পৃথিবীর সবচেয়ে কমবয়সি সিরিয়াল কিলার আছে ভারতেই! যে নৃশংসতায় হার মানবে সিনেমা

Indian Serial Killers: ভারতের কিছু কুখ্যাত সিরিয়াল কিলারের কথা শুনলে আত্মারাম খাঁচাছাড়া হতে বাধ্য।

We serial killers are your sons, we are your husbands, we are everywhere. And there will be more of your children dead tomorrow.

কুখ্যাত সিরিয়াল কিলার টেড বান্ডি-র উক্তি ছিল এটি। সিরিয়াল কিলারদের নিয়ে বিস্ময়ের শেষ হবে না কখনওই। এদের নৃশংসতা যতবার প্রকাশ পেয়েছে, পৃথিবী কেঁপে উঠেছে। রক্ত, মৃতদেহ এসব যেন সিরিয়াল কিলারের দুনিয়ায় নেহাত খেলার সামগ্রী। মৃতদেহ কেটে টুকরো টুকরো করা থেকে তাদের কেটে খাওয়া- সিরিয়াল কিলারদের কর্মকাণ্ড সবসময়ই শিউরে ওঠার মতো।

মনোবিজ্ঞানীরা বলেছেন, ‘সব সাইকোপ্যাথ সিরিয়াল কিলার না হলেও সব সিরিয়াল কিলার সাইকোপ্যাথ।' বেশিরভাগ সিরিয়াল কিলারের জবানবন্দিতে বিন্দুমাত্র অনুতাপের ছোঁয়া পাওয়া যায়নি, বরং তারা যে অপরাধ করে কতটা খুশি, তাই বারংবার প্রকাশ করেছে তারা। মস্তিস্কের কতটা বিকৃতি বা একজন মানুষের অন্ধকার দিক কতটা ভয়ংকর হলে কেউ সিরিয়াল কিলার হতে পারে, তা অকল্পনীয়। সম্প্রতি ভারতে ঘটে যাওয়া আফতাব আর শ্রদ্ধার ঘটনা ভারতের অপ‍রাধের নজিরে এক অন্য নজির স্থাপন করেছে।

সিরিয়াল কিলার নিয়ে আমরা যতই পাশ্চাত্য সংস্কৃতিকে পুজো করি না কেন, বা ওদেশের থ্রিলার সিরিজ-সিনেমাকে প্রাধান্য দিই না কেন, স্বয়ং ভারতই সিরিয়াল কিলারদের টক্করে যে-কোনও দেশকে পেছনে ফেলতে সক্ষম। মাত্র আট বছর বয়সি, পৃথিবীর সবথেকে ছোট সিরিয়াল কিলারও কিন্তু এই দেশেরই। কেউ খুন করেছে টাকার লোভে, কেউ বা মানসিক শান্তি নিতে আবার কেউ বা অন্য খুনির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় খুন করেছে একের পর এক, ভারতের এরম কিছু কুখ্যাত সিরিয়াল কিলারের কথা শুনলে আত্মারাম খাঁচাছাড়া হতে বাধ্য।

আরও পড়ুন: ‘ভালো লাগে, তাই মারি’, আট বছর বয়সি সেই সিরিয়াল কিলারের গল্প শুনলে শিউরে উঠবেন

চার্লস শোভরাজ: নিজের অপরাধমূলক জীবন বেচেছিল কয়েক কোটি টাকায়
বিখ্যাত এই সিরিয়াল কিলার শুধু খুন করেই থেমে থাকেননি, বরং নিজের অপরাধমূলক জীবনকে বসিয়েছিল সেলিব্রিটির আসনে। চার্লস শোভরাজ অনেক ছোট থেকেই চুরিবিদ্যায় নিজের হাত পাকিয়েছিল। ১৯৪৪ সালে ভিয়েতনামে জন্মগ্রহণ করা চার্লস ছিলেন ভারতীয় বংশোদ্ভুত। ছয়ের দশক থেকে চার্লসের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড শুরু হয়। খাবারের মধ্যে চড়া ড্রাগ মিশিয়ে সাধারণ মানুষকে লুট করাই ছিল শোভরাজের স্টাইল। তবে তার শিকারের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল বিদেশি মহিলা। ভিয়েতমিন, ফ্রেঞ্চ ও ইংরেজিতে সাবলীল চার্লস যে-কোনও মেয়ের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠলে চার্লস সুযোগ বুঝে তাদের লুট করে খুন করত। কিন্তু এত বড় একজন অপরাধী হয়েও জেলে সাজা ভোগ করা তো দূর অস্ত, বরং তারকাদের জীবন উপভোগ করত শোভরাজ।

