অপরাধ কমাতে নতুন প্রজন্মের হাতে বই তুলে দিচ্ছে পুলিশ, যেভাবে পথ দেখাচ্ছে অসম

Street Library, Assam: শিক্ষাই তো একমাত্র পারে, মানুষকে সঠিক পথে চালনা করতে। আর তেমন চেষ্টাই করছেন অসমের জেলা পুলিশ।

সস্তা এবং স্বল্প সময়ের বিনোদন ক্রমশ আমাদের থেকে কেড়ে নিচ্ছে বই পড়ার অভ্যাস। বইয়ের শব্দে মনোযোগ দেওয়ার থেকে এখন আমাদের কাছে অনেক সহজ ফেসবুক বা ইউটিউবের সস্তা ভিডিও থেকে আনন্দ খুঁজে নেওয়া। এই একবিংশ শতাব্দীতে যা কিছু পরিশ্রমের, যা কিছু মনোঃসংযোগ দাবি করে, তার থেকে ক্রমাগত সরে আসছে মানুষ। জ্ঞান, বই- এসবের থেকে সরে আসছে দূরে।

বই পড়ার সুঅভ্যাস ফিরিয়ে আনতে নানা ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বিশ্ব জুড়েই। এসেছে বুক ক্যাফের ধারণা। যাতে সুস্বাদু খাবারদাবার, আড্ডা, গসিপের মাঝেই বইয়ের পাতা একটু উল্টেপাল্টে দেখেন আজকের জেন ওয়াই, জেন জেড-রা। বেঙ্গালুরুতে শুরু হয়েছে মুক্ত পাঠচক্রের ধারণা। প্রকৃতির মাঝে পার্কে ভিড় করে বসে তৈরি হচ্ছে বই পড়ার সুঅভ্যাস। আসলে সকলেই নিজেদের মতো করে চেষ্টা করছে। যাতে ফিরিয়ে আনা যায় বই পড়ার সুস্থ অভ্যাস।

আরও পড়ুন: টানা ছ’ঘণ্টা বই পড়া, সুস্থ নেশা টানছে এই শহরের বাসিন্দাদের

বেঙ্গালুরুর মতো এগিয়ে এসেছে অসমও। এখনও দেশের এমন অনেক জায়গা রয়েছে, যেখানে ডিজিটাল ইন্ডিয়া তো দূরের, নূন্যতম শিক্ষার সুযোগটুকুও অমিল। সেখানে বই পৌঁছে দিতে অসমে শুরু হয়েছে অভিনব এক উদ্যোগ। রাস্তার ধারেই গড়ে ওঠা ছোট ছোট লাইব্রেরি। যেখান থেকে বই মিলবে একেবারে নিখরচায়।

পাশেই অসম-গোলাঘাট সীমানা। তার পাশেই অসমের জেলা গোলাঘাট। সেখানকার চাঙ্গাজন এলাকায় রাস্তার ধারে ধারে গজিয়ে উঠেছে এমনই কিছু লাইব্রেরি। আগে আমাদের জীবনে লাইব্রেরি ব্যাপারটির বেশ আলাদা রকম একটা অস্তিত্ব। নানাবিধ বই খুঁজে খুঁজে এনে পড়া, সে সব ইস্যু করে বাড়ি নিয়ে যাওয়া, সময়ে শেষ করতে না পেরে লেট ফাইন দেওয়া, এসবই এখন নস্টালজিয়া। আজকাল বই আর তেমন কেউ পড়েন না। পড়লেও পিডিএফ ডাউনলোড করে নেন। ফলে বইয়ের পাতার সুঘ্রাণ আজ স্মৃতিমাত্র।

বই মানুষকে শিক্ষিত করে, সমৃদ্ধ করে। প্রয়োজনে হয়ে ওঠে সঙ্গীও। এমন অনেক মানুষই এক সময় আশপাশে দেখতে পাওয়া যেত, যাদের কাছে অবসর মানেই বইয়ের আরামে ডুবে যাওয়া। সেইসব বইপোকাদের সংখ্যা ক্রমশ কমছে। শিক্ষাই তো একমাত্র পারে, মানুষকে সঠিক পথে চালনা করতে। আর তেমন চেষ্টাই করছেন অসমের জেলা পুলিশ। পিডি ফাউন্ডেশন নামে একটি বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে জোট বেঁধে তারা চালু করেছে বেশ কয়েকটি স্ট্রিট লাইব্রেরি। যা সকলের জন্যই একেবারে বিনামূল্যে। পুলিশের বিশ্বাস, এই উদ্যোগ যেমন পড়ার অভ্যাস ফেরাবে, তেমনই সমাজ থেকে কমবে অপরাধের সংখ্যা।

গোলাঘাট জেলার পুলিশ সুপার পুষ্কর জৈন জানাচ্ছেন, এলাকার ছেলেমেয়েরা এই উদ্যোগে খুশি। তাদের টানছে এই অভিনব স্ট্রিট লাইব্রেরি। তারা এগিয়ে আসছে, উল্টেপাল্টে দেখছে পছন্দের বই, খুঁজছে পছন্দের বিষয়। শুধু অহমিয়া ভাষায় লেখা বই-ই নয়। হিন্দি, ইংরেজি বইও খুঁজছেন তারা। যেহেতু সেইসব বইয়ের জন্য় কোনও রকম টাকাপয়সা খরচ করতে হচ্ছে না তাদের, ফলে স্বাভাবিক ভাবেই জনপ্রিয়তা বাড়ছে স্ট্রিট লাইব্রেরির। গড়ে উঠছে বই পড়ার অভ্যাস। আসলে এতদিন অনেক জায়গাতেই ইচ্ছা থাকলেও বই পড়ার সুযোগ পেত না সেই সব এলাকার ছেলেমেয়েরা। সেই সুযোগটাই তাদের দিচ্ছে এই স্ট্রিট লাইব্রেরির ভাবনা। রাস্তার মাঝখানেই রয়েছে এই পাঠাগার। যে কেউ যে কোনও সময় এই পাঠাগার থেকে বই ইস্যু করতে পারেন, পড়তে পারেন। পুষ্করের আশা, মানুষ যত পড়বে, জানবে, শিক্ষিত হবে, তত কমবে সমাজ থেকে অপরাধপ্রবণতা।

