দেশের প্রথম মহিলা সিনেমাওয়ালা, স্পর্ধার নাম ফতমা বেগম
Fatma Begum, First Woman Director of Indian Film: ব্যক্তিগত জীবন থেকে কর্মস্থল, প্রায় সমস্ত জায়গাতেই ফতমা ছিলেন স্বয়ংসিদ্ধা। যার পাঁজরে ছিল সমস্ত রকমের প্রথা ভাঙার জোর।
নারী রাঁধে এবং চুলও বাঁধে। কিন্তু তাই বলে কাঁধে তুলে নেবে ভুবনের ভার! আর তা হাসিমুখে মেনে নেবে 'মেল শভিনিস্ট' সমাজ, তা-ও আবার মেনে নেওয়া যায় নাকি! মেয়েরা সংসার চালাবে, রান্না করবে, দোকান-বাজার সারবে, প্রয়োজনে কাজও করবে, কিন্তু নেতৃত্ব দেবে কিংবা গোটা কর্মকাণ্ডের নেপথ্যে নারী নাড়বে কলকাঠি, তা মেনে নেওয়া কঠিন তো বটেই। আজকের দিনে দাঁড়িয়েও যা কঠিন, আজ থেকে একশো বছর আগে যে তা কঠিনতর ছিল, তা মালুম করতে অসুবিধা হয় না। ফলে সেই সব দ্বার শুধুমাত্র রূপে ভুলিয়ে বা গান গেয়ে যে খোলেনি তা বলাই বাহুল্য। বরং সেই সব দরজা খুলতে কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি নারীকে। প্রথা ভাঙার পথে বরাবরই ফুলের চেয়ে কাঁটা বেশি। আর তা যদি ভারতীয় সিনেমার মতো ক্ষেত্র হয়, তাহলে তো বলারই নয়।
আরও পড়ুন: দিয়েছিলেন বিসমিল্লা খানকে টেক্কা, প্রথম মহিলা সানাইবাদক বাগেশ্বরী যেন সুরের সরস্বতী
আজকের সিনেমায় বহু মহিলা পরিচালকের ছড়াছড়ি। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলা বা সিনেমা তৈরির স্বাধীনতা আজ তাঁদের রয়েছে। তবে বরাবর পরিস্থিতি তেমনটা ছিল না। একটা সময় সিনেমা ব্যাপারটিকেই বিশেষ ভালো চোখে দেখত না সমাজ। ফলে সেখানে মহিলাদের কাজকেও খুব একটা মর্যাদা দেওয়া হত না। একটা সময় নাটকে, যাত্রাপালায় মেয়েদের ভূমিকায় অভিনয় করতেন পুরুষরাই। তার পর সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিতে পতিতাপল্লী থেকে মেয়েদের তুলে এনে তাঁদের দিয়ে অভিনয় করানো হত যাত্রা, থিয়েটার এমনকী সিনেমাতেও। যে পেশায় দেহপসারিনীদেরই সুযোগ বেশি, সেখানে যে সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়েদের আসায় বিশেষ বাধা থাকবেই, তা তো আর বলে দিতে হয় না। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই সিনেমায় 'নামা' আক্ষরিক অর্থেই ছিল পতনের সমার্থক। কিন্তু সময় তো থেমে থাকে না। থামে না কালের গতি। সেই গতির হাত ধরেই একজন-দু'জন করে সিনেমায় আসতে শুরু করলেন নারীরা। ভাঙল প্রথা। কিন্তু সে তো অভিনয়।
পুরুষের নির্দেশনায় নারীর অভিনয় মানা যায়। তাই বলে উল্টোটা! নারীদের নির্দেশ মেনে অভিনয় করবেন পুরুষ তারকারা, বুঝে নেবেন শট, 'অ্যাকশন' বললে অ্যাকশন, 'কাট' বললে কাট! মেয়েদের হাতের পুতুল হয়ে থাকাটা তো পুরুষ অহংয়ের বিরোধী বরাবরই। এই জন্যই আজও অফিসের মহিলা 'বস'টির নির্দেশ তামিল করতে কোথাও না কোথাও বাধো বাধো ঠেকে। মেয়েদের প্রোমোশনের নেপথ্যে দেখে ফেলা যায় উর্ধবতনের সঙ্গে কুৎসিত সমীকরণের মনগড়া ছবি। আর এসব তেরছা চোখ, অশোভন ইঙ্গিত পেরিয়েই নারীকে ছিনিয়ে নিতে হয়েছে 'আপন ভাগ্য জয় করিবার অধিকার'। যেমনটা পেরেছিলেন ফতমা বেগম।
