ইডি-র হাতে 'কালীঘাটের কাকু'র কণ্ঠ-রিপোর্ট, কীভাবে মেলানো হল ভয়েস ক্লিপ?

Sujay Krishna Bhadra: রাত পোহালেই লোকসভার ভোট। সেসময় তৃণমূলের অস্বস্তি বাড়িয়ে কালীঘাটের কাকুর গলা রহস্যের কিনারা।

গলা দিয়ে যায় চেনা। এবার সেই চেনা গলাই ভোটের আগে বিপাক বাড়াল তৃণমূলের। একের পর এক দুর্নীতি এমনিতেই গলায় কাঁটার মতো বিঁধে রয়েছে ঘাসফুল শিবিরেই। রাত পোহালেই লোকসভার ভোট। সেসময় অস্বস্তি বাড়িয়ে কালীঘাটের কাকুর গলা রহস্যের কিনারা করে ফেলল তদন্তকারী দল। বৃহস্পতিবারই 'কালীঘাটের কাকু' ওরফে সুজয়কৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠস্বরের ফরেন্সিক পরীক্ষার রিপোর্ট হাতে এসেছে ইডির। এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টোরেটের তরফ থেকে সরকারি ভাবে কিছু জানানো না হলেও সেই রিপোর্ট ইতিবাচক বলেই কোনও কোনও সূত্রের খবর।

নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় নাম জড়িয়ে গ্রেফতার হয়েছিলেন সুজয়কৃষ্ণ ভদ্র ওরফে কালীঘাটের কাকু। বেহালায় জন্ম, বেড়ে ওঠা। কাজের জায়গা নিউ আলিপুরে। সেখান থেকে কীভাবে হয়ে উঠলেন কালীঘাটের কাকু তার হালহদিস জানে না প্রায় কেউই। কংগ্রেস থেকে তৃণমূলে পা রাখার পর তৃণমূল নেতা কুন্তল ঘোষ নাকি ডাকতেন কাকু বলে। সেই থেকেই হয়ে গেল কালীঘাটের কাকু। টালির ঘর, ছোট্ট মুদির দোকান থেকে শুরু করে নিয়োগ দুর্নীতির অন্যতম মাথা হয়ে ওঠার নেপথ্যে রয়েছে তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক কেরিয়ার। শুধু নিয়োগ-দুর্নীতিই নয়, কয়লা মামলাতেও ডাক পেয়েছিলেন সুজয়কৃষ্ণ।

আরও পড়ুন: শুধুই ‘কালীঘাটের কাকু’! এসএসকেএমের ছত্রছায়ায় আর কোন কোন প্রভাবশালী?

নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় ইডির হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর থেকেই নানা অসুস্থতার টালবাহানায় হাসপাতালেই ছিলেন সুজয়কৃষ্ণ। মাঝে একটি বেসরকারি হাসপাতালে হৃদ্‌যন্ত্রের অস্ত্রোপচারও হয় সুজয়কৃষ্ণের। তাঁকে হেফাজতে নিতে চেয়ে বার বার ইডির চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল। তাঁর কণ্ঠস্বরের নমুনা সংগ্রহের জন্যও কম কালঘাম ছোটেনি ইডির। একাধিক বার নমুনা সংগ্রহের চেষ্টা করলেও এসএসকেএম হাসপাতালের তরফে আসে বারবার বাধা। গত বছর ডিসেম্বরের শুরুতেও জোকা ইএসআই হাসপাতালের অ্যাম্বুল্যান্স নমুনা সংগ্রহের কাজে গিয়েও ফিরে আসতে বাধ্য হয়। অবশেষে গত জানুয়ারি মাসে বাধ্য় হন সুজয়কৃষ্ণ নমুনা দিতে।

