জড়িয়েছেন মারাদোনাও, বিশ্বকাপের ডোপ কেলেঙ্কারি যেভাবে বার বার শিরোনামে
Doping in FIFA World Cup: ফুটবল বিশ্বকাপে বারবার ডোপিংয়ের অভিযোগ উঠেছে। এই বিশ্বকাপেও দেখা গিয়েছে একই ছবি।
মঙ্গলবার দুপুরে অধিকাংশেরই চোখ ছিল টিভির পর্দায়। মাঠে তখন আর্জেন্টিনা, উল্টোদিকে সৌদি আরব। মেসি-ডি মারিয়ার দল ভালোভাবে নিজেদের অভিযান শুরু করবে, সেটাই আশা করেছিলেন সবাই। কিন্তু বিশ্বকাপের মঞ্চে অঘটন হবে না, তা কি হয়? মঙ্গলবার সৌদি আরব যে অবিশ্বাস্য ফুটবল উপহার দিল, সেটা নিশ্চয়ই সকলে স্বীকার করবেন। এই মুহূর্তে আলোচনার কেন্দ্রেও উঠে এসেছে আরব্য রজনীর দেশের যোদ্ধারা। তবে ২০২২ কাতার বিশ্বকাপে এর আগেও শিরোনামে উঠে এসেছে সৌদি আরব। তবে এখানে ব্যাপারটা গৌরবের নয়, খানিক চিন্তার। উদ্বিগ্ন হওয়ার মতোই। উদ্বোধনের ঢাকে কাঠি পড়ার আগেই ডোপিংয়ের ছায়া নেমে আসে কাতারে। আর সৌজন্যে? সেই সৌদি আরব! কাঠগড়ায় দলের রাইট উইঙ্গার ফাহাদ আল মওল্লাদ। আগেও বেশ কয়েকবার ডোপিংয়ের জন্য শাস্তির মুখে পড়েছিলেন ফাহাদ। অথচ তাঁকে রেখেই দল গড়েছিলেন কোচ হার্ভ রেনার্ড। শেষ পর্যন্ত শাস্তি এড়াতে ফাহাদকে বাদ দেওয়া হয়।
কেবল ফুটবল বিশ্বকাপ নয়, অলিম্পিক, ক্রিকেট থেকে শুরু করে পৃথিবীর ছোট-বড় সমস্ত প্রতিযোগিতায় ডোপিংয়ের আনাগোনা চলে। দীর্ঘ চোট এবং যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে খেলোয়াড়রা বিভিন্ন ওষুধ ব্যবহার করেন। মাঠে নামার তাগিদ হয়তো কাজ করে সেখানে। সেখানেই জ্ঞানত কিংবা অজ্ঞানত ‘নিষিদ্ধ ওষুধ’ সেবন করেন। অনেকে আবার খেলার মাঠে নিজেদের পারফর্মেন্স বাড়াতে এই ওষুধ নিয়ে থাকেন। এই পুরো ব্যাপারটারই ভালো নাম ‘ডোপিং’। খেলায় স্বচ্ছতা আনার জন্য এর আগেও বারবার নিষেধাজ্ঞার কোপ পড়েছে বিভিন্ন জনের উপর। কখনও আবার একটা দেশকেই প্রতিযোগিতা থেকে বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। ফিফা, আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি বা IOC, আইসিসির মতো সংস্থাগুলিও কড়া নজরদারি চালাচ্ছে। অন্যদিকে ওয়াডা (WADA) বা ওয়ার্ল্ড অ্যান্টি ডোপিং এজেন্সিও এই ব্যাপারে কড়া মনোভাব নিয়েছে। তবুও বন্ধ হয়নি ডোপিংয়ের কর্মকাণ্ড।
বাদ নেই ফুটবল বিশ্বকাপও। চার বছর অন্তর এই প্রতিযোগিতার জন্য অনেকেই হাপিত্যেশ করে বসে থাকেন। রাত জাগার প্রস্তুতি নেন। কিন্তু সেই উন্মাদনার পাশাপাশি ডোপিংও নিজের থাবা ঠিকই বাড়িয়ে রাখে। এবারের কাতার বিশ্বকাপের আরেকটা ঘটনা ধরা যাক। একেবারে বিশ্বকাপ উদ্বোধনের পরের দিনের ঘটনা। কাতারের হামাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে নিষিদ্ধ ওষুধ উদ্ধার করা হয়। পাশাপাশি একজনকে পাকড়াও করা হয়। পাশাপাশি সেনেগালের অন্যতম তারকা খেলোয়াড় কেইটা বালডের উপরেও ডোপিংয়ের অভিযোগ ওঠে। তিনিও এবারের বিশ্বকাপে খেলছেন না। ডোপিংয়ের কোনও প্রভাব যাতে বিশ্বকাপে না পড়ে, তার জন্য নিয়মের কড়াকড়িও করেছে ওয়াডা আর ফিফা। প্রতিটি খেলোয়াড়কে ডোপিং টেস্টের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। অবশ্য এমনটা নতুন ঘটনা নয়। বিশ্বকাপের ইতিহাসের পাতা ওলটালে এমন অনেক ঘটনাই সামনে আসবে। সেই সমস্ত ঘটনার দিকেই একটু নজর দেওয়া যাক।
আরও পড়ুন: মেসির জারিজুরি শেষ তাঁর সামনে! সৌদির গোলকিপারকে চেনেন?
