গাঙ্গেয় : অভিষেক ঝা

Bangla Short Story: "তুমি বাংলাকেই ঠিক করে চেনো না কারণ তুমি একটা মণ্ডল। খুবই ডাইসি সারনেম। এসসি হতে পারো, রিফিউজিও হতে পারো, ওবিসিও হতে পারো, আবার পিওর বাংলাদেশিও হতে পারো।"

“ছেলের উপর এতক্ষণ তাহলে বেফালতুই রাগ করছিলেন মিশ্রাজি। দিমাগ তেজ আছে আপনার লড়কার। খাটারা পিত্তল আর সস্তার খদ্দর দিয়ে মুড়েছে আপনাকে। চাঁদি আর সিল্ক দিলে এতক্ষণ আপনি চতুর্বেদীজির মতো মাঝরাস্তাতেই খতম।”

“সেই সাহেবগঞ্জ থেকে দেখা হওয়া ইস্তক তোমায় বলছি আমার সঙ্গে পিওর বাংলায় কথা বলো। কী একটা অদ্ভুত জগাখিচুড়ি ভাষায় কথা বলে যাচ্ছ। এই নিয়ে তোমায় টোয়েন্টিথ টাইম জানাচ্ছি…”

“আপনার চাচার শ্বশুরের চাচাতো মামা বাঙ্গালে দ্বারভাঙ্গার মহারাজের বাড়ি জমিনের শুধু উকিলই ছিলেন না, দার্জিলিং-এ দ্বারভাঙা মহারাজের মেয়ে খুদখুশি করেছিল যখন তিনিই সবদিক সামলেছিলেন। আপনার দাদাজি বহরমপুরে সংস্কৃত পড়াতেন। আপ নিজে দ্বারভাঙ্গার কোনও কলেজে ইংলিশের প্রফেসরসাব। কলকাত্তায় পড়েছেন। সাহিবগঞ্জে আপনার শালীর নার্সিংহোম। আর জি করে আপনার শালা না কে একটা ডাক্তার ভি ছিল। বেঙ্গলিদের সাথে আপনাদের খানদানের প্রচুর বিহাশাদি। বাঙ্গালের সাথে আপনাদের রিস্তা রোটি আর বেটির। এইগুলাই বাতায়েঙ্গে তো ফির?”

“আসল কথাগুলোই তো তোমার স্মরণে নেই দেখছি! রাজকুমারী যে সামারহাউসে সুইসাইড কমিট করেছিলেন, দ্যাট সামারহাউস ল্যাটারলি টার্নড ইনটু লোরেটো কলেজ অফ দার্জিলিং। আমার বোন সেই কলেজেরই ছাত্রী, দলাই লামার সিস্টারের ব্যাচমেট। আমার স্ত্রী, হু ওয়াজ আ মৈত্র ফ্রম আ রিনাউন্ড বারিন্দ ব্রাহ্মিণ ফ্যামিলি ওয়াজ দ্য ব্যাচমেট অফ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। আমার কাকীমার বাড়িতে নেতাজী একবেলা খেয়েছিলেন। দোমহানিতে জ্যোতি বোস যখন নিজের পলিটিক্যাল কেরিয়ার শুরু করছেন, আমার কাকার কোয়ার্টারে আসতেন রোজ সন্ধ্যায়। ডানকান্সের চা সহযোগে ইন্ডিয়ান ট্রেড ইউনিয়ন মুভমেন্টের ফিউচার নিয়ে আলোচনা হতো। দ্য পেইনফুল ম্যাটার ইজ দ্যাট তুমি বাঙালি হয়েও এই বাঙালিয়ানার গ্র্যাঞ্জার ধরতে পারছ না! তুমি কি সত্যিই বাঙালি, না কি, বাংলাদেশি?”

“আরে না, না মিশ্রাজি। আসলে আমি এইট পাশ করেই দিল্লি চলে গেলাম প্রথমে। ফির রাজস্থান। কামওয়াম জুগাড় করতে করতে আমার বাংলাও গেল থোড়া বিগড়িয়ে। আর সচ বলতে আমার বাংলা যত বিগড়াতে লাগল, রাজস্থানে আমার কাম জুটানো আসান হচ্ছিল। বাংলা আস্তে আস্তে বাঙ্গাল হয়ে এল আমার কাছে। ফির ধীরে ধীরে বাংলাদেশ। এখন তো আর কিছুই স্বীকার করতে ডর নাই, কানুন কিছুই করতে পারবে না আর। অবশ্য এখন কানুন এইসবে কিছু করতে চায়ও না। তাই একঠো বাত আপনাকে বলেই দি। জানেন, আমি ভি লোকজনের সাথে মিলে একটা বাংলাদেশিকে পিটিয়ে মেরেছি। মারতে মারতে হারামিটাকে জিন্দা জ্বালিয়ে দিয়েছিলাম। ‘আগগে মা গে’ করতে করতে পুড়ে গিয়েছিল গরুখোরটা। এইসব গরুখোর বাংলাদেশিতেই তো বাঙ্গাল ছেয়ে গেছে এখন। এইসব কারণেই মিশ্রাজি আমি বাংলার হালহকিকতের খোঁজ তেমন রাখি না। এই মুশকিল এসে হাজির না হলে ফের বাঙ্গালে ফেরার কথা কে ভাবত! বহুত হাঁটতে হলো। বহুত লোক আমরা একসাথে হাঁটলাম। হাঁটতে হাঁটতেই কত লোক মরে গেল। আমি শালা মণ্ডলের বেটা, জোশই আলাদা। যে মরছে মরুক, ফিরভি চলনা জারি রহেনা চাহিয়ে। হেঁটেই ঘুষে যেতাম মালদায়, নেহাত ভাগলপুরে মেরা সাথ ইতনা বড়া কাণ্ড হো গ্যয়া। ছোড়িয়ে, বিশ সাল বাদ বাংলায় ঘুষব, সোচিয়ে! ও ভি মিশ্রাজি আপনার সাথে প্রতি রাতে গপ্প মারতে মারতে! রাত প্রায় খতম মিশ্রাজি। কাল ফির কথা হবে নসিবে থাকলে। জয় গঙ্গা মাইয়া! জয় শ্রীরাম!”

