁচা আমের ছড়াছড়ি। আর তা কুড়োতে চেয়ে চণ্ডু, কান্তি, ভাদু— তিন সঙ্গী সমেত কোনির আগ্রাসী মেজাজ… উপন্যাসের গোড়ার এক স্মরণীয় দৃশ্য। গ্যালাঘারের চোখে বছর বারোর ফ্রেজ়ার ছিল দস্যি মেয়ে (‘Bossy Girl’)। স্নান করতে নেমে চশমা ছাড়া কোনওকিছু স্পষ্ট দেখতে না পাওয়ায় জনৈক বৃদ্ধের দৌলতে ‘মেয়েমদ্দানি’ কোনির কথা প্রথমবার জানতে পারে ক্ষিতীশ। ফ্রেজ়ার আর কোনি— দু'জনেই নিজেদের দলের সর্দারনি। নিম্নবিত্ত পরিবারে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠা দুই মেয়ের হাবেভাবে ফুটে ওঠে প্রতিরোধের মুখে একচুল সরে না আসার অদম্য জেদ। ক্ষিতীশের প্রথম দেখা, প্রথম ‘অস্পষ্ট’ দেখা, স্রেফ তানটুকু বেঁধে দেয়। ‘স্পষ্ট’ আলাপে ঘনীভূত হয় টেনশন। ‘অবিরাম হাঁটা প্রতিযোগিতা’ শেষে বিধ্বস্ত কোনির সঙ্গে তার কথোপকথন আরেকবার পড়া যাক—

ক্ষিতীশ হাত পাঁচেক দূরে দাঁড়িয়ে কোনিদের কথাবার্তা শুনছিল। এবার সে এগিয়ে এসে বলল, “তুমি সাঁতার শিখবে?”

মুখটা তুলল সে। কাঁচা-পাকা কদমছাঁট চুলে ভরা মাথা আর পুরু লেন্সের পিছনে জ্বলজ্বলে দু'টি চোখের দিকে একটু বিরক্তিভরেই তাকাল। তারপর আবার সে নিজের পা টিপতে লাগল।

“শিখবে সাঁতার?”

“সাঁতার আমি জানি।”

“না, জানো না।”

ঝটকা দিয়ে চুল ঝাঁকিয়ে কোনি আবার মুখ তুলল।

“আপনি জানেন?”

“হ্যাঁ জানি। আমি দেখেছি তোমায় গঙ্গায়। ও সাঁতার চলবে না। সাঁতার শেখার জিনিস।”

“যা জানি তাতেই গঙ্গা এপার-ওপার করতে পারি, শেখার আবার আছে কী?”

“অনেক কিছু শেখার আছে।”

“আমার দরকার নেই শিখে, যা জানি তাই যথেষ্ট।”

ক্ষিতীশের উপস্থিতিকে অগ্রাহ্য করে কোনি দাঁড়াল। চেঁচিয়ে ডাকল, “অ্যাই গোপলা শুনে যা।’’

এই প্রাথমিক বিরাগ ও শৈত্যের ছায়াপাত একটু আগে ফ্রেজ়ার-গ্যালাঘারের সম্পর্কের গোড়াতেও কি আমরা লক্ষ্য করিনি? এই সূত্রে আরও একটি প্রশ্ন জাগতে পারে; মতি নন্দী আবছাভাবে হলেও এই সমান্তরালতার কোনও সংকেত কি উপন্যাসে দিয়েছেন? আমরা দু'টি প্রসঙ্গের উল্লেখ করব। প্রথমত, কাহিনির সেই অংশটুকু যেখানে ক্ষিতীশ সিংহের ঘরের বর্ণনা রয়েছে:

“... শোবার ঘরের দেয়ালে ক্ষিতীশের বাবা-মা, ধ্যানমগ্ন মহাদেব, কুরুক্ষেত্রে অর্জুনের সারথি শ্রীকৃষ্ণ এবং ম্যাগাজিন থেকে কেটে বাঁধানো মেডেল গলায় ডন শোলান্ডার ও ভিকট্রি স্ট্যান্ডে দু-হাত তুলে দাঁড়ানো ডন ফ্রেজ়ারের ছবি, পাশাপাশি টাঙানো।’’

এরপর জুপিটার সুইমিং ক্লাবে ক্ষিতীশের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে ডাকা মিটিংয়ের মুহূর্ত। যেখানে ‘ট্রেনার হতে গেলে নামকরা সাঁতারু হওয়া জরুরি নয়’—মর্মে যুক্তি দেওয়ার ফাঁকে আবেগতাড়িত ক্ষিতীশ বেশ কিছু নাম পর পর জুড়ে দেয়:

“... পৃথিবীর নামকরা কোচেরা—ট্যালবট, কারলাইল, গ্যালাঘার, হেইন্স, কাউন্সিলম্যান এরা কেউ ওলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন নয়। জলে নেমে এদের কোচ করতে হয় না।”

