অবসাদ আসলে বড় বিপদের সংকেত! সতর্ক হওয়ার সময় এখনই, বলছে গবেষণা
ব্রেন অ্যাটাকের আগেই যেন অবসাদ, বিষণ্ণতা সাইরেন বাজিয়ে জানিয়ে দেয় এবার বিপদ আসন্ন। না, হতাশায় ডুব দেবেন না, এই স্টাডি এবং ডাক্তাররা আপনাকে বলে দিচ্ছেন, কী করে এই বিপদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাবেন।
বদলাচ্ছে জীবনযাপন। লাইফস্টাইল বদলের হাত ধরে শরীর ও মন গ্রাস করছে ডিপ্রেশন বা অবসাদ। আতঙ্কের নাম হয়ে উঠেছে স্ট্রোক। জার্মানির সাম্প্রতিক এক গবেষণা বলছে, স্ট্রোক হওয়ার কয়েকবছর আগেই দেখা যেতে পারে অবসাদের লক্ষণ। অর্থাৎ, ব্রেন অ্যাটাকের আগেই যেন অবসাদ, বিষণ্ণতা সাইরেন বাজিয়ে জানিয়ে দেয় এবার বিপদ আসন্ন। না, হতাশায় ডুব দেবেন না, এই স্টাডি এবং ডাক্তাররা আপনাকে বলে দিচ্ছেন, কী করে এই বিপদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাবেন।
স্ট্রোক শুধু একজন মানুষের নয়, গোটা একটা পরিবারের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। কোনও এক ব্যক্তি স্ট্রোকে আক্রান্ত হলে তিনি সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যেতে পারেন। গবেষকরা জানাচ্ছেন, আমাদের দেশে প্রতি এক লক্ষ মানুষের মধ্যে ১১৯ থেকে ১৪৫ জন ব্যক্তি স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। স্ট্রোকের শিকার হতে হচ্ছে অনেককে। বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, অনেক সময় উপসর্গ হিসেবে মৃদু স্ট্রোক দেখা দেয়। কিন্তু সেই মৃদু স্ট্রোক অবহেলা বা অগ্রাহ্য করার কারণেই পরবর্তীকালে ম্যাসিভ স্ট্রোকের শিকার হতে হয়। জার্মানির বিশ্ববিদ্যালয়ের এই স্টাডির সঙ্গে একমত নন স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দুর্গাপ্রসাদ চক্রবর্তী । তিনি বলেন, "স্ট্রোকের আগে ডিপ্রেশনের লক্ষণ দেখা যায় কি না, এই নিয়ে আমাদের এখানে কোনও সার্ভে হয়নি। তবে পার্সোনাল অবজারভেশন এই যে, করোনা পরিস্থিতির পর ডিপ্রেশন অনেক বেড়ে গেছে। তবে এই নিয়েও আমাদের দেশে কোনও নির্দিষ্ট স্টাডি হয়নি। এটা প্রমাণিত যে, স্ট্রোকের পর ডিপ্রেশন হয়। বিভিন্ন বইতে এর রেফারেন্স আছে। সেই সঙ্গে আমাদের অবজারভেশনেও ধরা পড়েছে। স্ট্রোক পঙ্গু করে দেয়। তাই এরপর একজন ডিপ্রেশনে ডুবে যায়। এর একটা বড় কারণ স্ট্রোক ব্রেনকে ড্যামেজ করে, ব্রেনের বিশেষ বিশেষ জায়গা ক্ষতিগ্রস্ত হলে মানসিক অবসাদের কারণ ঘটে। এর বাস্তব ভিত্তি রয়েছে।"
এদিকে স্ট্রোকের মৃদু উপসর্গের একটা বিশেষ লক্ষণ হলো অবসাদ। আগাম সতর্ক না হলে বিপদ আপনার দরজায় কড়া নাড়বে।
আরও পড়ুন: নতুন মহামারীর নাম হবে অবসাদ?
স্ট্রোক কী?
সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য আমাদের শরীরের প্রতিটি কোষে, এমনকী মস্তিষ্কের কোষেও অক্সিজেন সম্বৃদ্ধ রক্ত সঞ্চালন প্রয়োজন। কোনও কারণে মস্তিষ্কের রক্তবাহী ধমনির পথ সংকীর্ণ হয়ে বা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে রক্ত চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেলে মস্তিষ্কের কোষ অক্সিজেনের অভাবে নিস্তেজ হয়ে পড়ে। এটাকেই চিকিৎসকরা স্ট্রোক বলেন। মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল বন্ধ হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ উচ্চ রক্তচাপ। বিশেষ করে অনিয়ন্ত্রিত ব্লাড প্রেশার থাকলে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে। স্ট্রেস বা ডিপ্রেশন-সহ মানসিক সমস্যা থাকলেও এই বিপদের সম্ভাবনা থাকে। কাজেই বুঝতেই পারছেন, অবসাদ, বিষণ্ণতাকে কখনওই অগ্রাহ্য করবেন না।
৪ জনের মধ্যে ১ জনই বিপদে
এতদিন যে বিশ্বাস ছিল, তার থেকে সম্পূর্ণ উল্টো ধারণা এবার সামনে এল এক স্টাডির সৌজন্যে। এই গবেষণায় বলা হচ্ছে, স্ট্রোক হওয়ার কয়েক বছর আগে ডিপ্রেশনের লক্ষণ মাথাচাড়া দিতে পারে। আগে মনে করা হতো, স্ট্রোকের পর ডিপ্রেশন আসে। ইউনিভার্সিটি অফ মুনস্টার, জার্মানির পিএইচডি মারিয়া বালোচি এই গবেষণাটি করেন। স্টাডি অথর বালোচি সংবাদ সংস্থাকে জানান, মানুষের মধ্যে মারাত্মক আকারে বাড়ছে ডিপ্রেশনের সমস্যা। এতদিন পোস্ট স্ট্রোক ডিপ্রেশন, অর্থাৎ স্ট্রোক বা ব্রেন অ্যাটাকের পর ডিপ্রেশন হওয়ার ধারণা চালু ছিল। সাম্প্রতিক গবেষণায় অন্য ছবি দেখা গেছে। স্ট্রোকের পর অবসাদের প্রবণতা তো বাড়ছেই, সেই সঙ্গে দেখা গেছে স্ট্রোকের কয়েক বছর আগে থেকে ডিপ্রেশনের লক্ষণ। গবেষণায় আরও দেখা যাচ্ছে, ৫০ পেরোলে ৪ জনের মধ্যে ১ জনই বিপদে।
কাদের নিয়ে স্টাডি
১০,৭৯৭ জন পরিণত ব্যক্তির ওপর গবেষণা চালানো হয়েছে। গবেষণায় যাঁরা অংশ নিয়েছেন, তাঁদের অধিকাংশের বয়স ৬৫ বছরের বেশি। বহু বছর ধরে এই পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয়। যাঁদের ওপর এই গবেষণা চালানো হয়েছে, স্টাডি চলাকালীন তাঁদের মধ্যে ৪২৫ জনেরই স্ট্রোক হয়। বিভিন্ন ধরনের প্যারামিটারের ওপর ভিত্তি করে যে গবেষণা করা হয়, তাতে দেখা যায় অবসাদ শুধু পোস্ট স্ট্রোক আতঙ্কের নাম হয়, এটা প্রি-স্ট্রোক ফেনোমেনাও।
কীভাবে স্টাডি সমস্যার গভীর ঢোকে
এই স্টাডিতে যাঁরা অংশগ্রহণ করেন, তাঁদের সমস্যা ভালো করে, গুরুত্ব সহকারে খতিয়ে দেখা হয়। অর্থাৎ কবে থেকে, কত বছর ধরে তাঁরা মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। সমস্যার গভীরে ঢুকে স্টাডি পরিচালনা করা হয়। জানার চেষ্টা করা হয়, অংশগ্রহণকারীরা, অবসন্ন, একা, হতাশ, অধৈর্য বোধ করছেন কি না। ঘুমোতে তাঁদের কোনও সমস্যা হচ্ছে কি না, তাও খতিয়ে দেখা হয়। অংশগ্রহণকারীদের কী ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছে, স্ট্রোকের আগে ও পরে, সামগ্রিকভাবে স্টাডি চলাকালে তা জানার চেষ্টা করা হয়।
গবেষণার ফলাফল
গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, সাম্প্রতিককালে স্ট্রোক হওয়ার মাত্রা বাড়ছে। যাঁদের স্ট্রোক হয়েছে ৬ বছর আগে বিভিন্ন প্যারামিটারের ভিত্তিতে তাঁদের যে স্কোর ছিল, যাদের স্ট্রোক হয়নি, তা প্রায় এক। এই গবেষণায় দেখা গেছে, স্ট্রোক হওয়ার ২ বছর আগে ডিপ্রেশনের মাত্রা বেড়েছে। স্ট্রোক হওয়ার পরেও ডিপ্রেশনের কবল থেকে রেহাই পাওয়া যায় না। এরপরে ১০ বছর পর্যন্ত মারাত্মক আকারে অবসাদ গ্রাস করতে পারে।
কী লক্ষণ দেখে সতর্ক হবেন?
