দেশের প্রথম পোস্টমর্টেম করেন এক বাঙালি, মেডিকেল কলেজের যে ইতিহাস শিহরিত করে আজও

Madhushudan Gupta, Kolkata Medical College : ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের ১৭ মার্চ তিনি যোগ দেন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে, এখানে থেকেই দেশের ইতিহাসে শব ব্যবচ্ছেদের নজির গড়েন মধুসূদন গুপ্ত।

স্বাভাবিকের থেকে এক চুল এদিক ওদিক হলেই হুকুম ময়নাতদন্তের। মৃত্যুর সঠিক কারণ জানতে এর চেয়ে ভালো উপায় আর কিছুই নেই। অপরাধ জগৎকে কড়া শাস্তির দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে তাই অস্বাভাবিক মৃত্যুর ময়না তদন্ত অথবা পোস্টমর্টেম জরুরি। কিন্তু কবে থেকে শুরু হল এই পদ্ধতি, কীভাবেই বা চিকিৎসা বিজ্ঞানের একটা গুরুত্বপূর্ণ ধারা হিসেবে জায়গা করে নিল এটি সেই ইতিহাসের হদিশ পেতে ফিরে যেতে হবে আজ থেকে প্রায় দুশো বছর আগে।

সময়টা ১৮৩৬ সাল। কলকাতা মেডিকেল কলেজের শব রাখার ঘরের সামনে উপচে পড়ছে ভিড়, কোথাও তিল ধারনের জায়গা নেই। ইতিমধ্যেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে কলেজের সব ফটক। ফটকের বাইরে চোখ রাঙাচ্ছে তৎকালীন হিন্দু গোঁড়া সমাজের নিয়মের বেড়াজাল। আর ভিতরে তৈরি হচ্ছে নতুন ইতিহাস। নিয়মের চোখে চোখ রেখেই।উপস্থিত রয়েছেন কলেজের সমস্ত শ্বেতাঙ্গ অধ্যাপক এবং ডাক্তরেরা। সঙ্গী ছাত্রবন্ধুরা ভিড় করে দাঁড়িয়ে রয়েছেন দরজার বাইরে। প্রত্যেকের শিরা দিয়েই দ্রুত রক্ত চলাচল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দরজার দিকে। অবশেষে অপেক্ষা ভেঙে দরজা ঠেলে বেরিয়ে এলেন একজন বাঙালি। বলা ভালো, তৎকালীন হিন্দু সমাজের চোখে চোখ রেখে একটা ইতিহাস হাতে করে বেরিয়ে এলেন তিনি। সেই প্রথম কলকাতা সাক্ষী থাকল শব ব্যবচ্ছেদ অর্থাৎ ময়নাতদন্তের।

আরও পড়ুন - ‘ফেক নিউজ’ তাড়া করেছিল স্বয়ং বিদ্যাসাগরকেও! যে গুজবে তোলপাড় হয়েছিল পুরনো কলকাতা

কিন্তু কে এই বাঙালি? বিস্মৃতির আড়ালেই রয়েছেন একদা কলকাতার বুকের ইতিহাস তৈরী কর ব্যক্তি মধুসূদন গুপ্ত। সেদিনের ওই কাজে অবশ্য তিনি একা নন, সঙ্গে থাকার কথা ছিল উমাচরণ শেঠ, রাজকৃষ্ণ দে, দ্বারকানাথ গুপ্ত ও নবীন চন্দ্র মিত্রের, যদিও নির্ধারিত সময়ে ঘরের দরজা ঠেলে সাহস করে কেউই প্রবেশ করতে পারলেন না। একে তো তৎকালীন হিন্দু সমাজের চোখ রাঙানি তার ওপর আবার মৃতদেহ, অশরীরী আত্মা কাটা ইত্যাদি সংস্কার সব মিলিয়ে দরজার বাইরে ভিড়ের ভিতর আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন তাঁরা। একাই দৃপ্ত ভূমিকায় এগিয়ে গেলেন মধুসূদন দত্ত। হাতে তুলে নিলেন শবদেহ কাটার ছুড়ি। নির্ভুলভাবে প্রবেশ করলেন মৃতদেহে। মুখে আড়ষ্ঠতা অথবা অসংলগ্নতার লেশ মাত্র নেই। নিখুঁত দক্ষতায় শেষ করলেন শব ব্যবচ্ছেদের কাজ। আমাদের দেশে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে বিজ্ঞানী শুশ্রূতের পরে এই প্রথম হল শবব্যবচ্ছেদ। দীর্ঘকালের কুসংস্কার এবং গোঁড়া সমাজের বিপরীতে দাঁড়িয়ে নতুন সূর্যোদয় ঘটালেন এক বঙ্গসন্তানই।