শোভরাজের চারটি জীবনী, তাকে নিয়ে তিনটি তথ্যচিত্র রয়েছে। ‘ম‍্যায় অর চার্লস’ নামে একটি ভারতীয় কাহিনিচিত্র এবং নেটফ্লিক্সের সিরিজ ‘দ্য সার্পেন্ট'-এর বিষয়ও তিনি। চার্লস নিজের জীবনের স্বত্ব ১৫ মিলিয়নের বেশি মার্কিন ডলারে বিক্রি পর্যন্ত করেছিলেন। সাজা চলাকালীন দুই থেকে তিনবার পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে পালালেও বর্তমানে চার্লস শোভরাজ নেপালের জেলে যাবজ্জীবন সাজা কাটাচ্ছে।

সায়ানাইড মোহন: প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক থেকে সিরিয়াল কিলার
সায়ানাইড মোহন এমন একজন সিরিয়াল কিলার ছিল যে নিজের কেস পর্যন্ত লড়েছিল নিজে। জেলে থেকে আইনের বই পড়ে কেস লড়তেন তিনি। ২০০৪ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে প্রায় কুড়িটিরও বেশি মহিলার নির্মমভাবে হত্যার পিছনে অন্যতম কাণ্ডারি এই সায়ানাইড মোহন ওরফে মোহন কুমার। ২০০৯, ১৭ জুন কর্নাটকের বেন্তাল গ্রামে অনিথা মুল্যা নেমে এক মেয়ের মিসিং ডায়েরি জমা পড়লে ধীরে ধীরে মোহনের পর্দা ফাঁস হতে থাকে। মোহন তার জীবন প্রাথমিক শিক্ষক হিসেবে শুরু করলেও অবশেষে নিজেকে সিরিয়াল কিলিং-এর সঙ্গে যুক্তও করে নেয়। মোহনের টার্গেট ছিল অবিবাহিত বা ডিভোর্সি মহিলারা। বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের সঙ্গে সহবাস করে মোহন তাদেরকে গর্ভনিরোধক বড়ি খেতে বাধ্য করত কিন্তু বাস্তবে তা হতো সায়ানাইডের। শিকার সায়ানাইড খেয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লে মোহন মেয়েগুলোর যাবতীয় টাকাকড়ি-গয়না লুট করে নিত এবং ফেরার হতো। এইভাবে টানা কয়েকবছর ধরে মোহনের খুনের এই ধারাবাহিকতা বজায় ছিল। অবশেষে ২০১৩ ডিসেম্বরে মোহনকে ফাঁসির নির্দেশ দেয় হাই কোর্ট।

 

অমরজিত সাদা: পৃথিবীর সবথেকে ছোট সিরিয়াল কিলার?
বয়স মাত্র আট, কিন্তু খুনের সংখ্যা ছিল তিন। অমরজিতের শিকার ছিল ছয় বছরের কমবয়সি বাচ্চা মেয়েরা, এমনকী, যার মধ্যে ছিল অমরজিতের নিজের বোনও। অমরজিত এমন একজন সিরিয়াল কিলার ছিল, যে ধরা পড়ার পর পুলিশের যাবতীয় প্রশ্নের উত্তরে ভয় পাওয়া তো দূরের কথা, প্রত্যেকটি প্রশ্নের দিয়েছিল হেসে। ১৯৮৮ সালে বিহারের মুশহাহার গ্রামে জন্ম হয় অমরজিতের। শুধু নিজের বোনই নয়, নিজের কাকাতো বোনও ছিল অমরজিতের শিকার। পুলিশের অনুমান অনুযায়ী প্রথম দু'টি খুনের কথা অমরজিতের বাড়ির লোক জানতে পারলেও তা ধামাচাপা দিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু ২০০৭ সালে অমরজিতের শেষ খুনটি প্রকাশ পেলে তা সবাইকে হতবাক করে দেয়। অমরজিতের শেষ শিকার ছিল তারই প্রতিবেশী ছয় মাসের একটি বাচ্চা মেয়ে খুশবু।

স্থানীয় পুলিশ খুশবুর নিখোঁজ হওয়া নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করলে বুঝতে পারে, যাবতীয় অভিযোগের তীর যাচ্ছে অমরজিতের দিকেই। কিন্তু মাত্র আট বছর বয়সে কোনও বাচ্চা কী করে তিন জনকে খুন করতে পারে, তা হজম হতেই পুলিশের লেগে যায় কয়েকদিন, পরে তারা আরও গভীরভাবে অনুসন্ধান শুরু করলে বোঝে, অন্য কেউ না, মাত্র আট বছর বয়সি অমরজিত সাদা-ই এই খুনগুলির পিছনের মাস্টারমাইন্ড।