“আসল কথা এইগুলো একটাও নয়। তুমি বাংলাকেই ঠিক করে চেনো না কারণ তুমি একটা মণ্ডল। খুবই ডাইসি সারনেম। এসসি হতে পারো, রিফিউজিও হতে পারো, ওবিসিও হতে পারো, আবার পিওর বাংলাদেশিও হতে পারো। তবে যাই হও না কেন মণ্ডল তো মণ্ডলই থাকবে। আমি নগেন্দ্রনাথ বসুর ‘বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস’ খুব ভালো করে পড়েছি। মণ্ডল পদবির উল্লেখ অবধি নেই। কিছু বুঝলে? নেহাত এই ক্যাটাসট্রফ। আর দ্য গ্যাঞ্জেস ইজ আ গ্রেট ইকুইলাইজার। তাই তোমার পাশে পাশে চলেছি। এই কথাগুলো শুনে কি দুঃখ পেলে মণ্ডল? দুঃখ পেয়ো না। সত্যি কথা তিতাই হয়। ভোর তো হয়েই এল প্রায়! রাজমহলও পেরিয়ে এলাম প্রায়! তুমি বাংলাদেশি হলে ধূলিয়ান থেকে তোমার, আমার রাস্তা আলাদা হয়ে যাবে। আবার কপালে থাকলে বে অফ বেঙ্গলে মিট করব। জয় শ্রীরাম!”

আরও পড়ুন- জিহাদের বিষয়-আশয়: অভিষেক ঝা

জল খুব বিপজ্জনক পরিসর। উপর থেকে নীচে আসতে আসতে এত ফারাক যে মাঝে মাঝে মনে হতেই পারে উপর, নীচ, আর মাঝ দিয়ে আসলে তিনটা গঙ্গা বইছে। মাঝের গঙ্গায় এখন বাদামি রঙের এক জোড়া শুশুক ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের থেকে খানিক দূরে কোনও একাকী শুশুক হয়তো বা জলের স্রোতের অভিমুখ ঠাওর করতে না পেরে সঙ্গীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সুফিয়ান এক আউলিয়ার মতো ইতিউতি ছুটে বেড়াচ্ছে। উপরের ভোরের রোদ এখানে অনেকটাই গাঢ় সবুজ হয়ে এসেছে। একটা অদ্ভুত নরম আলো। উপরের ভোরের গঙ্গার কোনও ব্যস্ততা এখানে নেই। ফলে বয়ে চলা এখানে যেন বা অনেক ধীর। এই ধীমে চালেও শুশুকের নাকে পচতে শুরু করা মাংসের গন্ধের তীব্রতা অস্বাভাবিক ঠেকছে অন্যান্য সময়ের চেয়ে। আকারে অনেক বড় প্রাণী মরেছে হয়তো। জলের স্রোত ঠাওর করতে না পারা শুশুকটি এখনও পাগলের মতো ছুটে বেড়াচ্ছে। খানিক অস্বাভাবিক ঠেকছে রুই, কাতলা, কালবোস, বাঁশপাতা, রিঠা মাছের ঝাঁকদেরও। ঝুপ করে উপর থেকে জাল নেমে এসে টেনে নিচ্ছে না তাদের। মাঝরাত থেকে ভোররাত অব্ধি ঝাঁকে ঝাঁকে নেমে আসা জালেরা আপাতত উধাও। এই নরম আলো অদ্ভুত হয়ে আছে এখানে এখন। আর আছে ধীর লয়ে বয়ে চলা লঞ্চের ঘড়ঘড়, টানা দিন-রাত জুড়ে। খানিক আগেও উপর, মাঝ আর নীচ গঙ্গায় আলোর ফারাক ছিল সামান্যই। রাতে জলের শব্দের ফাঁক গলে ফিসফিস সব কথা ভেসে আসছে উপর গঙ্গা থেকে, এই কয়দিন। জলে ভেঙেচুরে যায় সেই সব স্বর। তখন ঘন সবুজ রঙের শ্যাওলাগুলোকে মিশকালো নড়তে থাকা দীঘল চুলেদের মতো ঠেকে। এইসব দীঘল সমস্ত চুলেদের ভিতর কত কী যে লুকিয়ে থাকে তা শুশুকের মতো ইন্দ্রিয়সজাগ প্রাণীও ঠাওর করতে পারে না। ইন্দ্রিয়ের তাগিদেই এই দীঘল শ্যাওলাগুলোয় ঢুকে পড়েছিল কোনও এক শুশুক। তখনও উপরের ফিসফিসরা কথা থামায়নি সেই রাতের মতো। লঞ্চের শব্দ খানিক স্তিমিত তখন। মাংসের অচেনা এক ঘ্রাণ আসছিল কোনও এক শুশুকের কাছে। অচেনা জিনিসগুলো বেশ কয়েকটা শ্যাওলার ফাঁক থেকে তুলে এনে শরীরে চালান করতেই অস্বস্তি শুরু হয়েছিল। রাত কেটে নরম আলোয় ভরছিল মাঝ গঙ্গা। বাদামি রঙের এক জোড়া শুশুক ঘুরে বেড়াতে শুরু করবে আর খানিক বাদে। শ্যাওলা থেকে তুলে আনা মাংসের গন্ধ লেগে থাকা মাস্ক শরীরে নিয়ে জ্বালায় ছটপট করতে করতে এক শুশুক উগলাতে চাইবে সমস্ত শরীরটুকু। তাকে অনেক দূর থেকে দেখলে মনে হবে হয়তো বা জলের স্রোতের অভিমুখ ঠাওর করতে না পেরে সঙ্গীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সুফিয়ান এক আউলিয়ার মতো ইতিউতি ছুটে বেড়াচ্ছে কোনও একাকী শুশুক। আলো আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে মাঝ গঙ্গায় এখন। শ্যাওলাগুলোর ফাঁকে ফাঁকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে হরেক রকমের মাস্ক আটকে আছে। এন নাইন্টি ফাইভ, কাপড়, সার্জিক্যাল, প্লাস্টিক সব ধরনের। শ্বাস নিতে আর উপর গঙ্গায় যেতে পারল না কোনও এক শুশুক। হাল ছেড়ে দিয়ে নীচ গঙ্গায় তলাতে থাকল। সোজা ভাষায় ‘প্লাটানিস্টা গ্যাঞ্জেটিকা’র সংখ্যা আরেকটা কমল। এই কমার যাত্রাপথটি চোখে দেখলে মনে হয় আড়াই মিটারের বাদামি শরীরটা তলাতে তলাতে শুশুক থেকে বিশালাকার এক মাছ হয়ে, প্রমাণ সাইজের এক মাছ থেকে বড় সাইজের এক ছোট মাছ হয়ে, ছোট মাছ থেকে ফিনফিন মীনেদের মতো হয়ে নিচ গঙ্গায় বালির বিন্দু হয়ে গেল।