অপর্ণা সেন থেকে শুরু করে নন্দিতা দাশ বা মীরা নায়ার, কিংবা হালের জোয়া আখতার, পুরুষশাসিত সমাজে ভারতীয় সিনেমা যে একের পর এক ধারাবাহিক নারীস্বর পেল, তার সূচনা কিন্তু করে দিয়েছিলেন ফতমা বেগম। ১৮৯২ সালে মুসলিম পরিবারে জন্ম ফতমার। বাবা ছিলেন করাচির নামকরা ব্যবসায়ী। রক্ষণশীল হলেও উর্দু নাটকে অভিনয়ের অভ্যাস ছিল তাঁর ছোট থেকেই। জানা যায়, সচিন রাজ্যের নবাব তৃতীয় সিদি ইব্রাহিম মহম্মদ ইয়াকুত খানের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল ফতমার। কিন্তু সেই বিবাহ ছিল শর্তাধীন ও চুক্তিসাপেক্ষ। তাঁদের কোন সন্তানই নবাব পরিবারের মর্যাদা পাবে না, এমনই কোনও চুক্তিতে বিয়ে হয় তাঁদের। ব্যবসায়ী পরিবারে জন্ম হওয়ার কারণেই বোধহয় ফতমার রক্তে ছিল ব্যবসা। উর্দু থিয়েটারের মঞ্চ দিয়ে অভিনয়ের যাত্রা শুরু হয়েছিল তা ক্রমেই পৌঁছল নির্বাক সিনেমার দরজায়। ১৯২২ সাল নাগাদ আরদাশির ইরানি পরিচালিত 'বীর অভিমন্যু' ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ পান ফতমা। সেসময় ছবিতে নারীর ভূমিকায় অভিনয় করতেন পুরুষরাই। ফলে সে সময় পর্দায় নারীর ভূমিকায় নারীকে দেখাটা ছিল দুর্দান্ত চমকপ্রদ একটা বিষয়। স্বাভাবিক ভাবে প্রথম ছবিতেই দুর্দান্ত জনপ্রিয়তা পেয়ে যান ফতমা। দুধে-আলতা গায়ের রংয়ের উপরে চড়া মেকআপ, সেপিয়া কিংবা সাদা-কালো পর্দায় ফতমাকে দেখে তখন মুগ্ধ দর্শক।
কিন্তু কখনওই একজায়গায় থমকে যেতে পছন্দ করেননি ফতমা। সিনেমায় সাফল্যের পর পরই নিজের প্রযোজনা সংস্থা খোলার কথা মাথায় এল তাঁর। যেমন ভাবা তেমনই কাজ। ১৯২৬ সালে ফতমা ফিল্মস নামে একটি প্রযোজনা সংস্থা খুলে ফেললেন তিনি। ১৯২৮ সালে নাম বদলে ফতমা ফিল্মস হল ভিক্টোরিয়া-ফতমা ফিল্মস। তখনকার দিনে দাঁড়িয়ে ফ্যান্টাসি সিনেমার পথিকৃত হয়ে উঠলেন ফতমা দেবী। ভিএফএক্সের ধার না ধেরেই শুধুমাত্র ফটোগ্রাফির পারদর্শিতায় সিনেমায় যোগ করতে পারতেন স্পেশাল এফেক্ট। আর সেটাই ছিল ভিক্টোরিয়া-ফতমা ফিল্মসের ইউএসপি। এরই মধ্যে অভিনয়ের পাশাপাশি হাত পাকান ছবি লিখিয়ে, ছবিকরিয়ে এবং সিনেমাওয়ালার কাজেও।
এরই মধ্যে নিজের প্রযোজনা সংস্থা থেকে মুক্তি পেল ফতমার পরিচালনায় প্রথম সিনেমা 'বুলবুল-এ-পরিস্থান'। ভারতীয় সিনেমার প্রথম মহিলা পরিচালকের ছবি। তাঁর লেখা চিত্রনাট্যের উপর ভিত্তি করে এর আগে একাধিক সিনেমা হয়েছে দেশে। তবে এবার নিজের জন্য কলম ধরলেন ফতমা। একগুচ্ছ স্পেশাল এফেক্টের মায়া নিয়ে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেল আরও একটি ফ্যান্টাসি সিনেমা। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে বেশ বড় বাজেটের সিনেমা ছিল 'বুলবুল-এ-পরিস্থান'। দুঃখের বিষয়, সেই ছবিটির একটিও প্রিন্ট পাওয়া যায় না বর্তমানে। কালের গর্ভেই তলিয়ে গেল ভারতীয় সিনেমার প্রথম মহিলা ছবিনির্মাতার প্রথম সিনেমাখানা। কেমন ছিল তাঁর সেই কাজ, তা জানার বা দেখার সুযোগ আজ আর নেই। তা যদি থাকত, শুধু মহিলা পরিচালক হিসেবে নয়, প্রথম ফ্যান্টাসি ছবি হিসেবেও হয়তো বিশ্বের ইতিহাসে পাকা জায়গা করে ভারতীয় সিনেমা। তার সঙ্গে থেকে যেত ফতমার প্রথম ছবিটিও। তবে দুর্ভাগ্য, তেমনটা হয়নি।