১৯৬৬ বিশ্বকাপ ও পশ্চিম জার্মানি:
১৯৬৬ ফুটবল বিশ্বকাপ ফাইনালে শেষ মুহূর্তে ইংল্যান্ডের জিওফ হার্স্টের শটটি আদৌ গোললাইন পেরিয়েছিল কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক চলেছিল বহুদিন। ব্রিটিশদের বিপক্ষে সেদিন ছিল পশ্চিম জার্মানি। সেই পশ্চিম জার্মানির বিরুদ্ধেই ডোপিংয়ের অভিযোগ ওঠে। বলা হয়, ডোপিংয়ের সাহায্যেই দলটি ফাইনাল অবধি পৌঁছয়। ২০১৩ সালে হামবোল্ট বিশ্ববিদ্যালয় ও মানস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা এনিয়ে একটি রিপোর্টও পেশ করেন। তাঁদের দাবি, ১৯৫০ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত এই ডোপিং প্রক্রিয়া চলে। ১৯৬৬ সালের বিশ্বকাপ নিয়ে বিস্তর ঘাঁটাঘাঁটিও করেন সাংবাদিকরা। তাঁরা দাবি জানান, ওই টিমে তিনজন খেলোয়াড়ের নমুনায় নিষিদ্ধ ওষুধ ‘এফিড্রিন’-এর নমুনা পাওয়া গিয়েছিল। অবশ্য এখানে কেউ কেউ কন্সপিরেসি থিয়োরির প্রসঙ্গও টানেন। কারণ, এই ধরণের নিষিদ্ধ ওষুধ শনাক্তকরণের পদ্ধতিটি ইংল্যান্ডেই আবিষ্কৃত হয়েছিল, আর ডোপিং পরীক্ষাও হয়েছিল ওই দেশেই। কাজেই চক্রান্তের গন্ধও পেয়েছেন কেউ কেউ। তবে সেসব শেষ পর্যন্ত প্রমাণিত হয়নি। পরবর্তীকালে জানা যায়, পশ্চিম জার্মানির ওই তিন খেলোয়াড়ের নমুনায় নিষিদ্ধ ওষুধ পাওয়া গিয়েছিল ঠিকই। তবে খেলোয়াড়দের বক্তব্য ছিল, একেবারে অজান্তেই তাঁরা এই ওষুধ সেবন করে ফেলেছেন। সেইসময়ের ডোপিংয়ের নিয়ম অনুযায়ী তাঁদের উপর আর কোপ আসেনি। কিন্তু পশ্চিম জার্মানির লাগাতার নিষিদ্ধ ওষুধ ব্যবহার চর্চার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
আরও পড়ুন: এই বিশ্বকাপটা মেসির চাই-ই, কিন্তু…
মারাদোনা:
কেবল কাতারের ময়দান নয়, গোটা বিশ্বই ফুটবলের ‘ব্যাড বয়’-এর অভাব বোধ করছে। অবসর নিয়েছিলেন অনেক আগেই; জীবনযুদ্ধেও অবসর নিলেন অসময়ে। দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনাকে আসলে কোনো সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করা যায় না। তিনি পাগল, উচ্ছৃঙ্খল, কিংবদন্তি, সোনায় মোড়া ঈশ্বরীয় হাত। সেই পাগল মানুষটার উপরই ডোপিংয়ের কালো ছায়া নেমে এসেছিল। ১৯৯৪ বিশ্বকাপ। ১৯৮৬-তে আর্জেন্টিনাকে কার্যত একার ‘হাতে’ জিতিয়েছেন বিশ্বকাপ। ’৯০-তে ফাইনালে গিয়েও জার্মানির কাছে হার মাত্র এক