“হাঁ বে অন্ধি খুসট বুড়িয়া! তোকে বাড়ির লোকজন সহ্য কী করে করত বে! কোথায় লোককে আচ্ছে দিনের আশা দিবি, হাত দেখে ভব্যিষতের ভালো ভালো কথা শুনাবি, তা না, পিছলে দিনের যত কালা কালা কথা সেগুলাই খালি দেখতে পাস আর মুখের উপর ফটসে বলে দিস! তোকে যে তোর পোতা স্টিলের ক্যান দিয়েছে এটাই কি তোর ভাগ্য না? সেই ক্যানের মুখ যে এখনও খোলেনি এইটা কি তোর ভাগ্য না? এমন মুহফোটের তো আমাদের মতোই নসিব হওয়ার কথা।”

“চুপ বে ছওড়ি! নিজে হিজড়া হয়ে আবার আমার নসিব কত খারাপ হওয়ার ছিল সেইটা মাপিস! ভবিষ্যৎ না দেখা অনেক ভালো। অতীত এমনই চিজ যা ভূতের মতো আদমির ঘাড়ে জাপটিয়ে থাকে। আমার ভূত দেখতে ভালো লাগে। কোনও চিজ এমন নাই এই দুনিয়ায় যার ভূত আমাকে ডরাতে পারে। বারোদিন আগে তুই মরে থাকা বুড়াটার পাশে রাখা আপেল খেয়ে তারপর নার্সকে ডেকেছিলি। ভেবেছিস আমি দেখতে পাব না এখন এইসব? নিজের নাগরের বউকে ফোন করে নাগরের খবর দিয়ে টাকা নিতিস, আবার বউ খুঁজতে চলে এল যেদিন, সেদিন নাগরকে লুকিয়ে বউয়ের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য ডবল টাকা নিলি। সেই টাকাতেই তো বাম পায়ের সস্তার তোড়াটা কিনেছিস। হারামের টাকার চিজ। তুই শালী কুত্তি!”

“হিজড়া হয়ে জন্মাস পরের জন্মে। ঠিক শিখে যাবি সবসময় বাড়তি টাকার খোঁজে কেন দুনিয়ার সব বুরা কাম করতে হয়। বাদ দে এইসব । আশেপাশে যে মালগুলা আছে তাদের কাহানি বল বে মাঈ। টাইম পাস তো করতে হবে। পুরা রাত পড়ে আছে।”

“একটারই তো বু পাচ্ছি রে। মিশ্রাজি আর মণ্ডল কি এগিয়ে গেছে অনেকটা? শোন ওই যে মুঙ্গেরের মালটা যে তোকে হিজড়া হওয়ার জন্য কাল বলল যে একমাত্র মরে গিয়েই তোরা সমাজের বোঝ কমাতে পারিস, ওইটা আসলে মরদদের লাগাতে ভালোবাসে। কিন্তু জানে খুব ভয়। বাপের ভয়ে প্যান্টে পেচ্ছাপ করে দেয় এখনও। শাদি করিয়ে দিয়েছে বাপ, করেও নিয়েছে। কিন্তু রাজমহল অবধি ও কাউকে লাগাবার সাহস পেত না। যদি বাপ জেনে যায় তাহলে বিচি খুলে নিবে। কোনও মরদের সাথে ভাব ভালোবাসা হলে গঙ্গা মাইয়া পার করে মালদায় ঢুকত। মালদা টাউনে হোটেল নিয়ে থাকত দু-চারদিন। ভাব ভালোবাসা ভেঙে গেলে মনের দুঃখ কমাতে মালদা টাউনে এসে তোরই মতো এক হিজড়ার গাঁড় মারত। বাঁধা হিজড়া হয়ে গিয়েছিল। ‘লছমী ডার্লিং’, ‘লছমী ডার্লিং’ করে বহুত বার গাঁড় মারার পর, একদিন লছমী কিছুতেই মারাতে দেয় না। লছমীকে মুঙ্গেরি মাল বলে, ‘হাঁ বে লছমী তোর সাথে কি আমার ভাব ভালোবাসার সম্পর্ক যে চুদতে গিয়ে জোর জবরদস্তি করতে হবে’? নিচু গলায় লছমী মুঙ্গেরিকে যা বলল, শুনেই মুঙ্গেরি নিজের মুঙ্গেরি মেশিন জল দিয়ে বারবার ধুতে লাগল। মালদা থেকে সেই যে ভাগল আর আসেনি। বাধ্য না হলে কি আর আসত রে এখানে!”

“লছমীর কি কোনও খারাপ অসুখ ছিল বে বুড়িয়া? এইডস? সিফিলিস? গনোরিয়া?”

“না বে, না।”

“লছমীর কি পাইলস হয়ে গিয়েছিল?”

