মাসের অর্ধেক দিনই মেয়েদের ঠাঁই গোয়ালঘরে! এ কেমন অমানবিক প্রথা ভারত-নেপালে

Chhaupadi Menstrual Taboo: সন্তান প্রসবের পরেই বাজুরা অঞ্চলের এক মহিলাকে থাকতে দেওয়া হয়েছিল বাড়ি থেকে প্রায় বেশ কিছুটা দূরে এক গোয়াল ঘরে। মধ্যরাতে সদ্যোজাতকে নিয়ে চলে যায় এক শিয়াল।

কথাতেই আছে জোর যার মুলুক তার। তবে এখানে জোর কার আর মুলুক কে সে বিষয় জানতে গেলে বলতে হয় নেপালের চৌপদি প্রথার গল্প। এই প্রথা আসলে অকাল মৃত্যুরই যেন এক চাবিকাঠি। চৌপদি কী তা জানতে গেলে চলে যেতে হয় ভারতেরই প্রতিবেশী দেশ নেপালের ধর্ম সংস্কৃতির অন্দরমহলে। আজও পশ্চিম নেপালের বহু অঞ্চলে ঋতুমতী নারীকে সাময়িকভাবে অপবিত্রতার তকমা দিয়ে বাড়ি থেকে বেশ কিছুটা দূরে প্রায় ১৪ দিনের জন্য থাকার জায়গা দেওয়া হয়। কখনও গোয়ালঘরে অথবা কখনও কোনও এক ছোট্ট কুটিরে। মনে করা হয়, ঋতুকালীন অবস্থায় কোনও মহিলা যদি ঘরে প্রবেশ করে অথবা কোনও কিছু স্পর্শ করে তবে তা অপবিত্র হয়ে যায়। এমনকী ক্ষতিও হতে পারে প্রচুর মানুষের।

এই প্রসঙ্গে যে কথাটি একেবারেই না বললে নয় তা হলো, চৌপদি সমাজের চাপে তৈরি করা কোনও রীতি বা প্রথা নয় বরং হিন্দু ধর্মেরই একটি পরম্পরা। উল্লেখ্য, চৌপদি প্রথা মানতে গিয়ে নেপালের বহু ঋতুবতী কিশোরী ও তরুণী মৃত্যুর শিকার হচ্ছে। ২০০৫ সালে সরকার কর্তৃক চৌপদি প্রথায় দাঁড়ি টানা হলেও পশ্চিম নেপালের প্রায় ৭০ শতাংশ মহিলাকে আজও বাধ্য করা হয় এই রীতি অনুশীলন করতে।

২০১৫ সালে মানবাধিকার মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, নেপালের মধ্য-পশ্চিম অঞ্চলে ১৫-৪৯ বছর বয়সী মেয়েদের অর্ধেকই চৌপদি প্রথা পালন করে। কখনও বা সামাজিক চাপে আবার কখনও স্বেচ্ছায়। আর এই প্রথা মানতে গিয়েই মাসের অর্ধেকটা সময় স্কুলে যাওয়া হয় না বহু কিশোরীর। যার ফলে তাঁরা প্রাপ্য শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিতই থেকে যায়। যেকোনও সামাজিক প্রথা, নিয়মের মধ্যে অনেকক্ষেত্রেই শ্বাস রোধ হয় বহু মৌলিক অধিকারের। চৌপদির ক্ষেত্রেও এর অন্যথা হয়নি। অস্পৃশ্যতা, বৈষম্য, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের অধিকার লঙ্ঘন হয়েছে প্রায়শই।

আরও পড়ুন- তিলোত্তমা কলকাতাকে নাকি বলা হত ‘ব্ল্যাক টাউন’! নেপথ্যে কোন কারণ

অন্ধবিশ্বাসের বিশাল পাঁচিল পেরিয়ে আসা সহজ নয় এই কথা যেমন সত্য তেমনই শিক্ষার আলো কিছুটা অন্ধকার দূর করতে পারে এ কথাও এড়িয়ে চলা যায় না। যতদিন পর্যন্ত সাধারণ মানুষ এই প্রথা ভেঙে বেরিয়ে আসতে পারবে শুধুমাত্র সরকারি বেসরকারি উদ্যোগ মৃত্যু থামাতে পারবে না। সুতরাং বলা বাহুল্য, সরকারি উদ্যোগ প্রান্তেই রয়ে গেছে, স্পর্শ করতে পারেনি অধিকাংশ নারীকে এবং তাঁদের পরিবারকে।

চৌপদির প্রভাব নারীদের মানসিক এবং শারীরিক দুই ভাবেই অসুস্থ করে তুলছে। একদিকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার ভয়, অন্যদিকে মৃত্যু যন্ত্রণা। কখনও রাতের অন্ধকারে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে আবার কখনও মৃত্যু হয়েছে সাপের কামড়ে অথবা আগুনে পুড়ে।