একদা সংস্কৃত কলেজের আয়ুর্বেদ বিভাগের ছাত্র পণ্ডিত মধুসূদন গুপ্ত। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে হুগলি জেলার বৈদ্যবাটির এক বৈদ্য পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বৈদ্য পরিবার শুনেই পাঠক হয়তো আঁচ করতে পারছেন পারিবারিক চিকিৎসার একটা পরম্পরার কথা। তাই সেই পরিবেশেই বেড়ে ওঠা মধুসূদনের। তবে কিশোর বয়সে পড়াশোনায় অমনোযোগী হওয়ার কারণে তার বাবা তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেন। তখন কি আর তিনি জানতেন একতার সেই ছেলেই তিলোত্তমার বুকে এমন একটা সাড়া জাগানো ইতিহাস তৈরি করবে! বাবার বিরুদ্ধে এক প্রকার জেদ করেই পড়াশুনায় মনোযোগ দেন কিশোর মধুসূদন। কেবলরাম কবিরাজ নামে এক আয়ুর্বেদিক বৈদ্যের কাছে দেশজ পদ্ধতিতে রোগ নির্ণয় করার আর ওষুধপত্র দেবার বিধি-বিধান সম্বন্ধে হাতেকলমে শিক্ষা নেন। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে আয়ুর্বেদ চিকিৎসা করতে শুরু করেন তিনি। অবশেষে ১৮২৬ সাল নাগাদ ভর্তি হন সংস্কৃত কলেজের আয়ুর্বেদ বিভাগে।

আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে এর আগে থেকেই সদিচ্ছা ছিল মধুসূদনের, তাই খুব কম দিনের মধ্যেই এই বিষয়ে পারদর্শী হয়ে উঠলেন তিনি। এর পাশাপাশি হিউম্যান অ্যানাটমি বা দৈহিক গঠনতন্ত্র বিষয়েও গভীর আগ্রহ ছিল তাঁর। আয়ুর্বেদ ক্লাস করাকালীনই তিনি কৃত্রিম হাড়গোড় কেটে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে থাকেন। পাশাপাশি ছোটখাটো জীবজন্তুদের শরীর ছেদ করেও নিজের ইচ্ছাশক্তিতে শান দিতে থাকেন। এর ঠিক চার বছর পর অর্থাৎ ১৮৩০ সালের মে মাসে সংস্কৃত কলেজের আয়ুর্বেদ বিভাগের অধ্যাপক ক্ষুদিরাম বিশারদ অসুস্থ হয়ে পড়লে কৃতী ছাত্র মধুসূদন গুপ্তকে মাসিক ৩০ টাকা বেতন্ড সেই পদে নিয়োগ করা হয়। তবে কলকাতা মেডিকেল কলেজের সঙ্গে তাঁর যোগ আরও কিছুটা পরে। সংস্কৃত কলেজের আয়ুর্বেদ বিভাগটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর প্রথমে নেটিভ মেডিক্যাল ইনস্টিটিউশনে যোগ দেন তিনি। অতঃপর ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের ১৭ মার্চ যোগ দেন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে।