“না বে ছওড়ি। লছমী মুঙ্গেরিকে বলেছিল, ‘আজ আমি রোজা রেখেছি গো, আজ গাঁড় মেরো না'।”

“আব্বে কী বলিস! মুঙ্গেরি তো পুরা জয় শ্রীরাম!”

“তুই কী?”

“জয় শ্রীরাম”

“আমি কী?”

“জয় শ্রীরাম”

“মিশ্রাজি কী?”

“জয় শ্রীরাম”

“মণ্ডল কী?”

“জয় শ্রীরাম”

“চাঁদির ঘটে যারা ছিল তারা কী?”

“জয় শ্রীরাম”

“করোনায় মরেছে জেনেও যারা ঘটগুলো গঙ্গা থেকে তুলে নিল, তারা কী?”

“জয় শ্রীরাম”

“বাপের থেকে পিতলের ঘটির টাকা নিয়ে স্টিলের ক্যানে আমায় ভাসিয়ে বাকি টাকা মেরে পিজ্জা খাওয়া আমার পোতা কী?”

“জয় শ্রীরাম”

“তোর লাশ না পুড়িয়ে গঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়া লোকগুলো কী?”

“জয় শ্রীরাম”

“করোনায় মরা জোয়ান মাগীর লাশ গঙ্গায় ভেসে আসছে দেখে বালুয়া টোলিতে যে লোকটা লাশ তুলে লাশকেই লাগিয়ে দিল, সে কী?”

“জয় শ্রীরাম”

“জোয়ান মাগীটা কী?”

“জয় শ্রীরাম”

“মণিহারী ঘাট অব্দি আমাদের ভালো ভালো সব গজল শোনাতে শোনাতে এল কানপুরের কলেজে পড়ানো যে বাঙ্গালি বউটা, সে কী?”

“জয় শ্রীরাম”

“পুরা হিন্দুস্থান কী? চুপ করে আছিস কেন বে? নারা দে বে ছউড়ি। কী বে হিজড়া চিল্লা। আবে রাত তো এখনো শেষ হয়নি। কী বে? মুখে মুঙ্গেরির লন্ড নিয়ে বসে আছিস নাকি? হিজড়া, এই হিজড়া…”

“জয় শ্রীরাম। অন্ধি বুঢঢি।”

“ জয় শ্রীরাম। হাঁ বে মুঙ্গেরি, হিজড়াটাকে দেখতে পাচ্ছিস?”

“কানামুহি কাঁহিকা। তোর পাশে পাশেই তো ভাসছে।”

“তাহলে বাতচিত করছে না কেন? রাতে তো চাইলেও মুখ বন্ধ রাখতে পারব না আমরা। ঘটে ছাই হয়েই থাকি, ঘটের বাইরে ছাই হয়েই জলে ভাসি, আর লাশ হয়ে গলতে গলতে ভেসে থাকি, আমাদেরকে রাতভর জেগে তো থাকতে হবেই। দিনের বেলা লাশের উপর হাড়গিলা এসে বসবে। খুবলে খুবলে নেবে ঢিলা হতে থাকা মাংস। লাশের ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে ঠোঁট ঘুষিয়ে ছিঁড়তে থাকবে জিভভা। তখন আমরা কিছুই করতে পারব না। হাড়গিলা এসে খুবলে নিবে চোখ। তখনও আমরা কিছু বলতে পারব না। সব জ্বালা জমতে জমতে রাত চলে আসে। আর দিনের সব জ্বালা বুকে জমে রাত হলেই। আমাদের বুক জ্বলবেই রাত হলে। সেই জ্বালা ভুলতে না পারে হাত দিয়ে খুবলে নেওয়া চোখের জায়গাটা চুলকাতে, না পারে আধা টিকে থাকা জিভটা দিয়ে ঠোঁট ভিজাতে। কথার পর কথা, কথার পরে কথা, কথার উপরে কথা। কথা ছাড়া দুসরা রাস্তা নাই আমাদের। আমাদের বুকের বিষ শরীর বেয়ে উপরে উঠতে থাকে। বিষের জ্বালায় আমাদের কানা, অন্ধা, ভালো, তুখোড় সব চোখ, চোখের কোটর সবুজ হয়ে জ্বলে ওঠে রাতের পর রাত। আর তারপর আমরা বকতে শুরু করি। খালি বাকোয়াসের পর বাকোয়াস করেই চলি। ভাবি এইগুলাই বুঝি কথা। হিজড়া তাইলে কথা বলছে না কেন! বকোয়াস করছে না কেন?”

“মা গে মা! তোর কত্ত জ্ঞান বে বুঢঢি! কত্ত বকবকালি! আমার বাপ পুরা জিন্দেগিতে এত্ত জ্ঞান দেয়নি আমায়। না পোষালে বাড়ি জমিন থেকে বেদখল করার কাগজ তৈয়ার করবে বলত। ব্যাস আমি লাইনে চলে আসতাম। তোকে ক্যান এইসব বলছি! তুই তো সবই দেখতে পাস পুরানা যা কিছু। সবই তো তুই জানিস বে। তাহলে বলতে পারছিস না কেন হিজড়া চুপ হয়ে গেল কেন?”

“আরেকটু সময় যেতে দে। আর একটু পুরানা হোক সময়। আরেকটু অতীত হোক হিজড়া , না হলে দেখতে পাব না। অতীত দেখতে গেলে থোড়া অর ভব্যিষতে যেতে হবে।”

“বাদ দে যখন দেখতে পাবি, তখন দেখিস। তুই বল বে বুঢঢি এইসব ছোটোলোকের সাথে ভেসে যাওয়া নসিবে আছে জানলে কি আর নার্সিংহোমকে টাকা খাইয়ে বডি নিয়ে সৎকার করে আমার অস্থিভস্ম ঘটে করে গঙ্গায় ভাসাত আমার বাপ?”

