চিনা ভাষায় 'আই লভ ইউ' বলে শুরু হয়েছিল বাংলার প্রথম আইটেম সং! চমকে দেবে সেই ইতিহাস
Asha Bhosle: বাংলায় আশা ভোঁসলের প্রথম গান ছিল এইটিই
মানুষের একটা ধারণা আছে, আশার প্রথম বাংলা গান পঞ্চম, অর্থাৎ শচীনকত্তার পুত্র আরডি বর্মনের হাত ধরেই। অনেক জায়গায় অনেক প্রবন্ধেও এ-তথ্যর উল্লেখ দেখা যায়। তথ্যটা ঠিক নয়। আশার প্রথম বাংলা গান, মানে ছায়াছবির গান ভি বালসারার সুরে এবং পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়। সে গান গড়ে ওঠার পিছনে রয়েছে এক অদ্ভুত গল্প। এবং সেই গানের প্রথম পংক্তি লেখা হয়েছিল চাইনিজ ভাষায়। অবাক হচ্ছেন? দাঁড়ান, তবে ঘটনাটা খুলে বলি।
ভিয়েস্তাপ আদের্শির বালসারা, যাঁকে বাঙালি চিনত ভি বালসারা নামেই, তিনি কলকাতায় চলে এলেন হঠাৎ করেই। বন্ধুরা বলেছিল, "যাচ্ছ যাও! কিন্তু ওখানে বাঙালিরা তোমাকে টিকতে দেবে না।" ভিয়েস্তাপের সটান উত্তর ছিল, "টিকতে না দিলে চলে আসব।" বাবা বম্বের এক পার্সি শিক্ষক, ভিয়েস্তাপেরও রোজগার মন্দ নয়, বাড়িতে স্ত্রী-পুত্ররা রয়েছে। কিন্তু ১৯৫৪ সালে একটা শার্ট আর প্যান্ট কাগজে মুড়ে ভিয়েস্তাপ যখন কলকাতায় এলেন, তখন তাঁর পকেটে তিনটিমাত্র টাকা। উঠেছিলেন বো স্ট্রিটে পার্সি গেস্ট হাউসে। এরপর কী, জানা ছিল না। সেখান থেকে বিখ্যাত ভি বালসারা হয়ে ওঠার পথটাও খুব মসৃণ ছিল না। কঠোর পরিশ্রম করেছেন, বাংলা গড়গড় করে বলতে শিখেছেন, একের পর এক রবীন্দ্রসংগীত আয়ত্ত করেছেন পঙ্কজ মল্লিকের কাছে দিনরাত পড়ে থেকে। তা যে-সময়ের কথা, সেসময় বালসারা প্রতিষ্ঠিত। পাঁচের দশকের শেষ দিক। 'রাতের অন্ধকারে' ছবিতে ঠিক হলো, বালসারা সুর দেবেন। এই প্রথম বাংলা নেপথ্যসংগীত পরিচালনার দায়িত্ব পেলেন। সেই ছবির একটা বিশেষ ব্যাপার ছিল। বাংলা আইটেম সং। হ্যাঁ, ঠিকই শুনছেন। ১৯৫৯ সালে মুক্তি পাওয়া ছবি বিশ্বাস-অভিনীত সেই ছবিতে আইটেম নাচ নেচেছিলেন হেলেন। শুনে রক্ষণশীল বাঙালি নাক কুঁচকাতে পারেন, বিশ্বাস করা সত্যিই শক্ত, কিন্তু ছিল। তবে বাঙালি শ্রোতা-দর্শকরা তখনও আইটেম সং শুনতে অভ্যস্ত নন। কাজেই সেসময় গানটা বাঙালি দর্শকের গ্রহণযোগ্য করে পরিবেশন করাটা খুব একটা সহজ কাজ ছিল না।
আরও পড়ুন: কনসার্ট থেকে বিয়েবাড়ি- নেই সেই আবাহন, হারিয়েই যাবে বিসমিল্লার ‘পাগলা’ সানাই?
