রোজের তালিকা থেকে বাদ দিচ্ছেন এই বিশেষ খাবার? অবসাদের কারণ ডেকে আনছেন নিজেই

Depression: আমরা জীবনের কোনও সময়ে অবসাদের শিকার হব কিনা তা কিন্তু অনেকটাই থাকে আমাদের শরীরে থাকা জিনের নিয়ন্ত্রণে।

দীর্ঘদিন ধরে যারা অবসাদে ভুগছেন, তাদের মধ্যে বেশিরভাগেরই কার্বোহাইড্রেট-সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার প্রবণতা রয়েছে। স্ট্রেসের শিকার হওয়ার পরেও আমরা "কম্ফোর্ট ফুড" হিসেবে যেগুলোকে বেছে নিয়ে থাকি, তাদের বেশিরভাগই কার্বোহাইড্রেট-সমৃদ্ধ। কিন্তু কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ খাবার অতিরিক্ত খেলে কী কী সমস্যা হতে পারে সে আমাদের সবারই প্রায় জানা। স্থূলতা থেকে শুরু করে ডায়বেটিস টাইপ টু, সবই পড়ছে সেই সমস্যার তালিকায়। কিন্তু তারই মাঝে নেচারের 'হিউম্যান বিহেভিয়ার' জার্নালে সাম্প্রতিক কালে প্রকাশিত এক গবেষণা সাড়া ফেলেছে। সেই গবেষণাই বলছে, খাদ্যতালিকার কার্বোহাইড্রেট-সমৃদ্ধ খাবার অপর্যাপ্ত হলে বা নিত্যদিনের ডায়েটে কার্বোহাইড্রেট একেবারেই বাদ দিলে, বাড়তে পারে মেজর ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডারের
মতো সমস্যা।

কার্বোহাইড্রেটের অনেক প্রকারভেদ রয়েছে। রিফাইনড কার্বোহাইড্রেট বা চিনিকে ক্ষতিকর কার্বোহাইড্রেটের তালিকায় ফেলা যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে এই ধরনের কার্বোহাইড্রেটে শরীরের নানান রকম অসুখ দেখা যেতে পারে। অবসাদগ্রস্তদের মানসিক অবস্থা আরই খারাপ হতে পারে, এই ধরনের কার্বোহাইড্রেট গ্রহণে। আবার অন্যদিকে ফাইবার-সমৃদ্ধ কার্বোহাইড্রেট এবং অন্যান্য কমপ্লেক্স কার্বোহাইড্রেট শরীরের পক্ষে ভালো। ফাইবার-সমৃদ্ধ খাবারের তালিকায় পড়ছে বিভিন্ন ধরনের ফল ও সবজি, ডালজাতীয় খাবার, গোটা শস্য, বাদাম প্রভৃতি। অন্যান্য কমপ্লেক্স কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ খাবারের মধ্যে পড়ছে ওটস, ভুট্টা, গম, ভাত, ইত্যাদি। দেখা যায়, যাঁরা কিটো-ডায়েট করেন তাঁরা কার্বোহাইড্রেট সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলেন। তবে কোন ধরনের কার্বোহাইড্রেট এড়িয়ে গেলে, ডিপ্রেশনের আশঙ্কা বাড়তে পারে, তা আলাদা করে গবেষকরা এই গবেষণায় জানাননি।

কার্বোহাইড্রেট-সমৃদ্ধ খাবার এড়িয়ে গেলে কেনই বা এরকম সমস্যা দেখা যেতে পারে, আসা যাক সেই প্রসঙ্গে। গবেষকরা এর নেপথ্যে বেশ কিছু 'হাইপোথিসিস' বা অনুমানের কথা জানিয়েছেন। যার মধ্যে প্রথমটি হল, "সেরোটোনিন হাইপোথেসিস অব ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশন"। সেরোটোনিন
হ্যাপি হরমোনগুলির মধ্যে একটি। আমাদের মেজাজ ভালো থাকার পেছনে অন্যান্য একাধিক হরমোন ও নিউরোট্রান্সমিটারের পাশাপাশি সেরোটোনিন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

আরও পড়ুন- কষ্ট ভুলতে গিয়ে আরও অবসাদ! ডিপ্রেশনের রোগী করে তুলতে পারে মদই?

সেরোটোনিনের ক্ষরণ ও কাজে বিঘ্ন ঘটলে আমাদের মেজাজে নানান রকম সমস্যা দেখা যেতে পারে। সেরোটোনিনের অপর্যাপ্ত ক্ষরণকে ডিপ্রেশন ও মেজর ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডারের একটি কারণ হিসেবে ধরা হয়। দেখা যাচ্ছে, মস্তিষ্কে সেরোটোনিনের উৎপাদনকে পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করে শরীরে সরবরাহ হওয়া কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ। সেরোটোনিনের ক্ষরণের জন্যে মস্তিষ্কে ট্রিপ্টোফ্যানের মতো অ্যামাইনো অ্যাসিডের সরবরাহ অপরিহার্য। দৈনন্দিন খাবারের সঙ্গে থাকা ট্রিপ্টোফ্যান রক্তে এসে মেশে। আবার রক্ত থেকেই এই অ্যামাইনো অ্যাসিড মস্তিষ্কের বাইরের আবরণ ভেদ করে পৌঁছে যায় কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে- মস্তিষ্ক যার অন্যতম একটি অংশ।

