১৯৩০-এর প্রথম বিশ্বকাপ! ইওরোপের মুখে সেবার চুনকালি মাখিয়েছিল আর্জেন্টিনা-উরুগুয়ে!

Football World Cup 1930: ইতালি সেই মুসোলিনির আমল থেকেই ফুটবলের মক্কা বলে পরিচিত। পৃথিবীর আর কোথাও খেলোয়াড়দের এত টাকা দেওয়া হয় না।

১৯৩০-এর বিশ্বকাপ

ভয়াবহ ভূমিকম্পে ধূলিসাৎ হয়ে গেল দক্ষিণ ইতালির বিস্তীর্ণ অঞ্চল, নেপলসের প্রায় ১৫০০ মানুষ বেঘোরে মারা গেলেন, ‘ব্লু এঞ্জেল’-এ মার্লিন ডিয়েট্রিশ গাইলেন নীল দেবদূতের কথা, রুশ বিপ্লবের গর্ভ থেকে উঠে এসে স্তালিন বেছে বেছে নিজের পথের কাঁটা সরিয়ে প্রায় নিরঙ্কুশ ক্ষমতাধর হয়ে উঠছে, কবি ভ্লাদিমির মায়াকভস্কি আত্মহত্যা করছেন। সাহেবরা মহাত্মা গান্ধীকে জেলে ভরছে, সেই গান্ধী যিনি দেশের মানুষকে অহিংসার শক্তিতে এমনই বলীয়ান করেছিলেন যে স্বাধীনতার দাবিতে, ইংরেজ অপশাসনের বিরুদ্ধে, গোটা ভারত স্তব্ধ করে দেবার ক্ষমতা রাখতেন। ওই স্বাধীনতার মন্ত্রেই আমাদের দিকের দুনিয়ায়, অগুস্তো সিজ়ার সানদিনো মার্কিনি হানাদারদের বিরুদ্ধে নিকাগুয়ার চাষাভুষো মানুষকে জাগিয়ে তুলছেন। জবাবি হানায় মার্কিন নৌ-বহর ক্রমাগত ফসল জ্বালিয়ে চলেছে যাতে নিকারাগুয়ার মানুষকে ভাতেও মারা যায়।

যুক্তরাষ্ট্রে তখন বুগি-উগি নাচের নতুন হিড়িক উঠেছে। কিন্তু হিমশীতল জোরালো এক ঘুষি মেরে দ্বিতীয় দশকের উল্লাসের নাক ফাটিয়ে রক্ত বের করে দিয়েছে ১৯২৯-এর সংকট। ওয়াল স্ট্রিটের নিউ ইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জ যখন শুয়ে পড়ল, দুনিয়ার যাবতীয় পণ্যের দাম তো ধসে পড়লই, সেইসঙ্গে লাতিন আমেরিকার একাধিক দেশের সরকারকেও রসাতলে টেনে নিয়ে গেল। টিনের দাম এমন গোঁত্তা খেল যে বলিভিয়ার রাষ্ট্রপতি হেরনান্দো সিলেস কোনওমতেই টাল সামলাতে পারল না, তার জায়গা দখল করে বসল এক সামরিক প্রধান। ওদিকে মাংস আর গমের দামের ধাক্কায় টলে গেল আরহেন্তিনার ইপোলিতো ইরিগোসেনের গদি, সেখানেও এসে বসল আরেক সামরিক শাসক। দোমিনিকান প্রজাতন্ত্রে আখ আর চিনির দামে বিপুল পতন সেদেশের ভাগ্যে লিখে দিল একের পর এক, চক্রাকারে, স্বৈরাচারী শাসকের জমানা। রাফায়েল লেওনিদাস ত্রুহিয়ো থেকে সেই ইতিহাসের শুরু। ত্রুহিয়ো ক্ষমতার স্বাদ পেয়েই স্বৈরাচারীর ধর্ম মেনে রাজধানী-বন্দর ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলির নাম রীতিমতো ঘটা করে পালটে নিজের নামে করে নেয়।

