গুকেশ: নিশীথ সূর্যের দেশে স্বপ্ন-ভোরের আলো

Gukesh Dommaraju: সারা পৃথিবীর সবাই ম্যাগনাসকে এন্ডগেমের রাজা বলে জানে, এই পরিস্থিতিতে তিনি ব্লাইন্ড ফোল্ডেও অনায়াসে জিতে যাবেন বলেই সকলের বিশ্বাস, ঠিক সেখানেই আঘাত হেনেছেন গুকেশ।

‌ ‌২০০০, ২০০২, ২০০৭, ২০০৮, ২০১০—পরপর পাঁচবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হন বিশ্বনাথন আনন্দ। এরপর ২০১৩ সালে কার্লসেন যখন আনন্দের থেকে বিশ্ব দাবার মুকুট ছিনিয়ে নেন, সে বছরই ডোম্মারাজু গুকেশ দাবা খেলা শুরু করেন। জানি না, সেই হার দেখে তাঁর কোচ তাঁকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিলেন কিনা যে, নরওয়েজিয়ান কার্লসেনকে একদিন হারাতেই হবে। আর সেই জয়টা শুধু গুকেশের হবে না, হবে গোটা ভারতের। ভারতবর্ষের দাবাকে আনন্দ যে উচ্চতায় তুলে ধরেছেন, সেখান থেকে ভারত একে একে পেয়ে গিয়েছে প্রজ্ঞানন্দ, অর্জুন, বিদিত এবং সর্বোপরি গুকেশের মতো প্রতিভা। কিন্তু বিশ্বমঞ্চের পথ আনন্দই প্রথম দেখিয়েছিলেন। তাই নরওয়ে ক্লাসিক্যাল চেস-এ গুকেশের কাছে ম্যাগনাসের হার নিছক পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা নয়, এর পেছনে এক সুদীর্ঘ ইতিহাস লুকিয়ে আছে। আনন্দ যেদিন বিশ্ব দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে কার্লসেনের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন, সেদিনই ঠিক হয়ে গিয়েছিল যে কার্লসেনও একদিন কোনও না কোনও ভারতীয়ের কাছে পরাজিত হবেন, কারণ সেদিনের পরাজিত প্রতিযোগীর নাম ছিল বিশ্বনাথন আনন্দ। হার থেকে শিক্ষা নিয়ে ঠান্ডা মাথায় কী করে প্রতিপক্ষকে দুরমুশ করতে হয় তার এক অনন্য উদাহরণ। সেই কিংবদন্তিকে যখন অলিম্পিক দাবায় গুকেশরা সহযোদ্ধা হিসেবে পেয়েছিলেন তখনই লিখিত হয়েছিল, ভারতীয় দাবার ভবিষ্যৎ কী হতে চলেছে। তারপর দিনের পর দিন অনুশীলন, মানসিক সমর্থন, সঙ্গে বিশ্বমঞ্চে যুযুধান প্রতিপক্ষদের স্নায়ুযুদ্ধের পারদের ওঠানামা— সবটাই আনন্দের কাছ থেকে জলের মতো বুঝে নিয়েছেন গুকেশরা। তাই প্রজ্ঞানন্দের কাছে মাঝে মাঝে হারতে হয় কার্লসেনকে। ফলে ভারতীয়রা তাঁর প্রতিপক্ষ হলে অদ্ভুত এক মানসিক উদ্বেগের মধ্যে পড়ে কার্লসেন। তাই বলে অবশ্য কার্লসেন হারিয়ে গেছেন, ফুরিয়ে গেছেন, তাঁর মধ্যে দাবার কিছু অবশিষ্ট নেই— এরকম বলার সময় এখনও আসেনি। কিন্তু গুকেশের খেলা নিয়ে তাচ্ছিল্য করা, দাবার বোর্ডে অনভিপ্রেত আচরণ, দুর্বিনীত ব্যবহারের বহিঃপ্রকাশ— এসবের মধ্যে কার্লসেনের ভেতরের অসম্ভব চাপের বিষয়টাও উঠে আসে।