গোলে। ১৯৯৪-এর বিশ্বকাপেও তিনি প্রবল বিক্রমে। কিন্তু মাঝপথেই ঘটল বিপদ। ডোপ পরীক্ষার রিপোর্ট এল ‘পজিটিভ’। নিষিদ্ধ মাদক ‘এফিড্রিন’ পাওয়া গিয়েছে মারাদোনার নমুনায়। তারপরই দল থেকে বাদ পড়লেন ফুটবলের রাজপুত্র। আর ফেরা হল না। তার আগেও ডোপ কেলেঙ্কারির জন্য ধরা পড়েছিলেন মারাদোনা। তখন নাপোলিতে খেলছেন তিনি। কেলেঙ্কারির জন্য ইতালির ফুটবল থেকে ১৫ মাসের জন্য নির্বাসিতও হন তিনি। তারপর ১৯৯৪-এর বিশ্বকাপে ফের ডোপিংয়ের তকমা। ফিফা আবারও মারাদোনাকে ১৫ মাসের জন্য নির্বাসনে পাঠাল। অবশ্য তিনি অনেকবারই এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। বলেছেন, তিনি ইচ্ছে করে এই ওষুধ নেননি। চক্রান্ত করে তাঁর পাওয়ার ড্রিংকের সঙ্গে মিশিয়ে খাইয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বিতর্ক পিছু ছাড়েনি। অবশ্য এখন সেসব অতীত। মারাদোনাই যে নেই আর…
আরও পড়ুন: নিরামিষ বিশ্বকাপ! বিশ্বের ফুটবলপ্রেমীদের জন্য কী কী চরম নিষিদ্ধ কাতারে?
রাশিয়া ও ডোপিং:
কেবল ফুটবল নয়, সমগ্র ক্রীড়া জগতের অন্যতম কলঙ্কিত অধ্যায়ের সঙ্গে বোধহয় রুশদের নাম জড়িয়ে থাকবে অনেকদিন। অভিযোগ উঠেছিল অলিম্পিকের সময়। অভিযোগ, খোদ সরকারি মদতেই রাশিয়ায় খেলোয়াড়দের কর্মক্ষমতা বাড়ানোর জন্য তাঁদের উপর নিষিদ্ধ ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। এর পিছনে জড়িয়ে যায় রাশিয়ার অ্যান্টি ডোপিং এজেন্সি বা রুশাডার নামও। গোটা বিশ্ব কার্যত নড়েচড়ে বসে এই ঘটনার পর। ওয়াডার বক্তব্য ছিল, নিষিদ্ধ ওষুধ বন্ধ করতে রুশাডা যথেষ্ট সাহায্য করছে না। এমনকী তথ্য কারচুপিরও অভিযোগ ওঠে। বিভিন্ন টালবাহানার পর ২০১৯ সালে ওয়াডা সিদ্ধান্ত নেয় যে, আগামী চারবছর রাশিয়া অলিম্পিক সহ আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারবে না। সেই হিসেবে টোকিও অলিম্পিক এবং এখন ২০২২ কাতার ফুটবল বিশ্বকাপে নেই রাশিয়ান ফৌজ।
ডোপিং রোধে ফিফা বারবার নিজেদের কড়া মনোভাব ব্যক্ত করেছে, এটা সত্য। প্রত্যেক খেলোয়াড়দের বায়োলজিকাল প্রোফাইলিং তৈরি করে তাঁদের পরীক্ষা করা, সমস্তটাই অত্যন্ত তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে দেখা হচ্ছে। শেষমেশ খেলার স্পিরিট, ফুটবলের সৌন্দর্যই যেন জিতে যায়, সেই আশাতেই রাত জাগার পালা শুরু আমাদের।