“শোন বে। পহেলে শুধু আমরা ঘটওয়ালারাই ছিলাম। যাদের বডি বাড়ির লোক টাকা খাইয়ে নিজেরা নিয়ে নিয়েছিল। সৎকার করে অস্থিভস্ম চাঁদি, পিত্তল, কি কমসে কম আমার মতো স্টিলের ক্যানে ভরে গঙ্গায় ভাসিয়ে দিয়েছে বাড়ির লোক, ছাইও সিধা গঙ্গায় ঢেলেছে কিছু লোক। কমবেশি আমাদের রুপিয়া ছিল বলেই করোনাতে মরেও এমন ভালো নসিব পেয়েছিলাম। বেনারস থেকে খানিক দূর যেতেই দেখি একের পর এক বডি এসে জুটছে আমাদের সাথে। রাত হলে আমাদেরই মতো জেগে উঠছে। কথা বলার সাহসও করছে আমাদের সাথে! কোনও ভয় ডর নাই! বিশ বছরের চ্যাংড়া সত্তর বছরের বুড়াকে বলছে, ‘চোপ বে লন্ডা! আমি তোর চেয়ে দু’দিন আগে মরেছি। আমায় দাদা ডাকবি’। ফূর্তিই ফূর্তি সবার। এমন দুনিয়ায় দু’টা পয়সা থেকেও লাভটা কী হলো শুনি!”

“দু’টা পয়সা বড় হারামী চিজ। অনেক পয়সার মতো তাগদ নাই বে ওতে। আমি দু’টা পয়সা দিয়ে আমার জরু লছমীকে খুব ভালো রাখতে চাইতাম। ‘লছমী ডার্লিং, লছমী ডার্লিং’ করে সোহাগ করতাম। কত্ত শাড়ি কিনে দিতাম। ভালো ভালো হোটেলে খাওয়াতাম। আর লছমী আমার আড়ালে এক মুসলমান ছেলের সাথে চোদাচুদি করতো! দু’টা পয়সার জন্য। কী যে কষ্ট পেয়েছি কী আর বলব! কিন্তু এইটা কী হচ্ছে বে? কে বে জলের তলে? এই হিজড়া! আবে হিজড়া! আবে বুঢঢি! হিজড়ার লাশ সরসরিয়ে নিচে চলে যাচ্ছে! আরে বাপ রে! হাওয়া হয়ে গেল হিজড়া! জয় শ্রীরাম।”

“জয় শ্রীরাম।এখন দেখতে পাচ্ছি থোড়া থোড়া করে সব। গয়ার কূপে ওর নামে পিণ্ড চড়াল আরেক হিজড়া এত রাতে। রাতেই চড়াল বলে অসুবিধা হল কম। কূপের ভিতর অনেক হাত ছটপটাচ্ছে। একটা হাত পিণ্ড নিয়ে নিল। কিন্তু হিজড়ার পা! উফফ এ কৌন? পুরা গায়ে খুনের বু! এ দেবী না ডাইন! মাঈ গে! ভূত এত্ত ভয়ানক হয়! নবজাত বাচ্চিকো খেয়েছে এ মুরত! পুরা গায়ে মিট্টি, পের কা জড় আর খুনের বু! হিজড়াকে ভি খেয়ে নিল! মাঈ গে…”

