গ্লেনারিজ: যে চুম্বক লাখো মানুষকে ফিরিয়ে আনে দার্জিলিংয়ে

গ্লেনারিস বেকারি, ক্যাফে এবং কেক শপ সকাল ৭টা থেকে রাত ৮টা অবধি খোলা থাকে। বর্তমান সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য এই রেস্তোরাঁটিতে রয়েছে ফ্রি ইন্টারনেটের সুবিধাও।

পাহাড় ঘেরা দার্জিলিং শহরের কোলে অবস্থিত সেকালের-একালের গ্লেনারিস। এই গ্লেনারিসের জনপ্রিয়তা এতখানি যে, সদ্য দার্জিলিং থেকে ঘুরে আসা লোকটির সোশ্যাল মিডিয়ার প্রোফাইলে সবুজ কিংবা নীলচে পাহাড়ের ছবি থাকুক বা নাইই থাকুক– আলো-জ্বলজ্বলে ‘হোপ’ লেখা রেস্তোরাঁর সামনে দাঁড়িয়ে ছবি একখানা অবশ্যই থাকবে। বলতে গেলে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গ্লেনারিসই যেন দার্জিলিং-এর পরিচয় বাহক হয়ে উঠছে।

কুয়াশামাখা দার্জিলিং ম্যাল থেকে গুটি গুটি পায়ে নেহরু রোডে পৌঁছলেই চোখে পড়বে আলোকোজ্জ্বল গ্লেনারিস। পাহাড়ের কোলে অবস্থিত এই রেস্তোরাঁর রূপ যেন সময়ের সঙ্গে সঙ্গেই বদলে যায়। তাই সকাল এবং সন্ধ্যার গ্লেনারিসের মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক। গ্লেনারিসের অদ্ভুত মায়া যেমন সদলবলে দার্জিলিং-এ ঘুরতে যাওয়া উঠতি বয়সের তরুণ-তরুণীদের মন জয় করবে, তেমনভাবেই আবার সান্ধ্যকালীন আসরে গানে গানে মন ভরবে দলছুট পাখিদেরও। তাই সেই ১৯৩৫ সাল থেকে গ্লেনারিস একইভাবে, অবিচ্ছিন্ন গতিতে দার্জিলিং-এ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে। বর্তমানের দার্জিলিং শহরে রোজ গজিয়ে ওঠা হাজারও নতুন রেস্তোরাঁর ভিড়ে গ্লেনারিস কিন্তু আজও দার্জিলিংগামী প্রতিটা পর্যটকেরই অন্যতম ডেস্টিনেশন। প্রায় একশো বছরের কাছাকাছি পুরনো এই রেস্তোরাঁর পিছনে লুকিয়ে আছে অনেক ইতিহাস। দেখে নেওয়া যাক, কেন কেবল গ্লেনারিসের জন্যও একবার ছুটে চলে যাওয়া যায় দার্জিলিং-এ।

অতীত গ্লেনারিস
আজকের গ্লেনারিসের সঙ্গে কিন্তু তাঁর প্রথম অবস্থার আকাশপাতাল তফাৎ রয়েছে। একথা কমবেশি প্রায় সকলেরই বোধহয় জানা যে, গ্লেনারিস যেমন তার কেকের জন্য বিখ্যাত, ঠিক একইভাবে বিখ্যাত ব্রিটিশ ব্রেকফাস্টের জন্য। মনে করা হয়, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ভারতে ইংরেজদের প্রাতরাশের চাহিদা মেটানোর উদ্দেশেই এককালে তৈরি হয়েছিল এই রেস্তোরাঁটি। গ্লেনারিসের সূচনা হয় একজন ইতালিয়ান ব্যক্তির হাত ধরে, তখন রেস্তোরাঁটির নাম ছিল ‘ভাদো’ এবং পরবর্তী সময়ে আবার ভাদোর পরিবর্তে আসে ‘প্লিভা’ নামটি। ভারতের স্বাধীনতার পর এই রেস্তোরাঁটি পাটনার এক পরিবার কিনে নেয় এবং ১৯৫৯ সালে টি এডওয়ার্ড নামের এক ব্যক্তি, যিনি কর্মসূত্রে ১৯৪৫ সাল থেকে দার্জিলিংয়েই ছিলেন, তাঁকে ম্যানেজার হিসাবে নিয়োগ করা হয় এই গ্লেনারিসে। এইখানেই যে অতীত গ্লেনারিসের হস্তান্তরের ইতি ঘটেছিল তা কিন্তু নয়, অবশেষে এই টি এডওয়ার্ড-এর পরিবার কিনে নেয় রেস্তোরাঁটি।

আরও পড়ুন: মাত্র তিনদিনেই দার্জিলিং জমজমাট! চেনা জায়গায় অচেনা সফরের স্বাদ পেতে ঘুরে আসুন

