'দাদা'দের ভাগ্যে বডি ম্যাসাজ, 'দাগী' হলে নারকীয় অত্যাচার! তিহারের জেলকুঠুরি যেমন...
Life in Tihar Jail: আইনের রক্ষা করাই পুলিসের কাজ। তার বদলে জেলের ভিতরেই যদি চলে বৈষম্যমূলক আচরণ? তিহারের কথা...
বেশ কয়েকবছর আগে একটি ছবি নেট মাধ্যমে ভেসে উঠেছিল। ছবিটি ভারতের বাণিজ্যনগরী মুম্বইয়ের। একদিকে সুউচ্চ অট্টালিকা, ঝাঁ-চকচকে বাংলোর রোশনাই; আর তার ঠিক উল্টোদিকে সার দেওয়া ছোট ছোট বাড়ি। ধারাভি বস্তি। নেটিজেনদের বক্তব্য, এটাই ভারতের আর্থিক বৈষম্যের যথাযথ রূপক ছবি। আসলে একই মুদ্রার দু’টো পিঠ…
ওপরের শেষ কথাটির সূত্র ধরেই আসল প্রসঙ্গে ঢোকা যাক। মুম্বই থেকে কাট টু নিউ দিল্লি। পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের রাজধানী। দিল্লির জনকপুরীতেই রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় কারাগার – তিহার জেল। ঘটনার ঘনঘটায় বারবার এই বিশেষ কারাগারটির নাম সংবাদ শিরোনামে উঠে আসে। মাত্র কয়েকদিন আগে আবারও শিরোনামে জায়গা করে নেয় তিহার। সৌজন্যে বেশকিছু সিসিটিভি ফুটেজ। দিল্লির আপ সরকারের এক মন্ত্রী সত্যেন্দ্র জৈনকে সেখানে দেখা যাচ্ছে। দুর্নীতির অভিযোগে আপাতত তিনি হাজতবাসে। বারবার তিনি অভিযোগ করেছেন, কারাগারে তিনি পর্যাপ্ত খাবার পাচ্ছেন না। অথচ সিসিটিভি ফুটেজ সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র দেখাচ্ছে। সেখানে সত্যেন্দ্রবাবু কখনও গারদের ওপারে বসে টাটকা ফল খাচ্ছেন। কখনও রয়েছে ফলের রস। আরামদায়ক বিছানা, বালিশের পাশে টিভির রিমোট। আবার অন্য একটি ভিডিওয়ে দেখা যাচ্ছে, এক ব্যক্তি তাঁর বডি ম্যাসাজ করছেন। মানে, রীতিমতো ভিআইপি ব্যবহার! যদিও সত্যেন্দ্রবাবু এখনও জেলের দুরবস্থার কথা বলছেন। তাঁকে খেতে দেওয়া হচ্ছে না, তাঁর ওজন কমে যাচ্ছে, এমন ‘অভিযোগ’ও করেছেন।
আরও পড়ুন : হাথরাস থেকে লখিমপুর- আইনের জটে কেন আজও আটকে দলিত ধর্ষণের মামলা?
হঠাৎ এই প্রসঙ্গের উত্থাপন কেন? কারণ এটাই তিহার জেলের একমাত্র ছবি নয়। ‘কারার ওই লৌহ কপাট’-এর ওপারে মুদ্রার দ্বিতীয় পিঠটিও আছে। সেখানে আরও জ্বলজ্যান্ত আমাদের বৈষম্য আচরণ। নেতা, ক্ষমতাশালীরা ভিআইপি আতিথেয়তা পেলেও বাকিদের সেই ‘সৌভাগ্য’ হয় না। শুধু কি তিহার? প্রতিটা জেল, সমাজের প্রতিটা ক্ষেত্রেই এমন অমানবিক বৈষম্য খেলা করছে। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। মাত্র ১০ মাস আগে তিহার জেলেরই এক কয়েদি একটি অভিযোগ আনেন। জেল কর্তৃপক্ষের কাছে জানান, সহবন্দিরা দীর্ঘদিন ধরে তাঁর ওপর অত্যাচার করছে। চলছে শারীরিক নির্যাতন। এমনকি বলপূর্বক পায়ুসঙ্গম, যৌন অত্যাচারও করা হয়। হাসপাতালে ভর্তি করে সঠিক চিকিৎসা ও সুরক্ষার ব্যবস্থাও নেয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু প্রশ্ন হল, এই ঘটনা তো বিক্ষিপ্ত নয়! এর আগেও এমন অভিযোগ বারবার উঠেছে। জেলের ভিতর বিভিন্ন গ্যাংয়ের মধ্যে চলে লড়াই। চলে শারীরিক নির্যাতন। জেলের ভিতর নিরাপত্তা ব্যবস্থা আদৌ কি জোরদার রয়েছে?