সুজয়কৃষ্ণ ভদ্রের বাড়িতে ইডি প্রথম যেদিন যায়, সেদিনই ইডির অন্য আরেকটি দল গিয়েছিল বিষ্ণুপুর থানায় কর্মরত সিভিক ভলিন্টিয়ার রাহুল বেরার বাড়িতে। ইডি রাহুল বেরার ফোনটি বাজেয়াপ্ত করে। জানা যায় 'কাকু' সুজয়কৃষ্ণ ভদ্রের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ তিনি। ইডি জানিয়েছিল, সিভিক ভলান্টিয়ার রাহুল বেরার সঙ্গে একজনের মোবাইলে কথোপকথনের ফাইল ইডির হাতে আসে। ওই কথোপকথনের অন্য প্রান্তে থাকা ব্যক্তিটি হলেন সুজয়কৃষ্ণ ভদ্র, দাবি ইডির। কী কথোপকথন ছিল যার জন্য এত উদ্বিগ্ন ইডি? ইডি জানাচ্ছে, ওই ফোনের অডিওতে শোনা গিয়েছে, রাহুল বেরাকে মোবাইলে থাকা শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত সব তথ্য মুছে ফেলতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কে নির্দেশ দিয়েছেন? কালীঘাটের কাকু? ‘কাকু’-ই নেপথ্যে কিনা তা প্রমাণ করতেই কণ্ঠস্বরের নমুনা প্রয়োজন ছিল ইডির।

বারবার সুজয়কৃষ্ণের কণ্ঠস্বর পরীক্ষায় বাধা দেওয়ার ব্যাপারে প্রশ্নের মুখে পড়ে এসএসকেএম কর্তৃপক্ষ। সেই মামলার জল গড়ায় হাইকোর্ট পর্যন্ত। হাইকোর্টের নির্দেশেই জানুয়ারির গোড়ায় কাকুর কণ্ঠস্বরের নমুনা সংগ্রহ করে ফরেন্সিকে পাঠানো হয়। গত ৩ জানুয়ারি গভীর রাতে মুখ খোলেন সুজয়কৃষ্ণ। জানা গিয়েছিল, বারবার তিনটি বাক্যই নাকি সুজয়কৃষ্ণকে দিয়ে বলানো হয়েছে। কী সেগুলো? 'আপনার নাম কী?', 'আপনার স্ত্রীর নাম কী?' এবং 'আমার সাহেবকে কেউ ছুঁতে পারবে না'। সুজয়কৃষ্ণের বলা সেসব কথা নমুনা হিসেবে সংগ্রহ করা হয়।

সহজে মুখ খোলানো যায়নি সুজয়কৃষ্ণকে দিয়ে। প্রায় রাত কাবার হয়ে যায় সেই নমুনা সংগ্রহের কাজে। অবশেষে সেই পরীক্ষার ফল হাতে এল ইডি-র। নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় গত বছর মে মাসে গ্রেফতার হন সুজয়কৃষ্ণ। জানা যায়, তিনি অভিষেকের পারিবারিক সংস্থা লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসের পদস্থ কর্তা ছিলেন। এই দুর্নীতিতে বেআইনি আর্থিক লেনদেনের প্রশ্নে জড়িয়ে যায় এই সংস্থার নাম। মামলায় ধৃত তৃণমূলের প্রাক্তন যুবনেতা কুন্তল ঘোষের একটি চিঠির সূত্রে কলকাতা হাইকোর্টের তৎকালীন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় অভিষেককে জিজ্ঞাসাবাদের নির্দেশ দেন। ইডি এবং সিবিআই একাধিকবার সুজয়কৃষ্ণকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। পরে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমার সাহেবকে কেউ ছুঁতে পারবে না। তাঁর কাছে পৌঁছতে হলে আমার মাধ্যমে যেতে হবে।

আরও পড়ুন: তাঁর কণ্ঠস্বরের খোঁজে হন্যে ইডি! কীভাবে ‘কালীঘাটের কাকু’ হলেন বেহালার সুজয়কৃষ্ণ?

দীর্ঘদিন ধরেই টালবাহানা চলছিল এই রিপোর্ট নিয়ে। বারবার চেয়েও তা হাতে পাননি ইডির তদন্তকারীরা। কলকাতা হাইকোর্টের প্রশ্নের মুখেও পড়তে হয়েছিল ইডিকে। পরবর্তীকালে রিপোর্ট চেয়ে সেন্ট্রাল ফরেন্সিক ল্যাবে চিঠি পাঠায় ইডি। অবশেষে বৃহস্পতিবার মুখবন্ধ খামে ওই নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে ইডি-র। সূত্রের খবর, আগামী সোমবার ইডি তা আদালতে পেশ করতে পারে। এই রিপোর্ট কি ভোটের মুখে নিয়োগ দুর্নীতি মামলার উপর থেকে তুলে দিতে চলেছে বিরাট বড় পর্দা। সুজয়কৃষ্ণের এই রিপোর্ট ভোটের বাজারে কতটা বিপদে ফেলতে চলেছে ঘাসফুল শিবিরকে! থাকছে প্রশ্ন।

More Articles