উরুগুয়েতে অবিশ্যি পরবর্তী তিন বছরের মধ্যে কোনও অভ্যুত্থান হয়নি, ফলে সরকারের গদি উল্টোয়নি। দেশের সব নাগরিকের চোখ-কান তখন কেবলই প্রথম ফুটবল বিশ্বকাপের দিকে। আগের দুটো অলিম্পিকে ফুটবলে সোনা জেতার পর উরুগুয়ে তখন নিশ্চিতভাবেই বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য প্রথম পছন্দ।

মন্তেভেদিয়োর বন্দরে বারোটি দল এসে নামল। সব ক'টা ইওরোপীয় দেশকেই আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। কিন্তু মাত্রই চারটি দল সমুদ্র পেরিয়ে এই দূর দক্ষিণ-সৈকতে এসে উপস্থিত হয়েছিল। তারা হয়তো ভেবেছিল, "সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে ওই ধ্যাড়ধেড়ে গোবিন্দপুরে কে যাবে?" আর তাছাড়া, "অতদূর যাওয়ার রাহাখরচই বা জোগাবে কে?"

আরও পড়ুন- ‘খেটে খাওয়া’দের শিল্প! বরফ বিক্রি, জুতো পালিশ করা, মাংস কাটা ছেলেরাই জিতিয়েছিল দেশকে

একটা জাহাজে করে ফ্রান্স থেকে এল জুলে রিমে ট্রফি, সঙ্গে এলেন ফিফা সভাপতি শ্রীযুক্ত জুলে রিমে স্বয়ং, আর তার পিছুপিছু উদাসীন একটা ফরাসি ফুটবল দল।

বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে বিপুল গণউন্মাদনার মধ্যে উদ্বোধন হল ফুটবলের প্রথম বিশ্বকাপের জন্য আট মাস ধরে গড়ে তোলা সৌধটি। স্টেডিয়ামটার নাম দেওয়া হল সেন্তেনারিয়ো। সেই বছরটা ছিল আমাদের দেশের সংবিধানের শতবর্ষ সেই অসামান্য সংবিধান যা নারী, নিরক্ষর আর গরিব-গুর্বোদের সমস্ত নাগরিক অধিকার হরণ করেছিল। ফাইনালে যেদিন উরুগুয়ে আর আরহেন্তিনা মুখোমুখি দাঁড়াল, সেদিন স্টেডিয়ামে একটা সূঁচ গলবারও জায়গা ছিল না। গোটা স্টেডিয়ামটা মনে হচ্ছিল যেন ফেল্টের টুপি আর তেঠেঙে ট্রাইপডে বসানো ক্যামেরার পেছনে কালো কাপড়ের ঢাকনার সমুদ্র। সেদিন দুই গোলকিপারই মাথায় টুপি পরে নেমেছিল, আর রেফারি পরেছিল হাঁটুর নীচে চার ইঞ্চি পর্যন্ত ঝোলা কালো রঙের প্লাস-ফোর প্যান্ট।

১৯৩০-এর বিশ্বকাপ ফাইনালের বরাতে ইতালির দৈনিক সংবাদপত্র লা গেজ়েত্তা দেল্লো স্পোর্ত-এ কুড়ি লাইনের একটা কলামের বেশি কিছু জোটেনি। যত যাইহোক, এও যে ১৯২৮-এর আমস্টারডাম অলিম্পিকেরই পুনরাবৃত্তি, রিভার প্লেটের দুটো দেশ ইওরোপের মুখে চুনকালি মাখিয়ে ফের বুঝিয়ে দিয়েছিল দুনিয়ার সেরা ফুটবলটা কোথায় খেলা হয়। ১৯২৮-এর মতোই আরহেন্তিনা রানার্স হয়। উরুগুয়ে খেলার প্রথম অর্ধে ২-১ গোলে পিছিয়ে ছিল, কিন্তু শেষমেশ ৪-২ গোলে জিতে বিশ্বজয়ীর খেতাব ছিনিয়ে নেয়। ফাইনালের দিন খেলিয়েছিল বেলজিয়াম থেকে আসা রেফারি জন ল্যাঞ্জেনাস। তার বিশেষ কোনও চাহিদা ছিল না, বাড়তি বলতে কেবল একটা জীবনবিমার পলিসি দাবি করেছিল। যদিও খেলার মাঝে গ্যালারিতে টুকটাক ঝামেলা ছাড়া বিরাট কোনও গণ্ডগোল সেদিন হয়নি। অবিশ্যি বুয়েনস আইরেসে উরুগুয়ের দূতাবাসে এন্তার পাথরবৃষ্টি হয়।

