টানা ছ'ঘণ্টা বই পড়া, সুস্থ নেশা টানছে এই শহরের বাসিন্দাদের

Cubbon Reads, Bengaluru: বয়সের কোনও বাধ্যবাধকতা নেই এই পাঠচক্রে যোগ দেওয়ার জন্য। ৭০ বছরের বৃদ্ধ যেমন বই নিয়ে হাজির হন সেখানে, তেমনি এক বছরের শিশু আর কয়েকটি শিশুপাঠ্য বই নিয়ে চলে আসেন তরুণী মা।

বীজাণু, অতিমারি, রোগ, মৃত্যু সামগ্রিক পৃথিবীতে এমন এক বিষবাষ্প ছড়িয়েছে, যে করোনা শেষ হয়ে গেলেও তার রেশ রয়ে গিয়েছে আমাদের ভিতরে খুব গহিনে কোথাও। সামাজিক, পারষ্পরিক দূরত্বের নামে যে অবিশ্বাস আমাদের মনে পোঁতা হয়ে গিয়েছে, তার শিকড় চাড়িয়ে গিয়েছে অনেক ভিতরে। বেঁধে বেঁধে থাকার চিরকালীন যে স্বর তার ছন্দপতন হয়েছে। তবে তাই বলে চেষ্টাচুকু তো আর বন্ধ হয় না।

অনেকেই অভিযোগ করেন, প্রযুক্তির যুগে মানুষ বই পড়ার আগ্রহ হারিয়েছেন। হাতে উঠে এসেছে কিন্ডলের মতো একাধিক প্রযুক্তির আশীর্বাদ। বই ছাড়াও মিলবে বইয়ের স্বাদ। তবে জরুরি মাধ্যম নয়, জরুরি পড়া। আর সেই পড়া কিংবা কাজকে সঙ্গী করেই যদি মানুষ মানুষের কাছাকাছি আসতে পারে, তার চেয়ে ভাল কী-ই বা হতে পারে। আর ঠিক তেমন ব্যবস্থাই করেছে বেঙ্গালুরুর একটি পার্ক।

আরও পড়ুন: বইমেলা থেকে নিষিদ্ধপল্লি- সব একাকার ছিল কলেজস্ট্রিটের এই আড্ডায়

শনিবার সকাল সাড়ে ন'টা বাজতে না বাজতেই ভিড় জমতে শুরু করে বেঙ্গালুরুর কাবন পার্কে। ঘোড়সওয়ার স্যার মার্ক কার্বনের মূর্তির পাশেই রয়েছে ইয়াব্বড় একটি পিপুল গাছ। তার নিচেই জড়ো হতে শুরু করেন লোকজন। কারও হাতে বই, কারও হাতে কিন্ডেল তো কারও হাতে ল্যাপটপ। যে যার মতো মাদুর, কম্বল বিছিয়ে বসে পড়েন। কেউ বা কলম নিয়ে খোলা ডায়েরির পাতা ভরাচ্ছেন, কেউ বা তুলি হাতে ছবি আঁকছেন। কেউ বা আবার বসে পড়েছেন উল-কাঁটা নিয়ে। কেউ কারওর সঙ্গে উচ্চস্বরে কথা বলছেন না বটে, আড্ডা মারছেন না বটে, তবে গড়ে উঠছে এক সৌজন্যের সেতু। বন্ধুত্বের পরিবেশ।

কাবন রিডস। এই নামেই পরিচিত হয়ে গিয়েছে পার্কের এই শনিবারের আড্ডা। গত বছর ডিসেম্বরে হর্ষ স্নেহাংশু ও শ্রুতি শাহ মিলে এই নতুন উদ্যোগের শুরু করেন। লাইব্রেরি বা বুক ক্লাব কোনও নতুন বিষয় নেই। এ দেশের অলিগলিতে এমন অনেক বুকক্লাব মিলবে, যেখানে গোমড়ামুখো লোকেরা চোখে চশমা এঁটে গভীর মনোযোগ দিয়ে বই পড়েন। মুশকিল হচ্ছে, সেখানে বেঁধে দেওয়া বইয়ের মধ্যে সীমিত রাখতে হয় পঠনতালিকা। আর সেখানেই আলাদা এই পাঠচক্র। এখানে পছন্দমতো বই নিয়ে এসে বসে পড়তে পারলেই হল। এরপর মনপ্রাণ খুলে পড়ো, নিজের কাজ করো। সবুজ ঘাসের উপর প্রকৃতির সঙ্গে ব্যাস্ত জীবনের কিছুটা সময় ব্যায় করো। এই ভাবনা থেকেই পথচলা কাবন রিডসের। তবে শর্ত একটাই, নীরবতা। শহরের ক্যাকাফোনির ছাপ কোনও মতেই যাতে এখানে এসে না পড়ে, তা সুনিশ্চিত করতে হবে পাঠকদের। তবেই মিলবে প্রবেশাধিকার। আর পাঠআড্ডার শেষে তোলা হবে একটি করে গ্রুপ ফটো। আসর চলবে সাড়ে ন'টা থেকে দুপুর দু'টো পর্যন্ত। তেমনটাই দস্তুর।

