শিরদাঁড়া ছিল, তাই ষড়যন্ত্র করেই বাদ দেওয়া হলো ভিনেশে ফোগাটকে?

Vinesh Phogat: কেন মনে হচ্ছে ভিনেশ ফোগাট ষড়যন্ত্রের শিকার? কেন নীতা আম্বানি, কেন্দ্রীয় ক্রীড়ামন্ত্রকের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে?

স্বপ্ন ভঙ্গ হলো ভারতীয় মহিলা কুস্তিগীর, ভিনেশ ফোগাটের। স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হলো ১৪০ কোটি ভারতবাসীর। যখন শোনা গিয়েছিল, প্যারিস অলিম্পিকে বিশ্বের এক নম্বর এবং অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন কুস্তিগীরকে হারিয়ে ভিনেশ ফোগাট সেমিফাইনালে উঠেছেন, তখনই নিশ্চিত হওয়া গিয়েছিল যে, ভারতের হয়ে অন্তত ব্রোঞ্জ পদক তিনি পাবেনই। তারপরে তিনি সেই গণ্ডিও পেরিয়ে গিয়ে ফাইনালে পৌছন। সারা দেশের মানুষ তখন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছেন, প্রার্থনা করেছেন কখন ভিনেশ ফোগাট ভারতের হয়ে প্রথম সোনার পদকটি নিয়ে আসবেন। ভারতীয় সময়ে যখন ফাইনাল ম্যাচ হওয়ার কথা, তার কিছুক্ষণ আগে খবর আসে, মাত্র ১০০ গ্রাম ওজন বেশি হওয়ার কারণে, তাঁকে অলিম্পিক থেকে বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। প্রথমে অনেকেই বিশ্বাস করতে পারেননি বিষয়টা। প্রশ্ন করেছেন, কেন এই বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো ভিনেশ ফোগাটের বিরুদ্ধে। সচেতনভাবেই কি ভিনেশকে বাতিল করা হলো?

অলিম্পিকের মতো খেলার আসরে, প্রতি ক্রীড়াবিদ নিজেদের নিয়ে এতটাই সচেতন থাকেন যে, প্রতি পাঁচ-ছয় ঘণ্টায় নিজেদের ওজন মেপে দেখেন, তিনি তাঁর বিভাগের থেকে বেশি ওজনের হয়ে যাচ্ছেন কিনা। তাঁরা জলও খান মেপে, যাতে একটুও ওজন না বেড়ে যায়। ভিনেশ ফোগাট যখন দেখতে পাচ্ছিলেন তাঁর সামনে সোনা জয়ের সুযোগ রয়েছে, তিনি কি নিজের পায়ে কুড়ুল মারার মতো ভুল করতে পারেন? এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর টুইটে আরও প্রশ্ন উঠছে। তাঁর টুইট অত্যন্ত সাদামাটা! তিনি যেন মেনেই নিয়েছেন, ভিনেশ ফোগাটের বাতিল হয়ে যাওয়াকে। তিনি তাঁকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন পরের বারের জন্য কিন্তু কোথায় সেই 'বিশ্বগুরু'র মেজাজ? যেন অভিযোগ করার দরকার তাই করছেন, না করলেও ক্ষতি নেই। তাহলে কি প্রধানমন্ত্রী নিজেও চাইছিলেন, এমনই কিছু হোক? বিষয়টা সত্যিই হজম  হচ্ছে না।

আরও পড়ুন- “আলবিদা কুস্তি”, কেন চিরতরে কুস্তি ছাড়তে বাধ্য হলেন ভারতের গর্ব ভিনেশ ফোগাট?

শোনা যাচ্ছে, নিজের মাথার চুল কেটে ১০০ গ্রাম কমানোর চেষ্টা করেছিলেন ভিনেশ। সারারাত শারীরিক কসরত করেছেন এমনকী রক্তও বের করে দিয়েছেন কিছুটা, যাতে তাঁর ওজন নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থাকে। ভারতীয় অলিম্পিক সংস্থা যদি চাইত, তাহলে তারা আন্তর্জাতিক ক্রীড়া সংস্থার কাছে আরও জোরালো আবেদন করতে পারত। অন্যান্য বেশ কিছু দেশ আগে এইরকম ক্ষেত্রে, তাদের ক্রীড়াবিদদের পাশে দাঁড়িয়ে আবেদন করেছে। বাতিল হয়ে যাওয়া ক্রীড়াবিদ পদক পেয়েছেন, সেই উদাহরণ এই অলিম্পিকেই আছে। এমনকী ভারতীয় অলিম্পিক সংস্থা ফাইনালের আগে বলতেই পারত যে ভিনেশ ফোগাট অসুস্থ, তাই ফাইনালে তিনি অংশ নেবেন না। তাহলে অন্তত রুপোর পদক নিশ্চিত হতো কিন্তু এসব কিছুই করেনি তারা।