এরপর থেকেই গ্লেনারিসের ভোল পাল্টে যেতে থাকে। রেস্তোরাঁর নতুন মালিক পরিবারের লোকরা গোটা রেস্তোরাঁটিকে নতুনভাবে সাজানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করে এবং এই রেনোভেশনের ফলস্বরূপ আজকের গ্লেনারিস, গ্লেনারিস হিসেবে নতুন রূপ পায়। অতীত কাল থেকে চলে আসা একটি রেস্তোরাঁকে সম্পূর্ণ নতুনভাবে সাজানো এবং বিশেষ করে তার নাম বদলে দেওয়া– এই সমগ্র বিষয়টা কিন্তু একেবারেই সোজা ছিল না, কিন্তু ওই যে কথায় আছে না, ইচ্ছে থাকলেই উপায় হয়, ঠিক সেইভাবেই এডওয়ার্ড পরিবারের সদস্যরা ঠিক করেন, নাম বা রূপ বদলালেও রেস্তোরাঁটির সবকিছু থাকবে ঠিক আগের মতোই। এরপর থেকে আজ অবধি গ্লেনারিসকে কখনও ফিরে তাকাতে হয়নি। আপনারা হয়তো জানলে অবাক হবেন, পরিবারের কাছে এখনও প্রথম দিনের বিক্রির তালিকাটি রাখা আছে এবং সেই তালিকা অনুযায়ী প্রথমদিনেই নতুন রূপে অবস্থান করা গ্লেনারিসে বিক্রিবাটা হয়েছিল ৩৯৬ টাকার।

Glenary's Hope hoarding

নতুন ছবি তোলার ঠিকানা এই বারান্দা

আজকের গ্লেনারিস
সাদা ধবধবে দোতলা রেস্তোরাঁটি বর্তমানে তিনটি ভাগে বিভক্ত। গ্লেনারিসের বেকারি বিভাগটি নীচতলায় অবস্থিত, গ্লেনারির ক্ল্যাসিক রেস্তোরাঁটি রয়েছে উপরের তলায় এবং বেসমেন্টে রয়েছে একটি আধুনিক পাব বা ট্যাভার্ন, যাকে আবার ‘বাজ’ বলা হয়ে থাকে। বেকারি, রেস্তোরাঁ এবং পাব-সমন্বিত এই তিনটি ইউনিট- একত্রে The Glenary’s Bakery and Café নামে পরিচিত।

গ্লেনারিস বেকারি
এক বিরাট আকারের কাঠের ফ্রেমযুক্ত কাচের দরজার ওপারেই অবস্থান করছে বিখ্যাত বেকারি বিভাগ। এই বিভাগে আওনি কেক ছাড়াও নানা রকমের বেকড আইটেম পাওয়া যাবে। আপনি চাইলে বাঁদিকে রাখা সারি সারি সোফায় বসে যেমন সেই রকমারি আইটেমগুলি উপভোগ করতে পারেন, তেমনই আবার চাইলে আত্মীয়-পরিজনদের জন্য প্যাকেট করে নিয়েও আসতে পারবেন। অতীতকাল থেকেই এই রেস্তোরাঁ বিখ্যাত সকালের জলখাবারের জন্য। রৌদ্রোজ্জ্বল তুষারাবৃত কাঞ্চনজঙ্ঘার সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে সকালের খাবার আস্বাদনের উদ্দেশ‍্যেই একটি ব্যালকনিরও ব্যবস্থা রয়েছে এই রেস্তোরাঁয়। সকালের খাবার হিসেবে আপনি পেয়ে যাবেন রোল, পিৎজা, বার্গার, পাই, কেক, পেস্ট্রি- এছাড়াও সঙ্গে থাকতেই পারে দার্জিলিং-এর স্বাদে, গন্ধে জগৎবিখ্যাত চা কিংবা কফি অথবা হট চকোলেট। এই ক্যাফেতে রয়েছে পুরনো দিনের লাল রঙের একটি টেলিফোন বুথ। এই টেলিফোন বুথ যেন আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে জানান দেয় গ্লেনারিসের বয়স।

Glenary's

গ্লেনারিজের বারান্দা

রেস্তোরাঁ
ওপরতলায় অবস্থিত রেস্তোরাঁটি একটি মাল্টি-কুইজিন রেস্তোরাঁ। এখানে যেমন আপনি তন্দুর-জাতীয় ভারতীয় খাবার যেমন পাবেন, তেমনই পাবেন নানারকম সসে ঠাসা চাইনিজ খাবার, ঠিক তেমনভাবেই স্টেক, সিজলার-সহ নানাবিধ কন্টিনেন্টাল খাবারের লোভও আপনি সামলাতে পারবেন না। রেস্তোরাঁর টেবিলে পাতা লিনেন কাপড়ের টেবিল ক্লথ যেমন ভারতীয় সংস্কৃতিকে উপস্থাপন করে, ঠিক সেইভাবেই রেস্তোরাঁর আসবাবপত্রগুলিতে ইউরোপীয় সংস্কৃতির প্রভাব স্পষ্ট। এককথায়, গ্লেনারিস অনবদ্য।

পাহাড়ে সন্ধে নামে খুব তাড়াতড়ি আর রাত্রি আসে তার চেয়েও দ্রুত পায়ে। সেই কারণেই গ্লেনারিস বেকারি, ক্যাফে এবং কেক শপ সকাল ৭টা থেকে রাত ৮টা অবধি খোলা থাকে। বর্তমান সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য এই রেস্তোরাঁটিতে রয়েছে ফ্রি ইন্টারনেটের সুবিধাও। রেস্তোরাঁয় আগত পর্যটকদের যেন ইন্টারনেট পরিষেবা পেতে কোনওরকম অসুবিধে না হয়, সেই কথা মাথায় রেখেই ক্যাফের ডানদিকে ৬টি পিসিও-র বন্দোবস্ত রয়েছে।

 

More Articles