লেখকের অবচেতনে থাকা দু'টি রক্তমাংসের চরিত্র এবং তাদের সম্পর্কের বিন্যাস এভাবে চাবিকাঠির মতো উপন্যাসের কাঠামোয় স্তরীভূত হয়ে পড়ে। ঠিক যেভাবে ভাগলপুরের ‘রঘুনন্দন হল’-এ উশকো-খুশকো চুল ও দুষ্টুমির চিহ্নভরা মুখের এক বালিকার চোখে ‘ব্যথাভরা জগৎ’ দেখতে পেয়ে বিভূতিভূষণকে ‘পথের পাঁচালী’ ‘রিকাস্ট’ করতে হয়। দুর্গার চরিত্র ছাড়াই যে-উপন্যাস লেখা হয়েছিল, চোখে-দেখা এক মেয়ের মরমি ভঙ্গিমাটুকু লেখককে নতুন করে তা সাজিয়ে লিখতে বাধ্য করে। এখানে কোনি ও ক্ষিদ্দার সম্পর্কের সঙ্গে ফ্রেজ়ার ও গ্যালাঘারের সম্পর্কের তুলনা-প্রতিতুলনা আমরা টানতে চাইছি না। তা সম্ভবও নয়৷ শুধু বলতে চাইছি: এক অজ়ি ট্রেনার ও কোচের প্রথম আলাপ এবং তার ক্রমিক বিস্তার মতি নন্দীকে কাহিনিবীজের রসদ জুগিয়েছিল নিশ্চিত। এ প্রসঙ্গে ‘তথ্য ও সত্য’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের একটি মন্তব্য যথোপযুক্ত হবে:

“চিত্রী যখন ছবি আঁকতে বসেন তখন তিনি তথ্যের খবর দেবার কাজে বসেন না। তখন তিনি তথ্যকে ততটুকু মাত্র স্বীকার করেন যতটুকুর দ্বারা তাকে উপলক্ষ ক’রে কোনো একটা সুষমার ছন্দ বিশুদ্ধ হয়ে দেখা দেয়।”

আরও পড়ুন- স্বাধীনতার পর বাঙালির চরিত্র কীভাবে পাল্টে গেল, লিখে রেখেছিলেন মতি নন্দী

মতি নন্দী ‘কোনি’ উপন্যাসে ‘সুষমার ছন্দ’-কে নির্মোহ শিল্পীর মতো সাজাতে চেয়েছেন। অস্ট্রেলিয় সভ্যতার গল্পকে মূলধন করে তৃতীয় বিশ্বের প্রেক্ষাপটে ফেললে তার সঙ্গে বর্ণবৈষম্য, লিঙ্গবৈষম্যের মতো অনুষঙ্গ জুড়ে যেতে বাধ্য। ‘Bossy Girl’ এদেশে, এ-শহরে বিনা প্রশ্নে, নিঃসঙ্কোচে, অবলীলায় ‘মেয়েমদ্দানি’ বলে সম্বোধিত হয়! এই বৈষম্যের রাজনীতি বিষয়ে ‘দায়বদ্ধ লেখক’ মতি নন্দী পুরোদস্তুর সচেতন ছিলেন। তাই কোনিকে কেন্দ্রে রেখে সমস্যাগুলিকে ‘ব্লোটর্চের মতো পুড়িয়ে পুড়িয়ে’ কাহিনির ভেতরে সেঁধিয়ে দিয়েছেন। ‘পিলসুজমার্কা সিড়িঙ্গে, কেষ্ট তুলসীর মতো রং’ কিংবা ‘কোনি যদি ফ্রক পরে নামত দেখতিস, অন্তত বিশ-পঁচিশ পেয়ে যেত। প্যান্ট শার্ট পরলে তো ওকে ছেলে দেখায়।’— মন্তব্যগুলি সিডনির ডন ফ্রেজ়ার আর উত্তর কলকাতার কনকচাঁপা পালের মধ্যে একটা আড়াআড়ি বিভাজন তৈরি করে। ‘তথ্য’ এভাবে শুধুমাত্র একটা ‘উপলক্ষ্য’ হয়ে তার দায়পূরণ করে। ‘সত্য’ হয়ে ওঠে সংগ্রাম, লড়াইয়ের জেদটুকু। উপন্যাসে না ক্ষিতীশ না কোনি— কেউ-ই ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ নয়। প্রত্যেকের সীমাবদ্ধতা আছে। আছে অগুনতি পিছুটান, অনিঃশেষ দ্বন্দ্ব৷ মতি নন্দী আধুনিক ঔপন্যাসিকের স্বধর্মপালন করে চরিত্রের সাদা আর কালোর মধ্যে লুকিয়ে থাকা ধূসর পরিমণ্ডলকে প্রাধান্য দিয়েছেন। গ্যালাঘারের প্রশিক্ষক হিসেবে নিন্দিত ও নন্দিত হওয়ার ‘তথ্য’ ক্ষিতীশের চরিত্রের ধূসর চৌহদ্দিকে অনেকখানি প্রকট করে তুলতে সাহায্য করেছে বলেও আমাদের বিশ্বাস। পেশাদারি বৃত্তে ‘দ্য কানিং ফক্স’ অভিধা পেয়েছিলেন হ্যারি গ্যালাঘার, তাঁর সুচতুর ও অভিনব ট্রেনিং টেকনিকের জন্য। প্রথাগত কৌশলকে নস্যাৎ করেছিলেন তিনি। গাড়ির টায়ার, কিকবোর্ডের মতো বেখাপ্পা জিনিসকে আকছার প্রশিক্ষণে ব্যবহার করতেন। সবচেয়ে বড় বিপ্লব এনেছিলেন মানসিক শক্তিকে কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে। ক্রমাগত ইতিবাচক বার্তালাপে সুইমারদের চাগিয়ে তুলতেন। অপ্রত্যাশিত এবং খাপছাড়াভাবে কখনও কখনও সেশন শুরু করে সাঁতারুদের আতান্তরে ফেলে তাদের মানসিক কাঠিন্যের পরীক্ষা নেওয়াও চলত পুরোদমে৷ এই সমস্ত কৌশল যেমন ‘আধুনিক’ বলে প্রশংসিত হয়েছে, তেমনই ‘চটকদার’ বলে অনেকে ছুড়েও ফেলেছে। ক্ষিতীশকে আমরা যখন কোনির ফ্রি-হ্যান্ড ব্যায়ামের জন্য ছোট পাশবালিশের মতো চটের থলেতে সের দশেক বালি ভরতে দেখি কিংবা লগা হাতে “মাথা ফাটিয়ে দোব তোর… মরে যা তুই… মরে যা, মরে যা” বলে ক্লান্ত কোনির দিকে তেড়ে যেতে দেখি (অবধারিতভাবে ‘অযান্ত্রিক’ গল্পে জগদ্দলের ভেতর বিমলের পাথর ঠেলার প্রসঙ্গ মনে পড়ে), তখন সাদা-কালোর বাইনারিটা আচমকা মুছে যায়৷ নায়কের প্রতিরূপ যদি-বা তৈরি হচ্ছিল, মুহূর্তে খান খান হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। মতি নন্দী এক অর্থে এই উপন্যাসে মূর্তিভাঙার পূজারি। যে মূর্তি কায়াহীন, শুধুই ছায়া, যা বাস্তবের মাটির বদলে শুধুমাত্র স্তবের মালা দিয়ে গাঁথা, তাকে সজ্ঞানে ছিন্নভিন্ন করতে চেয়েছেন। ‘কোনি’-র উপরিতলে জলের সংগ্রাম; অন্তরে তা মাটিরই গল্প।