আরও পড়ুন : বিচারের আগেই মিডিয়া যে ভাবে ‘অপরাধী’ বানিয়েছে উমর খলিদকে
অবশ্য কেবল বন্দিরাই নন, অত্যাচারের অভিযোগ ওঠে জেল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধেও। সেখানেই লুকিয়ে রয়েছে ভয়াবহতা; রয়েছে অত্যাচার। কাশ্মীর বরাবরই ভারতের রাজনীতির মানচিত্রে বেশ উঁচু জায়গায় থাকে। শাসক, বিরোধী, সংবাদপত্র থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ, কাশ্মীর নিয়ে প্রত্যেকেরই নিজস্ব ভাষ্য রয়েছে। ২০১৯ সালে ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারা উঠে যাওয়ার পর নানা মুনির নানা মত। সন্ধে হলেই টিভিতে শুরু হবে নিত্য নতুন আলোচনা। এসবের বাইরে কেমন আছেন জেলবন্দি কাশ্মীরীরা? অপরাধের কোনও ধর্ম, জাতপাত, প্রাদেশিকতা হয় না সেটা ঠিকই। যে অপরাধী তার তো শাস্তি হওয়াই উচিত, সে যেই হোক না কেন। কিন্তু একই পরিধির মধ্যে একদিকে বডি ম্যাসাজ, অন্যদিকে অমানসিক অত্যাচার – এমন বৈষম্য কি কাম্য?
আরও পড়ুন : স্বাধ্বী প্রজ্ঞা বললে সাত খুন মাফ, বাক-স্বাধীনতা নেই জিগনেশের? কেন গ্রেফতার!
তিহার জেলে বহু বছর ধরে বেশ কয়েকজন কাশ্মীরী বন্দি রয়েছেন। বিভিন্ন সাক্ষাৎকার, বা আলাপচারিতায় বারবার উঠে এসেছে সেখানকার ভয়াবহতার কথা। তাদের উপর যেন আরও বেশি করে অত্যাচার করা হয়, এমনটাই অভিমত তাদের। জন্মচিহ্ন খোঁজার অছিলায় জামাকাপড় খুলিয়ে নগ্ন করে চলে মারধোর। যখন জ্ঞান আসে, তখন দেখা যায় রক্তাক্ত, কালশিটে দাগের আড়ালে সেই জন্মজড়ুল ঢাকা পড়ে গিয়েছে। এক সাক্ষাৎকারে এমনই বলেছিলেন এক কাশ্মীরী বন্দি। ২০০৪ সালে তিনি তিহার জেলে বন্দি হিসেবে আসেন। একটি রিপোর্ট বলছে, ২০১৩ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী তিহার জেলে মোট ১৮ বার বন্দিদের ঊপর ধারালো ব্লেড দিয়ে হামলা চালানো হয়েছে। সেইসঙ্গে অন্যান্য অত্যাচার তো আছেই। পাশাপাশি সহবন্দিদের চোখে কাশ্মীরী বন্দিরা ‘জঙ্গি’। এমনকি, মহিলাদেরও সবসময় ছাড় দেওয়া হয় না। একটা সময় তিহার জেলে ছিলেন জামরুদা হামিদ। জেলের ভিতর তাঁর দিনযাপনের কথা একটা ডায়েরিতে কোনওমতে লিখে রেখেছিলেন। পরে সেটিই বই আকারে বের হয়; নাম ‘Prisoner No 100: An Account of My Nights and Days in an Indian Prison’। সেখানেই পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে লেখা অত্যাচারের বর্ণনা। এমনকি, তাঁর ‘নগ্ন’ ছবি তুলে ভাইরাল করে দেওয়ার হুমকিও আসে আইনের রক্ষাকারীদের তরফ থেকে। বন্দিদের বাড়ির লোক তিহার জেলে দেখা করতে এলে কাশ্মীরী ভাষায় কথা বলতে পারতেন না। কথা বললেই শ্যেনদৃষ্টি ধেয়ে আসবে উপরমহল থেকে! নজরদারির আওতায় চলে আসবে পরিবার। এমনই সব বর্ণনা উঠে এসেছে বইয়ের পাতায় …