সায়ানাইড মল্লিকা: ভারতের প্রথম মহিলা হত্যাকারী
সিরিয়াল কিলার মানেই যে সবসময়ই সে পুরুষ হবে,  সেই মিথ ভারতে ভেঙেছিল সেই উনিশ শতকে, তাও এক বাঙালি মহিলা ত্রৈলোক‍্যর হাত ধরে। বলা হয়, ভারতের প্রথম সিরিয়াল কিলার ত্রৈলোক‍্যই। কে ডি কেপ্পাম্মা ওরফে সায়ানাইড মল্লিকাও এই পথের অনুসারী। নিজের জীবনকে প্রাচুর্যের চূড়ায় বসাতে চাওয়া কেপ্পাম্মা অজান্তেই জড়িয়ে পড়েছিল খুনের সঙ্গে। কেপ্পাম্মা বেঙ্গালুরুর বিভিন্ন মন্দিরে ঘুরে বেড়াত এবং সাধারণত মন্দিরে আসা মনোকষ্টে ভোগা মহিলাদের শিকার করতেন। বিভিন্ন পুজো-আচ্চার মাধ্যমে তাদের জীবনে শান্তি এনে দেবে, এই টোপ দেখিয়ে কেপ্পাম্মা তাদের খুন করত। কেপ্পাম্মা তাদেরকে এও বলে দিত যে, পুজোর সময় যেন তারা সবথেকে দামী শাড়ি-গয়না ও টাকাকড়ি নিয়ে আসে, না হলে পুজোর উদ্দেশ্য সফল হবে না। এবং পরে পুজো চলাকালীন তাদেরকে শান্তির জল হিসেবে সায়ানাইড-মিশ্রিত জল খাইয়ে খুন করে তাদের লুট করত মল্লিকা।

কেপ্পাম্মা প্রথম খুনটি ১৯৯৯ সালে করে। এবং প্রথম খুনের পর কেপ্পাম্মা প্রায় সাত বছরের জন্য গা ঢাকা দেয় ও ফিরে এসে পুনরায় নতুন উদ্যমে সিরিয়াল কিলিং শুরু করলে ২০০৮ সালে কেপ্পাম্মা পুলিশের জালে ধরা দেয়।

নিঠারি হত্যাকাণ্ড: নৃশংসতার চরম পর্যায়
ভারতের হত্যাকাণ্ডের মধ্যে অন্যতম নৃশংস ও চর্চিত সিরিয়াল কিলিং-এর কেস ছিল এটি। অপহরণ, খুন, ধর্ষণ, নরমাংস ভক্ষণ এমনকী, মৃতদেহকে ধর্ষন করার মতো মারাত্মক হিংসাত্মক ঘটনা সারা ভারতকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। ২০০৫ থেকে ২০০৬ সালে হঠাৎ করেই নয়ডার নিঠারি গ্রাম থেকে শিশুরা নিখোঁজ হতে শুরু করে এবং তা চরম পর্যায় পৌঁছলে পুলিশ তদন্তে নামতে বাধ্য হয়। যে দুই অপরাধীর নাম সামনে আসে, তারা হলো মনিন্দর সিং পাণ্ডে ও সুরিন্দর কলি। ঘটনাটি তখন নজরে আসে, যখন মনিন্দরের বাড়ির পিছন থেকে প্রায় সতেরোটি নরকঙ্কাল উদ্ধার হয়। ঘটনার ভয়াবহতা এতটাই তীব্র ছিল যে, তা অনেকদিন ভারতীয় খবরের শিরোনাম দখল করে ছিল। অবশেষে ২০১৭ সালে দু'জনকেই মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয় হাই কোর্ট।

 

ঠগি বেহরাম: প্রাচীন ভারতের অন্যতম দস্যু
ভারতীয় সিরিয়াল কিলারদের পথিকৃৎ হলেন কুখ্যাত এই ঠগি দস্যু ঠগ বেহরাম, যিনি সঙ্গে সঙ্গেই গিনেস বুক অফ ওয়াল্ড রেকর্ডও ধারণ করেন সবথেকে বেশি খুন করার জন্য। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরিয়েছিল এই ঠগি দস্যু। ১৭৯০ থেকে ১৮৪০ সালের মধ্যে ন'শো জনেরও ওপর সাধারণ মানুষকে গলায় রুমাল দিয়ে পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ খুন করেছিল সে। শুধু তাই নয়, খুনের পর তাদের মাথা থেঁতলে আনন্দ নিত ও সর্বশ্য লুট করে চম্পট দিত সে। ১৯৪০ সালে কোম্পানির হাতে ধরা পড়লে ঠগি বেহরামের ফাঁসি হয়।

ভারতে ব্রিটিশ শাসন অনেকদিন আগেই গেছে। সিরিয়াল কিলিং-এরও পদ্ধতিতে এসেছে নতুন স্টাইল। কিন্তু ঠগি বেহরামের মৃত্যুর এত শতক পরেও ভারতীর অপরাধীর ইতিহাসে সে লজ্জার ও বিস্ময়ের নিদর্শন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

More Articles