প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবারে পর্যাপ্ত পরিমাণে অ্যামাইনো অ্যাসিড থাকে, এ কথা অনেকেরই জানা। কিন্তু মজার বিষয় হলো, মস্তিষ্কে প্রবেশ করার সময়ে এত অ্যামাইনো অ্যাসিডের মাঝে ট্রিপ্টোফ্যান যেন প্রায় রুদ্ধশ্বাস এক প্রতিযোগিতার মাঝে পড়ে যায়। যার ফলস্বরূপ পর্যাপ্ত ট্রিপ্টোফ্যান আর মস্তিষ্কে প্রবেশ করতে পারে না। আর পর্যাপ্ত পরিমাণ ট্রিপ্টোফ্যান মস্তিষ্কে না প্রবেশ করতে পারলে, কী সমস্যা হতে পারে তা এতক্ষণে আমরা জেনে গেছি। অথচ অন্যদিকে, যদি কার্বোহাইড্রেট-সমৃদ্ধ খাবার আমরা গ্রহণ করি নিয়মিত, তাহলে ইনসুলিনের কাজ বেড়ে যায়। তখন ট্রিপ্টোফ্যান ছাড়া, বাকি সমস্ত অপরিহার্য অ্যামাইনো অ্যাসিড কোশ-কলায় সরবরাহ হয়। পড়ে থাকে ট্রিপ্টোফ্যান। যার সিংহভাগই চালান হয় মস্তিষ্কে। আর সেখানে উৎপন্ন হয় পর্যাপ্ত সেরোটোনিন। বলা যেতে পারে, পর্যাপ্ত পরিমাণ কার্বোহাইড্রেট গ্রহণের ফলে ট্রিপ্টোফ্যানের জৈব-উপস্থিতি বা বায়োঅ্যাভেলিবিলিটি বাড়ে।

ডিপ্রেশন ও মেজর-ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডারের নেপথ্যে আরেকটি হাইপোথিসিস হল, হাইপোথ্যালামাস-পিটুইটারি-অ্যাড্রেনাল কর্টেক্সের অতিসক্রিয়তা। যার ফলে বিভিন্ন স্ট্রেস-হরমোনের ক্ষরণ বাড়ে। আবার তাদের অতিরিক্ত ক্ষরণের ফলে ডিপ্রেশন এবং মেজর ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডারের সমস্যা বাড়তে থাকে। কার্বোহাইড্রেট সেখানে হাইপোথ্যালামাস-পিটুইটারি-অ্যাড্রেনাল কর্টেক্সের অতিসক্রিয়তাকে অনেকটা কমায়। ফলে স্ট্রেস কমে, কমে ডিপ্রেশন এবং মেজর ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডারে ভোগার প্রবণতাও।

আরও পড়ুন- পেট ভরে খেয়েই কমবে ওজন! যে সব সহজ উপায়ে হতে পারে মুশকিল আসান

কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ ডায়েট এবং অবসাদে ভোগার সম্পর্ক কী তা বোঝার জন্য 'মেন্ডেলিয়ান র‍্যান্ডমাইজে়শন'-এর সাহায্য নিয়েছিলেন গবেষকরা। যে কোনও প্রাণীর শরীরেই একটি জিনের একাধিক ধরন থাকে। একই জিনের এই ভিন্ন ধরনকে বলে অ্যালিল। পুরুষ ও স্ত্রী দেহে যথাক্রমে শুক্রাণু ও ডিম্বাণু তৈরি হওয়ার সময়ে কোনও নির্দিষ্ট নিয়ম না মেনে, একপ্রকার এলোমেলো ভাবেই একটি একটি জনন কোশে জিনগুলির এক-একটি ধরন বা অ্যালিল সঞ্চারিত হয়। আর এইভাবে এলোমেলো ভাবে অ্যালিল সঞ্চারিত হওয়াকে বলা হচ্ছে মেন্ডেলিয়ান র‍্যান্ডমাইজে়শন।

সেই মেন্ডেলিয়ান র‍্যান্ডমাইজে়শনকেই কাজে লাগিয়ে গবেষকরা বুঝিয়ে দিলেন আমাদের শরীরে সঞ্চারিত জিনই ঠিক করে দেয়, আমাদের কার্বোহাইড্রেট-সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার প্রবণতা ঠিক কতটা হবে। আমাদের কার্বোহাইড্রেট-সমৃদ্ধ খাবারের প্রতি ঝোঁক থাকবে কিনা তা আমাদের শরীরে থাকা জিনই ঠিক
করে দেয়। অন্যদিকে, আমরা জীবনের কোনও সময়ে অবসাদের শিকার হব কিনা কিংবা মেজর ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডারের মতো মানসিক রোগে আক্রান্ত হব কিনা, তাও কিন্তু অনেকটাই থাকে আমাদের শরীরে থাকা জিনের নিয়ন্ত্রণে।

গবেষকরা বোঝার চেষ্টা করলেন, আমাদের শরীরের যে জিনগুলি আমাদের কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার প্রতি ঝোঁক বাড়ায়, ঠিক সেই জিনগুলির সঙ্গে আমাদের অবসাদ এবং মেজর ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডারে ভোগা সম্পর্কযুক্ত কিনা। তবে গবেষকরা সেরকম কোনও সম্পর্ক এখনই পাননি। তবে কার্বোহাইড্রেট কম খাওয়া বা এড়িয়ে যাওয়ার সঙ্গে যে ডিপ্রেশন বা মেজর ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডারের সম্পর্ক রয়েছে, তা নিশ্চিত করেছেন গবেষকরা।

 

More Articles