এর পরেও একের পর এক ছবি বানিয়েছেন ফতমা। কোনওটা ফ্যান্টাসি, কোনও সিনেমা বা আবর্তিত হয়েছে নারীকেন্দ্রীক গল্পে। ‘হীর-রাঞ্ঝা’, ‘চন্দ্রবলী’ বা ‘গডেস অব লাভ’-এর মতো একাধিক ছবির পরিচালক হিসেবে নজর কাড়েন। নিজের তিন মেয়েকে নিয়েও ছবি বানিয়েছিলেন ফতমা। তবে ১৯২৯ সালে 'গডেস অব লাভ' ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পর চলচ্চিত্র নির্মাণের দুনিয়া থেকে সরে আসেন ফতমা। তবে ছবি বানানো ছাড়লেও সিনেমার দুনিয়া ছাড়েননি তিনি। কোহিনুর স্টুডিও ও ইম্পেরিয়াল স্টুডিওর একাধিক ছবিতে চুটিয়ে অভিনয় করে গিয়েছেন ফতমা।
আসলে কেউ কেউ প্রথা ভাঙবেন বলেই জন্মান। ফতমাও যেন অনেকটা তাই। সিনেমাকরিয়ের পাশাপাশি ফতমা ভারতীয় সিনেমায় বিখ্যাত হয়ে রইলেন আরও একটা কারণে। ফতমার কন্যা জুবেদা অভিনয় করলেন ভারতীয় সিনেমার প্রথম সবাক ছবি 'আলম আরা'-তে। ঘটনাচক্রে সেই ছবিটিও পরিচালনা করেন আরদাশির ইরানিই। ভারতীয় সিনেমার দুই মাইল ফলক ফতমা ও জুবেদাকে দর্শকের সঙ্গে পরিচয় করানোর জন্য ইতিহাসে থেকে গেলেন আরদাশির।
আরও পড়ুন: সৌন্দর্যের ধারণাকে সপাট সওয়াল! ভারতের প্রথম মহিলা কমেডিয়ান টুনটুনকে ভুলেছে বলিউড
আদর্শ বেঁচে থাকা আসলে কী? কারওর কাছে এর উত্তর হয়তো নিরালা সুখকোণে নিরুপদ্রব যাপন আর কারওর কাছে হয়তো দামী প্রতিমুহূর্তের উত্থান-পতন মাখা নাগরদোলা জীবনই। ফতমা পড়তেন দ্বিতীয় দলে। তাই নিজের জীবন নিয়ে পরীক্ষানিরিক্ষা করতে কখনও ভয় পাননি ফতমা। উর্দু রক্ষণশীল পরিবারে জন্ম, সেখান থেকে অভিনয়। প্রথা ভেঙে প্রযোজনা সংস্থা খোলা কিংবা পরিচালকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া। প্রায় প্রতিটি পদক্ষেপেই তিনি ছিলেন ব্যতিক্রমী। তার ব্যক্তিগত জীবনও কিছু কম রোমাঞ্চকর নয়। দুম করে সচিন-নবাবকে বিয়ে। তার উপর বিষপোকার মতো চেপে বসা কোনও এক অদ্ভুত চুক্তি, যার জোরে বিষ্যতে জুবেদা, সুলতানা ও শেহজাদিকেৃ নিজের মেয়ে বলে কোনওদিনই স্বীকৃতি দেননি নবাব। তা কি শুধুই কন্যাসন্তান বলে, না এর পিছনে লুকিয়ে ছিল অন্য কোনও রহস্য। তা জানা যায় না। তবে ব্যক্তিগত জীবন থেকে কর্মস্থল, প্রায় সমস্ত জায়গাতেই তিনি ছিলেন স্বয়ংসিদ্ধা। যার পাঁজরে ছিল সমস্ত রকমের প্রথা ভাঙার জোর। জীবনকে প্রতিমুহূর্তে চুটিয়ে বেঁচেছেন ফতমা। বেঁচেছেন নিজের শর্তে। পুরুষপ্রধান সিনেমার জগৎ থেকে শুরু করে পুরুষতন্ত্রমুখী সমাজ জীবন, ফতমা আসলে তেমনই এক স্পর্ধার নাম। যাঁরা বদলে দিতে পারে সময়, বদলে দিতে পারে ইতিহাস।