আরও পড়ুন- জুলুস : অমৃতা সরকার

জল কপাট লাগানো ঘরের মতোই নিরাপদ এক পরিসর। নীচ গঙ্গা থেকে মাঝের গঙ্গাকেই ঘোলাটে আলোর মহাশূন্য ঠেকে। তার উপরে কী আছে তা নীচ গঙ্গার বাসিন্দারা ঠাওর করতে পারে না। এরা অনেকেই আগের জন্মে জলের বাসিন্দা ছিল না। আবার অনেকে মাঝ গঙ্গার বাসিন্দা ছিল, উপর গঙ্গারও কেউ কেউ। কেউ কেউ খানিক দিনের বাসিন্দা। কিছু দিন পরেই উপর গঙ্গায় ফিরে যাবে। যেমন এই শুশুকটা। আগের জন্ম ছেড়ে মাঝ গঙ্গা থেকে একটা বিন্দু থেকে সুতা হয়ে নামতে নামতে বড়সড় এক শ্যাওলার আকার নিয়ে শেষমেশ একটা ঘন বাদামি রঙের মড়া শুশুক হয়ে জন্মে ওই পাশে মুখ করে শুয়ে থাকা নৌকার গলুইটার উপর আছড়ে পড়ল। এই নৌকার গলুইটা আগের জন্মে উপর গঙ্গার বাসিন্দা ছিল। সেই জন্মের কোনও এক ফাল্গুন মাসের রোদের বিকালে গোরাদের নজর এড়িয়ে পালিয়ে আসা এক ফকিরকে গঙ্গা পার করেছিল এই নৌকা। তখন তার পাল ছিলো ভালো জাতের নীলের রঙ দিয়ে রাঙানো। নীলাভ সেই পালে রোদ ঠিকরে বিষণ্ণ সেই ফকিরের উপর এমন ভাবে পড়ছিল, মনে হচ্ছিল ফকির যেন নিজেই রোদ। রাজমহলের ওপার থেকে বিষানো পা নিয়ে সেই রোদটুকু নিজের ভিতরে শুষে নিচ্ছিল আরেক ফকির হয়ে যাওয়া আরেক ফকির। রাজমহলে নেমে গিয়েছিলেন ফকির ও তাঁর শাগরেদরা। ফিরতি পথে একটুকরা লাল মেঘ থেকে জন্মানো ঝড়ে নীচ গঙ্গার বাসিন্দা হয় নৌকাটি। গলুইটা ছাড়া সবকিছুই জল হয়ে গেছে এখন। গলুইটার উপর নিশ্চিন্তে শুয়ে আছে এখন শুশুকটা। হয়তো কালই ভেসে উপর গঙ্গায় চলে যাবে। এখানে রোদের আলো প্রায় ক্ষীণ হয়ে আসছে। ক্ষীণ সেই আলো কমে এলে স্বস্তির আঁধারে ভরে ওঠে চারপাশ। এখন রাত সুগভীর। নীচ গঙ্গা থেকে জলের তুমুল নাড়াচাড়া দেখে বোঝা যায় মাঝের গঙ্গা থেকে উপর গঙ্গায় উঠছে কোনও গাঙ্গেয় কুমীর। উপর থেকে ভেসে আসা ফিসফিসরা হঠাৎ থম মারে। উপরের তোলপাড় নীচ অবধি এসেই পৌঁছয় না। নীচে এখন একটা ভুটভুটির ইঞ্জিন, একটা জং পড়া মোটরসাইকেলের দিকে তাকিয়ে ক্ষয় বোঝার চেষ্টা করছে। আর খানিক দূরে অর্ধেক শরীর বালিতে গেঁথে তাকিয়ে রয়েছে এক পাথরের মূর্তি। বেলেপাথরের দেবী তারা। চোখের স্থির ভাবে পুরো নীচ গঙ্গা ধরা আছে যেন। মহীপালের সময়ের মূর্তি। কখনও জল থেকে মাটিতে যায়। আবার কখনও মাটি থেকে জলে ফিরে আসে। এইবার জলে ফিরে আসার ঠিক আগের জন্মে একটা গাছের শিকড়ের মাটি, মেয়ে হারা এক বাপের বুকের ধুকপুক আর সদ্যোজাত এক শিশু কন্যার রক্ত মেখে মাটিতে ঘুমিয়েছিল এই মূর্তি। সেই মাটিকে, অনেক গাছ সহ সেই মাটিকে গঙ্গা নিজ বুকে টেনে নেয়, প্রায় সত্তর বছর হতে চলল এইসব। স্রোতে সরতে সরতে এখন এখানে স্থির হয়ে আছে দেবী তারা। চোখ মেলে আছে মাঝ গঙ্গার দিকে। চোখ যেন মাঝ গঙ্গা ফুঁড়ে উপর গঙ্গাতেও পৌঁছে যায়। মাঝের গঙ্গার আকাশ খুলে কী যেন নামছে… তারার মূর্তির সামনেই এসে পড়ল জিনিসটা। রাত প্রায় শেষ হয়ে আসছে উপর গঙ্গায়। খুসট বুড়িয়া তারাকে দেখতে শুরু করে নিজের অন্ধ চোখের ভিতরের যে চোখ তা দিয়ে। ভূত এত ভয় পাওয়াতে পারে ভূত হয়ে যাওয়া বুড়ির আন্দাজ ছিল না। ভয় এতই দলা পাকায় যে বুড়ি তাকে জন্ম দিতে গিয়ে মরে যাওয়া মা-কে ডেকে চিল্লে কেঁদে ওঠে। প্রেতযোনি থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসা সেই কান্না এই শেষ রাতে নীচ গঙ্গায় এসে পৌঁছয় না। উপর গঙ্গায় ঘুমাবার চেষ্টায় থাকা কোনও কোনও মানুষের কানে মা-কে ডাকা মৃতার আওয়াজ ভাঙনের ঠিক আগে আগে গঙ্গার ডাকের স্মৃতি জাগিয়ে আবার মিলিয়ে যায়। ভাঙনের দুঃস্বপ্ন, ঘুমাতে চাওয়া মানুষের স্বপ্নে এসে আর কতদিন ভয় দেখাবে? ভাবতে ভাবতে একটু জল খেয়ে তারা আবার ঘুমাবার চেষ্টা করে। নীচ গঙ্গায় তারার মূর্তির সামনে পড়ে থাকে সে। উপর গঙ্গার জীবন ছেড়ে চলে আসা হিজড়ার সে। হিজড়ার বাকি শরীর মধ্যবর্তী গঙ্গার জলের দানোর খাবার হয়ে গেছে। মাঝ গঙ্গা ফুটো করে হিজড়ার এইটুকু সে পৌঁছতে পেরেছে নীচ গঙ্গায়। নীচ গঙ্গার এই জন্মে সে গোড়ালি থেকে কাটা একটা বাম পা, সস্তার রুপোলি তোড়া কীভাবে যেন এখনও জড়িয়ে আছে। রক্ত প্রায় ধুয়ে গেছে সবটাই, এতটা গল্পপথ পার করতে করতে।

আরও পড়ুন- আয়না ভবন : সুমিত বন্দ্যোপাধ্যায়

“মণ্ডল, ও মণ্ডল…এই উড বি এনআরসি তালিকার ক্যান্ডিডেট…”

“জয় শ্রীরাম মিশ্রাজি।”

“জয় শ্রীরাম, জয় শ্রীরাম। দেশের রিজনিং অ্যাপটিচ্যুডের হাল দেখেছ! একটা লাশকে টেনে নিয়ে গেল মাগর ক্রোকোডাইল আর মুঙ্গেরি কিনা একটা আনকুত, আনকালচার্ড, ফ্রড ওল্ড ওম্যানের মোকষা-ন্যারেটিভ দিয়ে জাস্টিফাই করছে ব্যাপারটা আর আমার ভ্যালিডিশনও চাইছে!”

“একদম ঠিক বলেছেন মিশ্রাজি। মুঙ্গেরি দাদা ভি এটাই বলল আমায়। আমিও এটাই বিশ্বাস করি। গঙ্গা মাঈয়ার মগর-মাছ কি আমাদের মতো করোনার মড়া খাবে! আমাদের মতো যারা লাশ, ছাই, ঘটে থাকা ছাই হয়ে ভাসতে ভাসতে আসছে, ডাইরেক্ট গয়ায় পিণ্ড না দেওয়া অবধি নাকি রোজ রাতে জেগে থাকতে হবে। চোখ খুলে যাবে রোজ রাতে। এখন যেমন হয়। বিষ জ্বালা বুক থেকে মুখে উঠে চোখে ঢুকে যাবে রোজ রাতে বারবার। জ্বালা ভুলে গল্প করার চেষ্টা করব, আপনার মতো ভদ্রলোককে পাশে পেলে। জ্বালা জুড়ে গান করার চেষ্টা করব, আমার মতো লোকদের পাশে পেলে।”