গান লেখার ভার এসে পড়ল পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওপর। পুলকবাবুর গান লেখার ক্ষমতা ছিল আশ্চর্য। কয়েক মুহূর্তে এমন কিছু গান লিখে দিয়েছেন, যা আজও বাঙালির বুকে কান পাতলেই শোনা যায়। কীভাবে লিখবেন তাই ভাবনাচিন্তা করলেন কিছুদিন। মূল গানটা বাংলায় মোটামুটি লিখে ফেলেছেন। কিন্তু আরও কিছু একটা দরকার। যেন একটা কিছু মিস করে যাচ্ছেন বারবার। এর মধ্যেই একদিন কী একটা কাজে গিয়েছেন বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট। চিনে জুতোর দোকানে। হঠাৎ কী মনে হলো, দোকানদারকে বললেন— সাহেব, বলো তো 'আই লভ ইউ'-টা চিনে ভাষায় কী হবে? শুনে সাহেবের কান এঁটো হাসি। দেখা গেল, একটা সোনা বাঁধানো দাঁতও রয়েছে। তাতে ঝিলিক খেলিয়ে সাহেব উত্তর দিলেন— সিন আই দ উ আই নি। ব্যাস, হয়ে গিয়েছে। খচখচানি গায়েব। পুলকবাবু দেখলেন চমৎকার ছন্দ। সেই মুহূর্তেই ঠিক হয়ে গেল গানটি শুরু হবে চিনা ভাষায়। বাড়ি এসে লিখলেন—'সিন আই দ্য/ উ আই নি/ চিনে ভাষা জানো কী?/ শোনো তবে, ইংরাজিতে তোমায় বলেছি/ ও মাই ডার্লিং আই লভ দি!' কী? গানের কথা শুনে কিছু মনে পড়ছে? এর প্রায় দুই দশক পরে বেরোবে সেই গান, 'আংরেজি মে কহতে হ্যায় আই লভ ইয়ু/ গুজরাতি মা বোলে…'— গানের গঠন প্রায় এক।
যাই হোক, পুলকবাবুর গানটা সবার খুব পছন্দ হয়ে গেল। বালসারা চমৎকার একটা সুর দিলেন। সেও লা জবাব। কিন্তু গাইবে কে? এই ধরনের গানে তখনও বাঙালি শিল্পীরা অভ্যস্ত নন। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় বেশ চিন্তায়। বালসারা আপন মনে দাঁত দিয়ে নখ কাটছেন। ওভাবেই বললেন— "আশা ভোঁসলে হলে চলবে? আমি ওঁকে কলকাতায় নিয়ে আসতে পারি, ওঁর সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুবই ভালো।" আরে তাই তো! এ-গানের জন্য আশা ছাড়া যোগ্য গায়িকা আর কেই-বা হতে পারে! সবার সম্মতি মিলল। আইটেম সং এবং আরেকটি রোমান্টিক গান— দু'টি গান গাওয়ার জন্য আশাকে রাজি করালেন বালসারা।
সব ঠিকঠাক এগোচ্ছে, হঠাৎ পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কেমন একটু সন্দেহ হলো। কিছুক্ষণের মধ্যে সেই সন্দেহ দুর্ভাবনার আকার নিল। ছটফট করছেন। ব্যাপার কী? না, ওঁর এক বন্ধু মানিক দত্ত, মানে অভিনেত্রী অনীতা গুপ্তের স্বামীর ঘটানো একটা ঘটনা তাড়া করে ফিরছে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়কে। মানিক দত্তর এক আত্মীয় বিয়ে করেছিলেন এক বিদেশিনীকে। সেই মহিলা বাংলা কিছুই জানেন না তখনও। আত্মীয়-বাড়িতে নেমন্তন্ন। পুলকবাবু গেছেন। মানিক দত্ত আলাপ করিয়ে দিচ্ছেন। পুলকবাবুকে চমৎকৃত করার জন্য মুকুলবাবু সেই বিদেশিনিকে ক'টা বাংলা কথা শিখিয়ে রেখেছিলেন। বলেছিলেন, 'হাউ ডু ইউ ডু'-র মতোই বাঙালি বাঙালিকে এই বলে সম্ভাষণ করে। বিদেশিনী অতিথিদের সামনেই পুলকবাবুকে চমকে দেওয়ার জন্য কিঞ্চিৎ বাংলা প্রয়োগ করলেন। মেমের মুখে পরিষ্কার বাংলায় সে শব্দগুলি শুনে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় দরদর করে ঘাম ছুটে গেল। আশেপাশের মেয়েরা ততক্ষণে কানে হাত দিয়ে সরে গিয়েছে। এদিকে মানিক দত্তর সে কি হাসি। বিদেশিনী অবাক। তখন তাঁকে জানানো হলো, সম্ভাষণ নয়, তাঁকে কিছু কাঁচা খিস্তি শিখিয়েছিলেন মুকুল দত্ত। সরল মনে মেম তাই বিশ্বাস করেছেন। মাঝখান থেকে ভরা সভায় পুলকবাবু বিনা দোষে গাল খেয়ে গেলেন। চিনা সাহেব সেরকম কিছু করেনি তো? চিনা ভাষা তো একবর্ণ জানেন না পুলক। ফের দৌড়লেন বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট। এবার অন্য জুতোর দোকান। দোকানে ঢুকেই দোকানদারকে বললেন, 'সিন আই দ্য উ আই নি'-র মানে কী বলুন তো?' ঝড়ের গতিতে দোকানে ঢুকে খদ্দেরের সেই প্রশ্নে অবাক সাহেব পাশে বসা যুবতীর দিকে তাকালেন। দেখা গেল চিনা যুবতীর ছোট ছোট দু'টি চোখ হাসিতে কুঁচকে গিয়েছে, গালে টোল। যা বোঝার, তখনই বোঝা হয়ে গিয়েছিল, তবু চিনা সাহেবকে সবটা খুলে বললেন পুলক। ইংরেজিতে একবার তর্জমা করতে অনুরোধ করলেন। সাহেব তাঁর চিনাবাজারি ইংরেজিতে সেটা অনুবাদ করলে, তবে দুশ্চিন্তা ঘুচল।