হর্ষ একজন উদ্যোগপতি, এবং শ্রুতি মার্কেটিংয়ের মানুষ। পাশাপাশি বেকিং করতে ভালোবাসেন তিনি। হঠাৎ করেই একদিন মাথায় এসে গিয়েছিল ভাবনাটা। রূপায়ণেও দেরি হয়নি। তবে তা যে সত্যিই এত বড় হয়ে উঠবে, তা ভাবতেও পারেননি শ্রুতিরা। ইনস্টাগ্রামে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন প্রাথমিক ভাবে। সেখানে কয়েকজন আগ্রহ দেখান। জানান, যোগ দিতে চান এই উদ্যোগে। ছোট করেই শুরু হয়েছিল পথচলা। প্রথম সেশনে মাত্র পাঁচ জন এসেছিলেন। তৃতীয় সেশনে আসেন মাত্র একজন। দমে যাননি হর্ষ-শ্রুতি। বরং প্রচার চালিয়ে গিয়েছেন পুরোদমে। আস্তে আস্তে ছড়িয়ে গিয়েছে এই অভিনব পাঠচক্রের কথা। ক্রমশ ভিড় হতে শুরু করে। এক, পাঁচ, দশ থেকে শুরু করে ১৫তম বৈঠকে গিয়ে ক্রমে লোকসংখ্যা পৌঁছয় ৫০-এ। বয়সের কোনও বাধ্যবাধকতা নেই এই পাঠচক্রে যোগ দেওয়ার জন্য। ৭০ বছরের বৃদ্ধ যেমন বই নিয়ে হাজির হন সেখানে, তেমনি এক বছরের শিশু আর কয়েকটি শিশুপাঠ্য বই নিয়ে চলে আসেন তরুণী মা। এখন ঠিক কতজন আসেন, তা আর গুনে উঠতে পারেন না হর্ষ-শ্রুতি। কিছু কিছু সময়ে ৬০০-৭০০ জন পর্যন্ত এসে পড়েন পাঠচক্রে।

এই পাঠচক্রের নিয়মিত সদস্য যাঁরা, তাঁদের অনেকেই বলেছেন, এখানে এসে সমস্ত রকম চাপ, দুশ্চিন্তা, হতাশা ভুলে যান তাঁরা। এক অন্যরকম শান্তি, স্থিরতা পান তাঁরা। যাঁরা একটু অন্তর্মুখী, তাঁদের জন্য তো সেরা ঠিকানা এই কাবন রিডস। পাঠচক্রের জন্য আশপাশটি সুন্দর করে সাজিয়ে তুলেছেন শিল্পী অম্বরীশ। এর আগে তথ্যচিত্র ফটোগ্রাফার হিসেবে কাজ করতেন তিনি। দু'বছর আগে একটি দুর্ঘটনায় ব্রেন হ্যামারেজ হয় অম্বরীশের। প্রায় দু'বছরের জন্য চলৎশক্তি হারান তিনি। সে সময় কাবন পার্কের একেকটা করে অংশ মনের রঙে রাঙিয়ে তোলা শুরু করেন অম্বরীশ। শুধু পাঠচক্রের সদস্যদের জন্যই নয়, রাস্তার কুকুরদের জন্যও ওই পার্কের ভিতর একটি আশ্রয় সাজিয়ে দিয়েছেন অম্বরীশ।

আরও শুনুন: শিল্পসম্মত নয়, ‘বিচ্ছিরি’ ছবিকেই বিশ্বের সামনে তুলে ধরে ‘মিউজিয়াম ফর ব্যাড আর্টস’

ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা বাড়ছে কাবন রিডসের। ইতিমধ্যে এই উদ্যোগের প্রশংসা শোনা গিয়েছে খোদ প্রধানমন্ত্রীর মুখে। বেঙ্গালুরুতেই এমন পাঠচক্র রয়েছে মোট ৬টি, যার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হর্ষ-শ্রুতির এই অভিনব পাঠ-উদ্যান। বই পড়ার অভ্যাস যেমন দিন দিন কমছে, তেমনই কমছে মানুষের সঙ্গে মানুষের সামনাসামনি সাক্ষাতের সুযোগ। ঘরে বসেই হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুকে সারা হয়ে যায় কথা। জুম কলে চলে ভিডিও সাক্ষাৎ। মানুষ ভাবছে, তাঁরা একে অপরের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে, কিন্তু আদতে বিচ্ছিন্নতার এক উপদ্বীপে আমরা বাস করছি প্রতিদিন। নিজের সঙ্গে নিজের বাস, যেখানে ক্রমশ প্রবেশাধিকার হারাচ্ছে স্বজন, বান্ধব- প্রতিবেশী। আর সেই জায়গা থেকেই সরিয়ে এনে একটা নতুন সমাজ গড়ে তোলার দায়িত্ব নিয়েছে কাবন রিডস। যেখানে সকলের মধ্যে থেকেই নিজের সঙ্গে একা হতে পারেন মানুষ। ডুবতে পারেন বইয়ের গহিনে, কিংবা কাজের সমুদ্রে। কিন্তু গোটাটাই হোক জনসমুদ্রের মাঝখানে দাঁড়িয়ে। মানুষের মধ্যে বাড়ুক সৌজন্য, যা ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে পৃথিবী থেকে। আর সেই ভাবনা নিয়েই কাজ করে চলেছে কাবন রিডস।

More Articles