তৃতীয় স্থান পেয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ওদের দলে স্কটল্যান্ড থেকে সদ্য আসা বেশ কয়েকজন অভিবাসী ছিল। চতুর্থ হয় য়ুগোশ্লাভিয়া। প্রথম বিশ্বকাপে একটা ম্যাচও অমীমাংসিতভাবে শেষ হয়নি। আরহেন্তিনার স্তাবিলে আটটা গোল করে টুর্নামেন্টের সেরা গোলদাতা হয়, তারপরেই পাঁচটা গোল ছিল উরুগুয়ের সেআ-র। ফ্রান্সের লুই লরাঁ মেহিকোর বিরুদ্ধে বিশ্বকাপের ইতিহাসে প্রথম গোলটি করে।

আরও পড়ুন-উড়ন্ত গোল করতে করতেই মারাত্মক সংঘর্ষ, বাইসাইকেল কিক কেড়েছিল ফুটবলারের প্রাণ 

নাসাৎসি

ওকে এক্স রে-ও নাকি ভেদ করতে পারত না। সবাই বলত, ‘মূর্তিমান ভয়ংকর’। "মাঠটা আসলে একটা কাচের বয়ামের মতো" সে বলত, আর "পেনাল্টি বক্সটা সেই বয়ামের সরু মুখ"। পেনল্টি বক্সের কয়েক গজে তাকে রাজা বলা হতো।

হোসে নাসাৎসি ছিল ১৯২৪, ’২৮, ’৩০-এর উরুগুয়ে ফুটবল দলের অধিনায়ক। উরুগুয়ের ফুটবলে প্রথম সর্বজনমান্য নেতা। গোটা দলের ইঞ্জিনও বলা চলে। বাকি দশজন নাসাৎসিরই ছন্দে ঘুরপাক খেত। খেলোয়াড়দের সাবধান করে তার চিৎকারে, হতাশায়, উৎসাহে আবর্তিত হত দলটা। তার নামে কেউ কখনও কোনও অভিযোগ শোনেনি।

কামু

১৯৩০-এ আলব্যের কামু সন্ত পিটারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে আলজিরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুটবল দলের গোলের দরজা সামলাচ্ছিলেন। খুব ছোটোবেলা থেকেই কামু পাড়ার ফুটবল দলের গোলকিপার, কারণ খেলোয়াড়দের মধ্যে একমাত্র গোলকিপারের জুতোই সবচেয়ে কম ছেঁড়ে। কামু এতটাই দরিদ্র ঘরের সন্তান যে প্রাণখুলে ফুটবল মাঠে দৌড়তেও পারেননি। ওটা তাঁর পক্ষে বাড়াবাড়ি রকমের বিলাসিতা হতো। প্রতিরাতে ছোট্ট আলব্যেরের ঠাকুমা নাতির জুতোর শুকতলা পরীক্ষা করে দেখতেন। জুতোর তলাটা কোনও কারণে ছিঁড়ে-টিড়ে গেলে বেচারার কপালে ঠ্যাঙানি জুটত।

খেলার মাঠে জালের সামনে দাঁড়িয়ে কামু জীবনের অন্ধিসন্ধি সম্পর্কে বেশ পোক্ত হয়ে ওঠেন, "আমি দিব্যি বুঝে গিয়েছিলাম, আপনি ঠিক যেখানে বলটাকে প্রত্যাশা করছেন, সে কখনই সেখানে পৌঁছবে না। এই বোধ থেকে জীবনে আমার প্রচুর উপকার হয়েছে। বিশেষ করে বড় শহরগুলোয় দেখেছি মানুষ মুখে যা বলে, কাজে তা কখনই করে না। কথায় কাজে ফারাক রেখে চলাই বড় শহরের মানুষের ধর্ম।"