“কিছুই বোঝোনি মণ্ডল তুমি আমার কথা। অবশ্য তুমি বুঝলেই আমি অবাক হতাম। বাদ দাও। কিন্তু সারপ্রাইজিংলি তোমার বাংলা তো একদম ঝরঝরে হয়ে আসছে রাজমহল পেরোবার পর থেকে। আমার ধারণা ধূলিয়ান আসতে আসতে তুমি ‘খাইতেসি’, ‘আসতেসি’ শুরু করে দিবে। তারপর নিজের আসল আইডেন্টিতে ফিরে যাবে।”

“ বাড়ি ফিরছি মিশ্রাজি কত যুগ পর! না হয় লাশ হয়েই গঙ্গা দিয়ে ভাসতে ভাসতেই ফিরছি। কিন্ত বাড়ি ফিরছি তো। নিজেকে চেনা চেনা লাগছে। জানেন মিশ্রাজি, যে বাংলাদেশিটাকে একজোট হয়ে পিটিয়ে মেরেছিলাম…আমার মতো ওরও বাড়ি ছিল মালদা। কাঠের বাক্সায় ট্রেনে করে ও বাড়ি ফিরেছিল। আমারই মতো লাশ হয়ে।”

“এইসব ছোটখাটো ব্যাপার মাথায় এনো না মণ্ডল। জীবন অনেক বড়। আর তুমি তো এইপারেরই হিন্দু, তাই না? গীতা পড়া নেই বুঝলাম, গীতা শোনোনি কোনওদিন নিজের গ্রামে? মা রামায়ণ, মহাভারতের গল্প শোনাত না কখনও?”

“মা তো ডোমনি গাইত মিশ্রাজি। আমাকে ঘুম পাড়াবার সময়ও ডোমনিই শুনিয়ে দিত।”

“ডোমনি কী মণ্ডল? তুমি জাতে ডোম নাকি?”

“‘বড় আশা করে আইসাছিনু পাব লাল শাড়ি / শাড়ি-টাড়ি কুছ ন্যই পাইলাম/ পাইলাম গুদরির ঢেরি’। এই গানটা মনে পড়ল মিশ্রাজি।”

“এইটা বাংলা? বাংলারই কোনও ডায়ালেক্ট সম্ভবত।”

“ঠিক বলেছেন। ডাইরেক্ট বাংলা। আরেকটা গান মনে পড়ছে মিশ্রাজি, কিন্তু গানটা একটু খারাপ আছে, ঘিণোনা। গাইব?”

“যে অবস্থায় আমাকে ভেসে আসতে হলো মণ্ডল, এর চেয়ে ইনফার্নো আর কীই বা হতে পারে! গাও, গাও।”

“ ‘হামার হাতের ভাত রে বাভ্যনা/ দেখে করলি ঘিণ/ ডোমেনী হাতে ভাত অরে বাভ্যানা/ খাইবি কেমিন/ কান্দিছে কান্দিছে তোর মাঈঅ বাপঅ / কান্দক যারে মাঈ-বাপ-অ/ হামি করব কী/ কছুর পাতে লেখে দিয়েছি/ অন্য ডোমেনী’। এইটা দাদি গাইত। দাদি বলেছিল, দাদির ছোটবেলায় যখন বাড়িতে চাল ফুরাতো, বাভণদের উঠানে গিয়ে নেচে নেচে এই গান ধরলেই চাল, ডাল, পয়সা দিয়ে তাড়াতাড়ি ভাগিয়ে দিত লজ্জা পেয়ে। তাও যেসব বাভণ তখনও চাল আর পয়সা দিত না, তাদের ঠাকুর্দা, কাকা, বাপ যারা ধুতিতে দু’টা পয়সা লিয়ে কোনও কোনও রাতে আমাদের টোলায় আসত তাদের নাম লিয়ে গান শুরু করতে হতো।”

“হুম। তোমরা কোন জাতি ঝেড়ে কাশো তো মণ্ডল?”

“বাঙালি।”

“সে সবাই বাঙালি। উপজাতি? সাব কাস্ট?”

“বাঙালিই আছি। কাস্ট সার্টিফিকেট ছিল। এসসি”

“জাত কী? কালচার কী? কালচার?”

“বাঙালিই আছে।”

“এইটা বাঙালি কালচার! আমায় মানতে হবে!”

“আপনি না মানলে কি আমরা বাঙালি থাকব না মিশ্রাজি? আপনি না মানলে কি আমাদের গান বাঙালি গান হবে না মিশ্রাজি? আপনি না মানলে কি আমাদের নাচ বাঙালি নাচ হবে না মিশ্রাজি?”

“হবে, বাট, একটা কিন্তু আছে। ঠিক আছে সাবঅল্টার্ন সেট-আপে ফিট করিয়ে দেওয়া যাবে। সাবঅল্টার্নের রেজিসট্যান্স বললে আরও ভালো হবে ব্যাপারটা… এই গান গাওয়াটা দিয়ে ব্রাহ্মণদের অপমান, আই মিন রেজিস্ট করাটা- ইয়েস উই ক্যান পুট ইট লাইক দিস- সাবঅল্টার্ন ক্যান সিং।”

“আবে চোপ বাভণের ব্যাটা! সেই সাহেবগঞ্জ থেকে উৎপটাং বকে যাচ্ছিস। রবীন্দ্রনাথ, লামা, ইংরেজ, নেতাজী, জ্যোতি বসু, এনআরসি বলে ভড়কে দিচ্ছিস খালি। আমায় বাংলাদেশি বানাতে চাইছিস রাজমহল থেকেই। আমি বাঙালি হব না তো কে বাঙালি হবে বে! তোর বাপ? জয় শ্রীরাম।”