তাই সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন উঠছে, তবে কি সচেতনভাবেই ভিনেশকে বাতিল করানো হলো যাতে তিনি অলিম্পিক থেকে পদক না নিয়ে ফিরতে পারেন? কেন্দ্রীয় ক্রীড়ামন্ত্রী রাজ্যসভায় ভিনেশ ফোগাটকে বাতিল করা নিয়ে বক্তব্য রেখেছেন কিন্তু তিনি কিছু কথা উহ্য রেখেছেন। লজ্জাজনকভাবে, ভারত সরকার যে ৭০ লক্ষ টাকা যে খরচ করেছে তা তিনি সদম্ভে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু একজন ‘অপরাজিত’ ক্রীড়াবিদের জন্য তা কতটা অপমানজনক তা কি একবারও ভেবে দেখেছেন? অন্য কারও ক্ষেত্রে এই একই ঘটনা ঘটলে কি ভারতীয় অলিম্পিক সংস্থা একইরকম নির্লিপ্ত থাকতে পারত? একইরকমভাবে মন্ত্রী টাকার অঙ্ক উল্লেখ করতে পারতেন? নাকি তিনি ভিনেশ ফোগাট বলেই এই শাস্তি পেতে হলো? ভিনেশ ফোগাটের ঘটনায় বিরোধী সমস্ত রাজনৈতিক দলই নরেন্দ্র মোদি সরকারের নরম মনোভাবের জন্য রাজ্যসভা থেকে ওয়াকআউট করেছেন। বিষয়টা ক্রমশ আরও রাজনৈতিক হয়ে উঠছে। আঙুল উঠছে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক সংস্থার সদস্য, রিলায়েন্স গোষ্ঠীর কর্ণধার, মুকেশ আম্বানির স্ত্রী নীতা আম্বানির দিকেও। তিনি থাকা সত্ত্বেও কেন ভিনেশ ফোগাটের জন্য ভারত এতটুকু জোরালো সওয়াল তুলল না?

কেন মনে হচ্ছে ভিনেশ ফোগাট ষড়যন্ত্রের শিকার? কেন নীতা আম্বানি, কেন্দ্রীয় ক্রীড়ামন্ত্রকের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে? মাত্র এক বছর আগে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পদকজয়ী ভারতীয় মহিলা কুস্তিগীররা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তাঁদের পদকগুলো তাঁরা হরিদ্বারের গঙ্গায় ভাসিয়ে দেবেন, ওই পদক আর তাঁদের প্রয়োজন নেই। এই মহিলা কুস্তিগীরদের তখন একটাই দাবি ছিল, ভারতীয় কুস্তি ফেডারেশনের সভাপতি, বিজেপির সাংসদ প্রভাবশালী ব্রিজ ভূষণ শরণ সিংকে গ্রেফতার করতে হবে কারণ তিনি দীর্ঘদিন ধরে, নাবালিকা সহ ভারতীয় মহিলা কুস্তিগীরদের যৌন নির্যাতন করেছেন। সেই দাবিতে, দিল্লির যন্তরমন্তর চত্বরে তাঁরা অবস্থানও করছিলেন। যেদিন নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধন হলো, সেদিন একটি জমায়েত থেকে দেশের এই কৃতীদের দিল্লি পুলিশ টেনে হিঁচড়ে বের করে গ্রেফতার করে। সেদিনই তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন, যদি দেশেরই জন্য পদক আনার পরেও তাঁদের সঙ্গে পুলিশ এহেন আচরণ করতে পারে, তাহলে সেই পদক রাখা নিরর্থক! সেদিন ওই বিক্ষোভের সামনের সারিতে ছিলেন ভিনেশ ফোগাট, বজরং পুণিয়া, সাক্ষী মালিক সহ অন্যান্যরা। সরকার সেই আন্দোলনকে প্রথমদিন থেকেই ভালোভাবে নেয়নি। তৎকালীন কেন্দ্রীয় ক্রীড়ামন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি ব্রিজ ভূষণ শরণ সিংকে দোষী মনে করেন না।