ফুটবলই তাঁকে শিখিয়েছিল জিতলে যেমন কেউ ভগবানের সমকক্ষ হয় না, তেমনই হারলে নিজেকে আবর্জনা ভাবারও কোনও কারণ নেই। খেলায় একদিনে পারঙ্গম হওয়া যায় না, দক্ষতা অর্জন করতে সময় লাগে। ফুটবল মাঠ কামুকে শিখিয়েছে মানবহৃদয়ের নানা জটিল রহস্যের প্যাঁচ খুলে অন্তরাত্মার কাছাকছি পৌঁছতে। সেইসব গোলকধাঁধার গ্রন্থি খুলে তিনি ক্রমশ এগিয়ে গেছেন সাদা পাতার উপর এক বিপজ্জনক অভিযাত্রায় যার পোশাকি নাম হলো লেখা।

দুর্দমনীয় শক্তি

উরুগুয়ের বিশ্বজয়ী ফুটবল দলের খেলোয়াড় ‘পেরুচো’ পেত্রনে ব্যাগ গুছিয়ে চলে গিয়েছিল ইতালিতে। ১৯৩১-এর যে বিকেলে পেত্রনে প্রথমবার ফিয়োরেন্তিনার হয়ে ইতালির মাঠে নামে, সেদিন একাই এগারোটা গোল করেছিল।

তবে বেশিদিন সে ইতালিতে টিকতে পারেনি। ইতালির ঘরোয়া চ্যাম্পিয়নশিপে সে তখন সর্বোচ্চ গোলদাতা, ফিয়োরেন্তিনা যেকোনও মূল্যেই তাকে দলে রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু পেত্রনে ফ্যাসিবাদের উত্থানের কাড়ানাকাড়ার আওয়াজে দ্রুত ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। বিরক্ত এবং একইসঙ্গে স্মৃতিকাতরও। তাই সে মন্তেভেদিয়োয় ফিরে চলে এসে ফের ফুটবল মাঠে ঘাসের বুকে আগুন জ্বেলে দেওয়া শটে গোল করতে থাকে। সে তখন তিরিশের কোঠায়ও পৌঁছয়নি, যখন ফিফার অমানবিক সিদ্ধান্তে তাকে খেলা ছাড়তে হয়। ফিয়োরেন্তিনার সঙ্গে চুক্তিভঙ্গ করায় ফিফা তার পা থেকে জোর করে বল কেড়ে নেয়। লোকে বলে পেত্রনের শট নাকি পাকা দেওয়ালও ভেঙে দিতে পারত। কে জানে, হবেও বা! কিন্তু একটা ব্যাপার নিশ্চিত, গোলমুখে তার শট গোলকিপারকে উড়িয়ে দিয়ে জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে যেত।

এদিকে, রিভার প্লেটের উলটো দিকের সৈকতে, আরহেন্তিনার বেরনাবে ফেরেইরা এমন গোলার মতো শট দাগত মনে হতো ওর উপরে বুঝি কোনও দেবতা ভর করেছে। সব দলের সমর্থকরাই এই ‘বুনো জন্তুর’ খেলা দেখতে ছুটত। সে একটু নীচের দিক থেকে শুরু করত, তারপর দ্রুত প্রতিপক্ষের রক্ষণ চিরে যখন গোলে শট নিত, বল আর গোলকিপার একসঙ্গে জালে জড়িয়ে যেত।

খেলার শুরু আর শেষে, হাফটাইমেও, দর্শকেরা বেরনাবের গোলন্দাজের মতো শট নেওয়ার ক্ষমতাকে সম্মান জানিয়ে লাউডস্পিকারে একটা বিশেষ ট্যাঙ্গো বাজাত। ১৯৩২-এ হল কী, ক্রিতিকা সংবাদপত্রের তরফে একটা বড়সড় পুরস্কার ঘোষণা করা হল। যে গোলকিপার বেরনাবের গোল ঠেকাতে পারবে, তাকেই পুরস্কৃত করা হবে বলে ঘোষণা করা হয়। সেবছরই একদিন বিকেলে বেরনাবে একদল সাংবাদিককে জুতো খুলে দেখায় যে তার ভেতরে আদৌ কোনও লোহার পাত ভরা নেই।

আরও পড়ুন- ১১ জন ফুটবলারকেই পাহাড়ের চুড়োয় দাঁড় করিয়ে গুলি করে মেরেছিল হিটলারের দল