“জয় শ্রীরাম। কী বললি! আমার সাথে এমন করে কথা! জুতিয়ে সোজা করে দিব। শালা ডোম কোথাকার! পঞ্চাশবার জন্মালেও আমার বালেরও যোগ্য হতে পারবি না। বাল এত আলো কে মারছে ঝগড়ার সময়? আলো সরা… জয় শ্রীরাম।”

“জয় শ্রীরাম। এতক্ষণ পর মনে হচ্ছে আমরা একসাথে অনেক, অনেক পথ ভেসে এসেছি রে বামণা। তোর ঝাঁট জ্বলছে মিশ্রা? রাগ করছিস? আরে রাগ করিস না। সত্যি কথা সবসময় তিতাই হয়। আবে আলো সরা বে বোকাচোদার দল। এই! আবে, আবে, আমায় কি কাতলা মাছ পাইছে! আবে ছাড়, ছাড়… আগগে মা গে…”

“কী হলো বে ডোম? এই ডোম কথা বলছিস না কেন? কোথায় গেলি? এই মণ্ডল… এই ডোমের বাচ্চা…”

জল ঘুম কেড়ে নেওয়া এক পরিসর। খুব ভোরবেলা লঞ্চের ডেকে উঠলে একদিকে তিনপাহাড়ের স্যাটা ভাঙা চেহারা, আরেক দিকে নির্লজ্জভাবে ঘোলাটে সাদা ধোঁয়া উগলাতে থাকা ফারাক্কার চিমনি চোখে আসে। এইটুকুই মোটামুটিভাবে সার্চিং এরিয়া। অফিশিয়াল নোটিশ দিয়ে মাছ ধরা বন্ধ করাতে হয়েছে, প্রায় তিনদিন হতে চলল। কত বডি ভেসে আসবে, তার আন্দাজ কারও কাছেই নেই। তাই প্রস্তুতি রাখতে হয়েছে ভালোই। এখন অবধি একটাও বডি পাওয়া যায়নি। করোনায় মরার পর গলতে থাকা বডির পর বডি গঙ্গার বায়োডাইভার্সিটির কোন কোন ক্ষতি করতে পারে তার আগাম কোনও ধারণা দিতে পারেনি কেউই। তাই ওটা নিয়ে ভাবার কোনও মানে হয় না। আর এমনিতেই ফারাক্কা ব্যারেজ আর এনটিপিসি এখানে শুশুকদের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। বেশ কিছু মাস্ক ভাসছে গঙ্গায়। দু-চারটে ডিঙি নৌকা বোধহয় সরকারি আদেশনামা জানে না। না, বোধহয় জানে। এই ধারের সবুজ ঘন হয়ে থাকা ঘাসগুলোর আড়াল নিয়ে মাছ ধরার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। করোনার দাপট এমনই যে চর কে চর বালি, স্টোনচিপস, চুনাপাথর ,বাঁশের স্মাগলিংও প্রায় বন্ধ। তারপর স্বাভাবিক নিয়মেই স্মাগলিং শুরু হয়। নিউ নর্মাল স্মাগলিং। জিনিসের জায়গায় মানুষ চালান শুরু হলো। রাতের বেলা, ভোর রাতে নজর এড়িয়ে এপারের মানুষ ওপারে, ওপারের মানুষ এপারে চালাচালি করছিল এক-দুই মাস ধরে। সবারই তো বাড়ি ফেরা, রুজিরুটি থাকেই। অসুবিধা হচ্ছিল না। অভ্যস্ত হয়ে উঠছিল সবাই। কিন্তু করোনার মড়া গঙ্গা দিয়ে ভাসতে ভাসতে ইউপি, বিহার থেকে রাজমহল হয়ে মালদায় ভেসে আসতে পারে এইটা চাওড় হতেই রাতের বেলাতেও প্রশাসন কড়া নজরদারি শুরু করে। তাই সব কারবার আপাতত বন্ধ। গঙ্গা জুড়ে এই কয়দিন শুধু জলের শব্দ আর লঞ্চের ঘড়ঘড়। আজ রাতেও রুটিন সার্চ চালাচ্ছে তিনটা লঞ্চ। শিফটে শিফটে রাতের খাওয়াদাওয়া সেরে নিয়েছে প্রায় বাহাত্তর ঘণ্টা কমবেশি জেগে থাকা মানুষগুলো। ঘুম লাগা চোখ আর কান বিচিত্র সবকিছু দেখতে আর শুনতে পায়। ঘুম লাগা কানে গতকাল রাতে ভাঙনের আগে যেমন গঙ্গা ডাকে তেমন একটা ডাক শুনতে পেয়েছিল কেউ কেউ। ভয় পেয়ে জেগেও উঠেছিল কেউ কেউ। কেউ কেউ জল খেয়ে আবার ঘুমাবার চেষ্টা করেছিল। তারপর ফের শান্ত একটা সকাল। একটা মরা শুশুক ভেসে ওঠা ছাড়া আর কিছুই ঘটেনি এমনই সাধারণ একটা দিন। এমন দিন পেরিয়ে ফের একটা রাত। রাতের জলে আলো পড়লে ঘুম লাগা চোখ ময়াল সাপ দেখে। সেই ময়ালের মাথা দেখা যায় না। লেজ দেখা যায় না। শুধু পিছলে যাওয়া বিশাল এক দেহ সার্চ লাইটের পরিধি জুড়ে। ময়ালের দেহ জুড়ে চলে খোঁজ। কোনও দেহ যদি পাওয়া যায় ময়ালের পেটে। কেউ কিছু একটা দেখতে পেয়েছে মনে হয়। চিল্লে কেউ কাউকে কিছু একটা বলল। স্পিকার ঘড়ঘড় করে উঠছে। আলো স্থির করা হল স্পিকারে নির্দেশ পেয়ে। প্রায় পঞ্চাশ জন মানুষের চোখ আলো পড়া ময়ালের পিছল দেহে স্থির। নিশ্চিত। একটা বডি। ফ্যাকসা সাদাটে। ময়াল বয়ে নিয়ে এসেছে। পেট ফুলে ঢোল। জাল নামানো হচ্ছে।

More Articles