১৮ বছরের তুলসি শাহি গোয়াল ঘরে থাকাকালীন সাপের কামড়ে প্রাণ হারায়। সময়ের মধ্যে তাঁকে স্থানীয় হাসপাতলে নিয়ে গেলেও পর্যাপ্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা না থাকায় মৃত্যু হয় কিশোরীর।

১৫ বছরের কিশোরী রোশনী তিরুয়াও শীতের রাতে গোয়াল ঘরে ঠান্ডার হাত থেকে বাঁচতে আগুন জ্বালালে ধোঁয়ায় দমবন্ধ হয়ে মারা যায়।

সন্তান প্রসবের পরেই বাজুরা অঞ্চলের এক মহিলাকে থাকতে দেওয়া হয়েছিল বাড়ি থেকে প্রায় বেশ কিছুটা দূরে এক গোয়াল ঘরে। মধ্যরাতে সদ্যোজাতকে নিয়ে চলে যায় এক শিয়াল।

প্রথা অনুসারে, মহিলাদের মাসের এই সময় দুধ বা ঘি খাওয়া উচিত নয় যা তাঁদের পিরিয়ডের সময় পুষ্টিকর খাবার থেকে বঞ্চিত করে। তাঁরা শীতের সময় কম্বল ব্যবহার করতে পারেন না, শুধুমাত্র অনুমোদিত থাকে ছোট একটি পাটি। স্কুলে যাওয়ার মতো দৈনন্দিন কাজ পালনেও সীমাবদ্ধতা তৈরি করা হয় এবং কুঠুরিসম এক অনিরাপত্তার মধ্যে থাকতে বাধ্য করা হয়।

যেহেতু ঋতুস্রাবের সময় মহিলাদের ঘরের মধ্যে থাকতে এবং পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাদ্যের অনুমতি দেওয়া হয় না, এই অবস্থায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাঁরা ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া এবং শ্বাসযন্ত্রের রোগ সহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পড়েন।

লেখক ও সমাজকর্মী রাধা পাউডেল এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “শুধু চৌ শেড ধ্বংস করলেই এই প্রথা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না। এমন কিছু পদ্ধতি নেওয়া উচিত যা পবিত্র এবং অপবিত্রের ধারণা এবং কুসংস্কারকে উপড়ে ফেলতে সাহায্য করবে।”

যে কোনও কুসংস্কারকে নির্মূল করতে প্রয়োজন শিক্ষা ও সচেতনতা গুরুত্বপূর্ণ। আছাম, বাজুরা, দোটি এবং বাঝাংয়ের মতো জেলাগুলিতে দরিদ্রদের হার সব থেকে বেশি। সাক্ষরতার হারও জাতীয় গড় থেকে কম৷ আছামে নারী শিক্ষার হার ৩৭ শতাংশ। বাজুরায় তা ২২ শতাংশ। অনেকেই মনে করেন, শিক্ষার অভাবেই তাঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অন্ধবিশ্বাস অনুসরণ করে চলেছে।

আরও পড়ুন- ব্রিটেনের ইতিহাসে প্রথমবার! মাত্র দু’মাসের মধ্যে কেন তিনবার বদল হল প্রধানমন্ত্রীর

সরকারি ও বেসরকারি পদক্ষেপ

বিপুল সংখ্যক মৃত্যুর পরিপ্রেক্ষিতে, নেপালের সর্বোচ্চ আদালত ২০০৫ সালের নির্দেশিত আইন অনুযায়ী জানায়, “যদি কাউকে চৌ প্রথা মানতে বাধ্য করা হয় সেক্ষেত্রে শাস্তি হিসেবে তিন মাসের জেল অথবা ৩০০০ টাকা জরিমানা প্রদান করা হবে। সরকারি, বেসরকারি ও সামাজিক সংগঠনের উদ্যোগে চৌপদি মুক্ত অভিযানের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে নেপালের বিভিন্ন অঞ্চলে। অনেকে জায়গায় চৌ শেড ভেঙে ফেলা হয়েছে এবং গ্রামগুলিকে ‘চৌপদি মুক্ত’ হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে।

চৌ প্রথা বা নির্বাসন প্রথা ভারতের অনেক রাজ্যেই প্রচলিত। মহারাষ্ট্র, ছত্তিশগড়, অন্ধ্রপ্রদেশ এবং উড়িষ্যার গোন্ড এবং মাদিয়ার মতো উপজাতিদের মধ্যে এই রীতি মেনে চলার প্রচলন দেখা যায়। তামিলনাড়ুতেও চৌপ্রথার অনুশীলন রয়েছে বলে জানা গেছে। ভারতবর্ষে স্থানীয় ভাষায় যাকে ‘কুর্মা ঘর’ বা ‘গাওকার’ বলা হয়। এই বাথরুমবিহীন খুপরিগুলিতে কোনও মৌলিক সুবিধা নেই। যা আছে তা হলো সামাজিক বৈষম্য। তবে নেপাল, ভারতের মতোন দেশগুলি সামাজিক প্রত্যাশার চাপ পেরিয়ে কবে সমৃদ্ধির পথে হাঁটবে সেটাই দেখার।

 

More Articles