যোগ দেওয়ার মাত্র এক বছরের মাথাতেই বিপ্লব ঘটালেন মধুসূদন। হিন্দু সমাজের সমস্ত গোঁড়ামি, রক্ষণশীলতার রক্তচক্ষুর বিপরীতে দাঁড়িয়ে আলোচনায় আনলেন শব ব্যবচ্ছেদ বিষয়টি। অ্যানাটমি টেবিলে মৃত মানুষের শরীর ব্যবচ্ছেদ না করতে পারলে শারীরবিদ্যার জ্ঞান যে সম্পূর্ণ হবে না, একথা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন মধুসূদন গুপ্ত। কিন্তু সেই সমাজ এই কথা মানলে তো! তখনও বিধবা বিবাহ প্রচলিত নেই সমাজে। কুলীন বামনের বহুবিবাহ চলছে পুরোদস্তুর। জাতপাতের গণ্ডিতে শতচ্ছিন্ন এই সমাজে বেওয়ারিশ মরা ছোঁয়া মানেই তখন সমাজে পতিত হওয়া, তাই সাহস করে এগিয়ে আসতে পারলেন না অনেকেই। মেডিকেল কলেজ অবশ্য জায়গা করেন দিলেন মধুসূদন গুপ্তকে। ইতিহাস তৈরির জন্য উপযুক্ত পরিসরটুকুই খুঁজেছেন তিনি। অবশেষে ১৮৩৬ সালে রচিত হল নয়া ইতিহাস। শব ব্যবচ্ছেদ বা হাল আমলের পোস্টমর্টেম।

আরও পড়ুন - নীলদর্পণের সঙ্গে জড়িয়ে কলকাতার রাস্তা! জেমস লং সরণির নামকরণ হয়েছিল কার নামে?

যদিও এই ইতিহাস তৈরির যাত্রাপথ খুব একটা সুগম ছিল না। বারবার বাধার মুখোমুখি পড়তে হয়েছে হিন্দু বৈদ্য ঘরের ছেলে মধুসূদন গুপ্তকে। তবে সেই সময় তাঁর পাশে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন স্বয়ং ডেভিড হেয়ার। মুখোমুখি রাধাকান্ত দেব। শর্ত দিলেন, সনাতন ভারতীয় শাস্ত্রে শব ব্যবচ্ছেদের সমর্থনে যদি কেউ সূত্র দেখাতে পারেন তবে এই বিষয়ে এগনো যায়। মধুসূদন গুপ্ত পন্ডিত মানুষ, সংস্কৃত শাস্ত্রেও তাঁর অগাধ জ্ঞান। রাতের পর রাত জেগে পুঁথি উলটে খুঁজে বের করলেন সেই সূত্র। দায়ে পড়ে ঢেঁকি গিলতে বাধ্য হলেন রাধাকান্ত দেব। অতঃপর আলোর মশাল হাতে নতুন ইতিহাসের পথে এগোলেন মধুসূদন।

এই ঘটনার পর চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসের রীতিমতো সারা জাগিয়ে তোলেন বৈদ্যবাটির মধুসূদন গুপ্ত। বাঙ্গালীদের কথা মাথায় রেখে তিনি বাংলাতেই ডাক্তারি স্বাস্থ্য পড়ানোর কাজ শুরু করেন মেডিকেল কলেজে। ১৮৫৩ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘অ্যানাটমি’ নামক বইটি। এমনকী অ্যানাটমি-কে যে বর্তমানে বাংলায় ‘শারীরবিদ্যা' বলে অভিহিত করা হয় সেই শব্দের সূত্রপাত হয় তাঁর হাত ধরেই। অবশেষে ১৮৫৬ সালের ১৫ই নভেম্বর মৃত্যু হয় মধুসূদন গুপ্তের। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে এই নাম আজও উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

More Articles