আগাম অবসাদ আপনাকে জানান দেয়, বিপদ কড়া নাড়ছে। কী উপসর্গ দেখে সতর্ক হবেন?
১. মনঃসংযোগ করতে না পারা
২. ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত লাগা
৩. কারণ ছাড়া নিজেকে অপরাধী মনে করা
৪. নেতিবাচক ভাবনা
৫. শুতে যাওয়া অনিয়মিত সময়ে
৬. খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন
৭. মাথা ব্যথা
৮. সবকিছু ফাঁকা মনে হওয়া
বছরে বিশ্বে ১৫ মিলিয়ন মানুষ স্ট্রোকের শিকার
আশঙ্কার কথা শোনাচ্ছেন ডাক্তার ও গবেষকরা। সারা বিশ্বে ব্রেন অ্যাটাক দ্বিতীয় বৃহৎ মৃত্যুর কারণ। আর আর তৃতীয় বৃহৎ পঙ্গু হওয়ার কারণ। হু-এর দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক অধিকর্তা ডক্টর পুনম ক্ষেত্রপাল সিং বলেন, চার জনের মধ্যে একজনের সারাজীবনের স্ট্রোক হওয়ার বিপদ থাকে। অন্য গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বে ১৫ মিলিয়ন মানুষ বছরে স্ট্রোকের শিকার।
স্ট্রোকের ঝুঁকি
লাইফস্টাইল অবশ্যই স্ট্রোকের প্রথম এবং প্রধান কারণ। রিস্ক ফ্যাক্টর বেড়ে যায়, যদি এর সঙ্গে হাত ধরাধরি করে শরীরে আগে থেকে বাসা বেঁধে থাকে উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ কোলেস্টরেল, মধুমেয়, হৃদরোগ। পরিবারে স্ট্রোকের ইতিহাস ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। ধূমপানের কারণে মৃত্যুর বয়স হওয়ার আগে স্ট্রোক মৃত্যু ডেকে আনে। কাজেই ধূমপান নৈব নৈব চ। সেই সঙ্গে এড়িয়ে চলুন অ্যালকাহল সেবন। শারীরিক কসরতের অভাব, অতিরিক্ত ওজন ডেকে আনতে পারে বিপদ।
স্ট্রোকের ঝুঁকি এড়াতে কী করবেন
১. ওজন কমাতে সুষম খাবারের ওপর ভরসা রাখুন। ডায়েটে রাখুন পর্যাপ্ত সবজি ও ফল।
২. সপ্তাহে অন্তত পাঁচ দিন দ্রুত পা চালিয়ে হাঁটতে হবে।
৩. ধূমপানের অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে।
৪. প্রতিদিন অন্তত ৫-৬ ঘণ্টা ঘুমোতে হবে।
৫. ব্লাড প্রেশার, সুগার থাকলে তা নিয়মিত নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
৬. ভুঁড়ি বাড়তে দেওয়া চলবে না।
৭. যদি আচমকা হাত, পা বা শরীরের কোনও অংশ অসাড় লাগে, চোখে দেখতে বা কথা বলতে অসুবিধা হয়, সেক্ষেত্রে ঝুঁকি না নিয়ে চিকিৎসেকর শরণাপন্ন হন।
স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দুর্গাপ্রসাদ চক্রবর্তীর পরামর্শ, চারের কোঠা পেরোলেই সাবধান। ব্লাডপ্রেশার, সুগার, কোলেস্টরেল নিয়ন্ত্রণে রাখুন। প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটুন। তামাক সেবন কোবওভাবেই চলবে না। খাওয়ার পাতে নুন নৈব নৈব চ।
তাহলে একটু সতর্ক থাকলেই সুন্দর স্বাস্থ্য। আর সুন্দর স্বাস্থ্য মানেই সুন্দরের জীবনের হাতছানি।
তথ্য সূত্র:
জার্মানির ইউনিভার্সিটি অফ মুনস্টারের পিএইচডি মারিয়া বোলোচির স্টাডি