আরও পড়ুন : নিয়োগ দুর্নীতি কাকে বলে, শিখিয়েছে মধ্যপ্রদেশ! কেন ব্যাপম কেলেঙ্কারির কথা মনে করাচ্ছেন মমতা
২০২১ সালের ৪ আগস্ট। তিহারের জেল নম্বর ৩-এ এক যুবকের মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। বছর ২৯-এর ওই যুবকের নাম অঙ্কিত গুজ্জর। খুনের অভিযোগে সাজাপ্রাপ্ত ওই যুবককে কড়া নিরাপত্তা বেষ্টনীতেই রাখা হয়েছিল। তিহারের মতো জেলে কীভাবে এমন মৃত্যুর ঘটনা ঘটতে পারে? তদন্ত সামান্য এগোনোর পর জানা যায়, মৃত্যুর আগে তাকে কেউ বা কারা বেধড়ক মারধোর করে। পোস্টমর্টেম রিপোর্টে বলা হয়, কোনও ভারী ও ভোঁতা বস্তু দিয়ে অঙ্কিতকে বারবার মারা হয়। ফলস্বরূপ, অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ ও মৃত্যু। এদিকে পরিবারের অভিযোগ, এটা সামান্য মৃত্যু নয়; অঙ্কিতকে ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পনা করে জেলের ভিতরেই খুন করা হয়েছে। আর সেই খুন করেছে তিহার জেলের পুলিস অফিসাররাই। পরিবারের দাবি ছিল, জেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসারদের কথামতো ‘টাকা’ দিতে না পারায় এমন কাজ করা হল। তিহারের মতো জেলে দাঁড়িয়ে, এমন অভিযোগ সত্যিই মারাত্মক। তবে পরিবারের অভিযোগকেই একপ্রকার মান্যতা দিয়েছেন দিল্লি হাইকোর্টের বিচারক মুক্তা গুপ্তা। তদন্তে এও জানা যায়, ওই সময় অদ্ভুতভাবে ওই জেলের সিসিটিভি ক্যামেরা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। হয়ে গিয়েছিল, না বন্ধ রাখা হয়েছিল?
ভারতের সংবিধানই আমাদের একমাত্র মানদণ্ড। তার উপর ভিত্তি করে, সংবিধানের শপথ নিয়ে আইনরক্ষার কাজে নামে পুলিস-প্রশাসন। অপরাধীদের জেল হেফাজত হলেও সেখানেও আইনরক্ষা করা প্রাথমিক ও প্রধান কর্তব্য। সেক্ষেত্রে তো কোনও বৈষম্য থাকা উচিত নয়! তাহলে বারবার এমন ঘটনা কেন? অঙ্কিত গুজ্জরের ঘটনায় এই প্রশ্নটাই তুলেছিলেন বিচারক গুপ্তা। তাঁর এই বক্তব্য যে খুব একটা ভুল নয়, নানা ঘটনাই তাঁর প্রমাণ। তিহারের অন্য পিঠে থাকা বন্দিদের কাছে কি ফলের জুস, টিভি দেখার সুবন্দোবস্ত পৌঁছয়? বডি ম্যাসাজ করার সুযোগ আসে? অসুস্থ হলেই অপেক্ষা করে উডবার্নের মতো সুন্দর ওয়ার্ড? নাকি জেলের ভিতর এমন বৈষম্য আসলে আমাদের সমাজেরই প্রতিচ্ছবি? যেখানে অপরাধী-জেল কর্তৃপক্ষের বাস্তুতন্ত্রে খেলা করে উঁচু-নিচুর ভেদাভেদ। যেখানে ফুটে ওঠে কারণে অকারণে ‘জঙ্গি’ আখ্যা দেওয়ার খেলা। তিহারের মতো হাই প্রোফাইল জেল আসলে সামগ্রিক ব্যবস্থার ছবিটাই তুলে ধরে না?