লেখার শেষ পর্বে ফিরে যাব ঘরের বর্ণনায়। ডন ফ্রেজ়ারের পাশাপাশি আরেক অলিম্পিকজয়ী সাঁতারুর ছবি ক্ষিতীশের ঘরের দেয়ালে টাঙানো৷ তিনি ডন শোলান্ডার। ১৯৭১ সালে শোলান্ডার আত্মজীবনীমূলক একটি বই লেখেন। নাম ‘Deep Water’। বইয়ের শুরুর কিছু কথা এরকম:

“In a race, at the threshold of pain, you have a choice. You can back off—or you can force yourself to drive to the finish, knowing that this pain will become agony. It is right there, at the pain barrier, that the great competitors separate from the rest. Most swimmers back away from the pain; a champion pushes himself on into agony… If you can push yourself through that pain barrier into real agony, you’re a champion.”

আমাদের মনে পড়বে, কোনি যখন ক্ষিতীশের কঠোর ট্রেনিংয়ের সাঁড়াশি-চাপে পুলের জলে কাতরাচ্ছে তখন খ্যাপাটে মানুষটার মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছিল:

“...ফাইট কোনি ফাইট—মার খেয়ে ইস্পাত হয়ে উঠতে হবে। যন্ত্রণাকে বোঝ, ওটাকে কাজে লাগাতে শেখ, ওটাকে হারিয়ে দে। …কাম অন কোনি, জোর লাগা… যন্ত্রণাকে তুই বল, ‘দেখে নেব আমাকে কাঁদাতে পারিস কিনা, আমাকে ভয় দেখাতে পারিস কিনা’, বলে যা কোনি, ‘ক্ষিদ্দা তোমাকে খুন করবে। তুমি শয়তান, ছিঁড়ে খাব তোমাকে।’ কমলদিঘিকে টগবগ করে ফুটিয়ে তোল তোর রাগে।… মানুষের ক্ষমতার সীমা নেই রে… সোনার মেডেল-ফেডেল কিছু নয় রে, ওগুলো এক একটি চাকতি মাত্র। ওগুলোর মধ্যে যে কথাগুলো ঢুকে আছে সেটাই আসল—মানুষ পারে, সব পারে।”

একজন সাঁতারুর বক্তব্যধর্মী আত্মকথনকে এভাবেই একজন রূপদক্ষ সাহিত্যিক যুদ্ধজয়ের মন্ত্রে পরিণত করেন… ‘মানুষ পারে, সব পারে… ফাইট কোনি ফাইট…’।

More Articles