পেশাদারিত্ব

ইতালির লাজিও, ফিয়োরেন্তিনা, এসি মিলান, সাম্পদোরিয়ার মতো ক্লাবগুলোর বিরুদ্ধে রেফারি, লাইন্সম্যান এবং আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের হাত করে ম্যাচ গড়াপেটার অভিযোগ ওঠে। এই অভিযোগ সামলাতে শেষ পর্যন্ত ‘পরিচ্ছন্ন হাত আর পা’ শ্লোগান দিয়ে সিরি আ-তে পুনরায় সুস্থ ফুটবল চালু করার ডাক দিতে হয়। বড় বড় ক্লাবের কর্তারা এই কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে ছিল। যদিও ফুটবল এখনও ইতালির প্রথম দশটি অর্থকরী শিল্পের একটি। আর দেশটা দক্ষিণ আমেরিকার খেলোয়াড়দের যেন চুম্বকের মতো টানে।

ইতালি সেই মুসোলিনির আমল থেকেই ফুটবলের মক্কা বলে পরিচিত। পৃথিবীর আর কোথাও খেলোয়াড়দের এত টাকা দেওয়া হয় না। ফলে অন্য দেশের খেলোয়াড়রা দলের সঙ্গে মনোমালিন্য হলেই, ‘রইল ঝোলা, চলল ভোলা’ বলে ইতালি চলে যাবার হুমকি দেয়। আর এতে কাজও হয় ম্যাজিকের মতো। কর্মকর্তাদের টাকার থলের ফাঁস অবলীলায় ঢিলে হয়ে যায়। কেউ কেউ সত্যি পালায়। বুয়েনস আইরেস, মন্তেভেদিয়ো, সাও পাওলো, কিংবা হিউ দে জেনেইরো থেকে জাহাজে চড়ে বসে। এদের মধ্যে যাঁদের ইতালীয় বাপ-মা বা ঠাকুরদা-ঠাকুমা নেই তারা ওখানে গিয়েই সবার আগে আত্মীয়তার সুতোয় পরিবার গড়ে নেয়, যাতে তৎক্ষণাৎ নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করা যায়।

খেলোয়াড়দের এই মহাভিনিষ্ক্রমণ অবিশ্যি আমাদের দেশে পেশাদার ফুটবলের জন্মের পিছনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। ১৯৩১-এই আরহেন্তিনায় পেশাদারি ফুটবল চালু হয়, উরুগুয়েতে চালু হয় পরের বছর। ব্রাজ়িলে পেশাদার লিগ চালু হয় ১৯৩৪ সালে। পেশাদার লিগ চালু হওয়ায় টেবিলের তলা দিয়ে খেলোয়াড়কে টাকা ধরানো বন্ধ করে আইনসিদ্ধভাবে টাকা দেওয়ার বন্দোবস্ত হয়। তবে খেলোয়াড়ও কিন্তু এরপর থেকে কর্মী হয়ে গেল। স্বাধীনতা গেল হারিয়ে। চুক্তিপত্রগুলো ক্লাবের সঙ্গে খেলোয়াড়দের সর্বক্ষণ, সারা জীবনের মতো, কঠিন বাঁধনে বেঁধে ফেলল। সে আর কিছুতেই দল বদলাতে পারত না, যতক্ষণ না দল নিজেই তাকে বেচে দিচ্ছে। কারখানার শ্রমিকের মতো, খেলোয়াড়রা নির্দিষ্ট মজুরির বিনিময়ে নিজেদের শক্তিক্ষয় করতে লাগল। তারা মাঠে নেমে ততটাই বন্দিদশায় কাটাতে লাগল, যতটা বন্দিত্ব ক্রীতদাসদের সহ্য করতে হয় জমিদারের খাসতালুকে। যদিও শুরুর দিকে পেশাদার ফুটবলের বায়নাক্কা এত ছিল না, কেবল হপ্তায় দু' ঘণ্টার বাধ্যতামূলক অনুশীলন। আরহেন্তিনায় যদি কেউ ডাক্তারের নিদান ছাড়া অনুশীলন কামাই করত, তাহলে তার পাঁচ পেসো জরিমানা হত।

 

More Articles