এখনও পর্যন্ত বেশ ভালোই সাড়া পেয়েছে এই পথ-পাঠাগারের ভাবনা। গড়ে অন্তত ১৫টি করে বই ইস্যু হচ্ছে পাঠাগার থেকে। যে সংখ্যাটা বেশ আশাপ্রদ। চাঙ্গাজনের পর সরুপাথার এলাকাতেও একই রকম পথ-পাঠাগার গড়ার ভাবনা রয়েছে প্রশাসনের। আসলে এখানেই থামা নয়। আরও বড় পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে অসম পুলিশ। প্রায় প্রতিটি থানা-সংলগ্ন এলাকাতেই একটি করে এমন পাঠাগার খোলার কথা ভাবছে পুলিশ। যাতে আরও বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায় বই-বন্ধুটিকে।

অসমের পাশাপাশি অরুণাচল প্রদেশেও শুরু হয়ে এমন পথ-পাঠাগারের উদ্যোগ। নগুরাং মীনা নামে ব্যক্তির হাত ধরেছে শুরু হয়েছে সেই লাইব্রেরি। নগুরাং লার্নিং ইনস্টিটিউট নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাও চালান তিনি। নগুরাং ও বোন মিলে অরুণাচল প্রদেশে তৈরি করেছেন একই রকম একটি পাঠাগার। যা মানুষের বই পড়ার আগ্রহকে বাড়িয়ে তুলবে। আরও বইমুখী করে তুলবে আজকের নতুন প্রজন্মকে।

 

করোনাকালীন সময়ে প্রথম এমন পাঠাগার তৈরি করেন নগুরাং। সেটা ২০২০ সালে অগস্ট মাস। নিরজুলির রায়ো গ্রামে খোলা হয় প্রথম পথ-পাঠাগার। সেখান থেকে শুরু করে রাজ্যের আটটি এলাকায় তিনি খুলে ফেলেছেন একই রকম স্ট্রিট লাইব্রেরি। যা ইতিমধ্যেই দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। লাইব্রেরির পাশাপাশি রয়েছে সেখানে রয়েছে বেঞ্চ ও চেয়ারের সুবিধা। যেখানে বসে পছন্দের বই পড়তে পারেন পাঠক। নগুরাং জানিয়েছেন, তিনি আবার অনুপ্রাণীত হয়েছিলেন মিজোরামের একটি স্ট্রিট লাইব্রেরি থেকে। এই ভাবেই ব্যাটন বদলে যাচ্ছে হাতে হাতে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলিতে ছড়িয়ে যাচ্ছে বই পড়ার সুঅভ্যাস।

শিল্পে, ব্যবসায় বিনিয়োগ দেশকে এগোতে সাহায্য করে। প্রতিবেশী দেশদের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বন্ধুত্ব বজায় রাখতেও চলে কোটি কোটি টাকার লেনদেন। খানাখন্দবিহীন চকচকে রাস্তা, রাস্তায় আলো, শিল্প-বাণিজ্যের রমরমা, এসব দেশের উন্নতির জন্য জরুরি তো বটেই। তবে তার চেয়েও বোধহয় দেশের জন্য সবচেয়ে লাভবান বিনিয়োগ, তা নাগরিকদের মধ্যে শিক্ষাকে ছড়িয়ে দেওয়া। আর সেই কাজে লাইব্রেরি স্থাপনের মতো বিনিয়োগ হয় না বললেই চলে। আর এই সব খুদে পথ-পাঠাগারগুলি কিন্তু একদিক থেকে দেখতে গেলে এই দেশগড়ার কাজই করে চলেছে অবিরত।

আরও পড়ুন: কলেজস্ট্রিটের প্রাচীন দোকানে এখনও উদ্বাস্তু গন্ধ! কেমন আছে পুরনো বইয়ের ব্যবসা?

তবে এই সব পাঠাগারের একটি অলিখিত নিয়ম রয়েছে। চাইলে এই সব পাঠাগারে ব্যবহার করা বই দিয়ে নতুন বই একেবারে বিনামূল্যে নিয়ে যেতে পারেন পাঠকেরা। পাঠক এবং বই, এসবের উপর নজর রাখার জন্য কোনও নিরাপত্তাকর্মী নেই। কিছুই নেই। শুধু বিশ্বাস আর শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার ভরসাটুকু নিয়ে রমরমিয়ে চলছে এই পথ-পাঠাগার। কেউ বই নিয়ে, পড়ে তা ফিরিয়ে দেবেন, এই বিশ্বাসটুকু বুকে নিয়েই নতুন রাস্তা দেখাচ্ছে ভারতের সেভেন সিস্টারস রাজ্যগুলি। তারা যদি পারে, বাকি দেশও কি পারবে না, এমন এক দুর্দান্ত উদ্যোগ নিতে। বই পড়ার অভ্যেস উপহার দিতে বাসিন্দাদের।

More Articles