আশা তখন কলকাতায় এসে গিয়েছেন তাঁর প্রথম স্বামী ভোঁসলে সাহেবের সঙ্গে। 'মহারাষ্ট্র নিবাস'-এ ওঠার ইচ্ছে ছিল, সেইমতো নিয়ে যাওয়া হল। কিন্তু পছন্দ হলো না শিল্পীর। শেষে গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলে উঠলেন। পরদিন থেকেই বালসারার কাছে গান আর পুলকবাবুর কাছে বাংলা শেখা শুরু। প্রাণান্তকর পরিশ্রম করে বাংলাটা শেখানো গেল।
কাজ শেষে সন্ধেবেলা ওঁরা চৌরঙ্গীতে হাঁটতে বেরিয়েছেন। তখনও ঘরে ঘরে টিভি আসেনি। নেপথ্যসংগীত শিল্পীদের মুখ অত চিনত না লোকে। সুরকার বা গীতিকারদের তো নয়ই। কাজেই নির্বিঘ্নে চলাফেরা করা যেত। সেইখানেই আশা জানালেন সুধীন দাশগুপ্তের সুরে প্রথম বাংলা আধুনিক গানও রেকর্ড করতে চলেছেন আশা। কাজেই আশা ভোঁসলের প্রথম বাংলা ছবির গান, একটি আইটেম সং, বালসারার সুরে পুলকবাবুর কথায়। আর প্রথম আধুনিক বাংলা গান সুধীন দাশগুপ্তর সুরে। সেই এলপি-তে ছিল দু'টি গান। 'নাচ ময়ূরী নাচ রে' এবং 'আকাশে আজ রঙের মেলা'। আজও বিভিন্ন উৎসব প্রাঙ্গণ থেকে নিভৃত ঘরের কোণে বেজে চলে সেইসব গান। এরপরে বিনোদ চাটুজ্জের সুরে পবিত্র মিত্রর কথায় আরও দু'টি গান। মান্না দে-র সুরে পুলকবাবুর কথায়— 'যখন আকাশটা কালো হয় বাতাস নীরব থাকে' এবং 'আমি খাতার পাতায় চেয়েছিলাম একটি তোমার সই গো'। এতখানি পথ পেরিয়ে তারপরে পঞ্চমের সুরে বাংলা গান গেয়েছেন আশা।
শুধু ভি বালসারা বা আশাই নন, আরও বহু সুরকার এবং শিল্পীর প্রথম বাংলা গান পুলকবাবুর হাত ধরেই। সেকালের নামীদামি শিল্পী থেকে অলকা ইয়াগনিক, কবিতা কৃষ্ণমূর্তি পর্যন্ত— আসলে এতটা সময় ধরে পুলকবাবু গান লিখেছেন, যে টানা কয়েক দশক নানা নতুন শিল্পী-সুরকারদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। 'আমায় বাহারি সেই ঝুমকো এনে দে রে' আর 'বুঝি না এ ভালবাসায়'— দক্ষিণামোহন ঠাকুরের সুরে পুলকবাবুর কথায় ঊষা মঙ্গেশকরের প্রথম বাংলা গান। সুমন কল্যাণপুর, অধীর বাগচী, ঊষা উত্থুপ, দীপা নারায়ণ, বাণী জয়রাম— প্রত্যেকের বাংলা গানে পদার্পণ পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে। এমনকী, চিত্রা সিং-জগজিৎ সিং আর অনুপ জলোটারও প্রথম বাংলা গান রচনা করছিলেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলা গানের জগতে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় এক আশ্চর্য নাম। ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেওয়ার আগেই ছবির জন্য গান লিখেছেন— এমন চরিত্র বোধহয় বাংলা গানের জগতে দুটি নেই। বাঙালির ইতিহাস, কৃষ্টির সঙ্গে পরতে পরতে মিশে গিয়েছে সেই সব গান। গীতিকার খ্যাতি তো পান না, পরিচিতিও পান না তেমন। কাজেই কাজের ফাঁকে ফাঁকে গুনগুন করা মানুষটিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জানেন না, এই গান কার লেখা। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় এভাবেই অলক্ষে অথচ ভরপুর থেকে গিয়েছেন মধ্যবিত্ত নিঃশ্বাসে। তাঁর গানের সঙ্গে প্রেমে জড়িয়েছে বাঙালি। আবার বাঙালির মধ্যবিত্ত মন জড়িয়েই নিজস্ব অস্তিত্ব নির্মাণ করেছে সেইসব গান, প্রজন্মের পর প্রজন্ম। আজ বলা মুশকিল, কে কাকে গ্রহণ করেছিল। পুলকবাবুর কথারই যেন প্রতিধ্বনি,
কে প্রথম কাছে এসেছি,
কে প্রথম চেয়ে দেখেছি,
কিছুতেই পাই না ভেবে
কে প্রথম ভালোবেসেছি,
তুমি না আমি?