সেদিন আন্তর্জাতিক কুস্তি ফেডারেশনের চাপে এবং রাজনৈতিক আন্দোলনের পরে ব্রিজ ভূষণ শরণ সিংকে সরিয়ে দিলেও, বিষয়টা স্বেচ্ছায়, ভালোবেসে যে করা হয়নি তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। প্রাথমিকভাবে সরকারই চায়নি, ভিনেশ ফোগাট অলিম্পিকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করুন। বহু চেষ্টা হয়েছে যাতে ভিনেশ তাঁর নিজের বিভাগে না যেতে পারেন। তাঁর নিজের ওজনের চেয়ে কম ওজনের বিভাগে জোর করে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করানো হয়েছে, যাতে সেই বিভাগে একটু বেশি ওজন হলেই ছিটকে যান তিনি। ভিনেশ নিজেও সংশয় প্রকাশ করেছিলেন, তাঁকে জলের সঙ্গে কিছু মিশিয়ে ডোপ পরীক্ষায় পজিটিভ দেখিয়ে বাতিল করা হতে পারে। তবে যাই হোক না কেন, ভিনেশ জিতে গেছেন! খেলায় বাতিল হলেও আমাদের সোনার মেয়ে হয়েই থেকে যাবেন তিনি কারণ ভিনেশের শিরদাঁড়া ছিল। যেদিন তিনি ব্রিজভূষণ শরণ সিংয়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছেন, সেদিনই তিনি জিতে গেছেন। পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে যেদিন তাঁর আওয়াজ শোনা গিয়েছিল, সেদিনই তিনি জিতে গেছেন।

আরও পড়ুন- মাত্র ১০০ গ্রাম ওজন বেশি! এক রাতেই কীভাবে অলিম্পিক বক্সিংয়ে অযোগ্য হলেন ভিনেশ?

মাত্র ১৮ বছর বয়সে ১৯৬০ সালে রোম অলিম্পিক থেকে বক্সিংয়ে নিজের দেশ আমেরিকার জন্য সোনা এনেছিলেন! তাও স্রেফ গায়ের রঙের জন্য দিনভর কথা শুনতে হতো। একদিন এই বর্ণবৈষম্য এমন মাত্রা ছাড়াল যে, এক রেস্তোঁরা তাঁকে খাবার দিতে অস্বীকার করে 'কৃষ্ণাঙ্গ' বলে! রাগে-দুঃখে-অপমানে সেদিন ১৮ বছরের এক ছেলে লুইভিলের সেকেন্ড স্ট্রিট ব্রিজের ওপর উঠে তাঁর সদ্য-জেতা অলিম্পিক স্বর্ণপদকটি ছুঁড়ে ফেলে দেয় ওহিও নদীর বুকে। ছেলেটির নাম ক্যাসিয়াস ক্লে জুনিয়র। বছর চার পরে তিনি ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন। নাম হয় মহম্মদ আলি। সারা পৃথিবীর মানুষ এখনও ওই নামেই তাঁকে চেনে। আজও বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রসঙ্গ উঠলেই মহম্মদ আলির লড়াইয়ের কথা মানুষ স্মরণ করে।

আগামীতে ভারতীয় ক্রীড়াজগতের সমস্ত মহিলা ভিনেশ ফোগাটের এই হার না মানা লড়াইকে মনে রাখবেন। হয়তো কুস্তির আখড়ায় তাঁকে আর দেখা যাবে না, তিনি অকালেই অবসর নিয়েছেন কিন্তু তাঁর লড়াই থেকে যাবে। যে সময়ে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীরা অলিম্পিকের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, সেই সময়ে তিনিও প্রস্তুত হচ্ছিলেন পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে তাঁর লড়াইতে, কুস্তির আখড়ার বাইরে। সেই লড়াই মানুষ মনে রাখবে। তিনি রাজ্যসভায় মনোনীত সদস্য হিসেবে আসবেন কিনা, তা ভিন্নতর প্রসঙ্গ কিন্তু ভিনেশ ফোগাট হয়ে উঠেছেন ‘অপরাজেয়’।

More Articles