আসলে দু' বছরের মধ্যে নরওয়ে দাবায়, যা কার্লসেনের ঘরের মাঠ, দুই ভারতীয় (প্রথমে প্রজ্ঞানন্দ ও পরে গুকেশ) ক্লাসিক্যাল ফর্ম্যাটে তাঁকে পরাজিত করছে, এ মেনে নেওয়া তাঁর মতো কিংবদন্তির কাছে খুবই কঠিন। আর কার্লসেনের এই হার কেবলমাত্র প্রজ্ঞানন্দ ও গুকেশের কাছে হার নয়, আনন্দের কাছেও পরাজয়। এটাই তাঁকে ভিতরে ভিতরে উত্তেজিত করে তুলছিল। তাই ম্যাগনাস পরাজয়ের রাগ সহ্য করতে না পেরে দাবার বোর্ডে এত জোরে ঘুঁষি মারেন যে, বোর্ডটি কেঁপে ওঠে এবং ঘুঁটিগুলো পড়ে যায়। পরে যদিও কার্লসেন নিজেকে সামলে নিয়ে সদ্য ঊনিশে পড়া ভারতীয়ের কাছে দু'বার ক্ষমা চেয়েছিলেন এবং খেলা শেষ হওয়ার পর তাঁর পিঠ চাপড়ে দিয়েছিলেন।

আরও পড়ুন- বছর শেষে যা শিখিয়ে গেলেন চ্যাম্পিয়ন গুকেশ

কার্লসেনের পরাজয় যে দাবা বিশ্বকে নাড়া দিয়েছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিংবদন্তি দাবা খেলোয়াড় সুসান পোলগার বলছেন, "কার্লসেন দুর্দান্ত খেলেছিলেন কিন্তু একটি বড় ভুলের কারণে হেরে যান। এটি তাঁর বর্ণাঢ্য কেরিয়ারের সবচেয়ে বেদনাদায়ক পরাজয়গুলির মধ্যে একটি।"

এই জয়ের মাধ্যমে ডি গুকেশ প্রমাণ করেছেন যে, তিনি এই প্রজন্মের অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র। গুকেশ নিজেই নিজের সাফল্যকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। গুকেশ যখন দাবাতে সাফল্য পেতে শুরু করেন, পেশায় কান-নাক-গলার চিকিৎসক বাবা রজনীকান্ত তখন ডাক্তারি পেশা ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। গভীর আর্থিক সংকটে পড়ে পরিবার। তখন পেশায় মাইক্রো-বায়োলজিস্ট মায়ের উপার্জনেই সংসার চলেছে। সে এক অবর্ণনীয় অবস্থা। কিন্তু হাল ছাড়েননি গুকেশের বাবা-মা। দিনের পর দিন ধ্যানমগ্ন তপস্বীর মতো সাধনা করে গেছেন গুকেশ। মাঝে তাঁর থেকে প্রজ্ঞানন্দ যখন বেশি সাফল্য পাচ্ছিলেন, তখনও এতটুকু বিচলিত হননি। নিজের কাজ নীরবে করে গেছেন।

নরওয়ে ক্ল্যাসিক্যাল চেসের ষষ্ঠ রাউন্ড। খেলা হচ্ছে গুকেশ বনাম ম্যাগনাস। প্রথম রাউন্ডের মতোই অনায়াস জয়ের দিকে এগোচ্ছিলেন ম্যাগনাস। উপর্যুপরি দু'বার হারের অপেক্ষায় গুকেশ। কিন্তু হাল ছাড়াবার পাত্র নন তিনি। ম্যাচ শেষ হতে মিনিট দশেক বাকি, চেস ইঞ্জিন বলছে ম্যাগনাস এগিয়ে +৪। সারা পৃথিবীর সবাই তাঁকে এন্ডগেমের রাজা বলে জানে, এই পরিস্থিতিতে তিনি ব্লাইন্ড ফোল্ডেও অনায়াসে জিতে যাবেন বলেই সকলের বিশ্বাস, ঠিক সেখানেই আঘাত হেনেছেন গুকেশ। নিখুঁত এন্ডগেম খেলে স্নায়ুকে নিয়ন্ত্রণে রেখে হারিয়ে দিয়েছেন কার্লসেনকে। ক্লাসিক্যাল দাবায় ম্যাগনাসের বিরুদ্ধে গুকেশের এটি প্রথম জয়। যতই ডিং লিরেনকে হারিয়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হোন না কেন, এই সময়ের সেরা কিংবদন্তি ম্যাগনাসকে হারানোর অনুভূতি যে সম্পূর্ণ আলাদা— সেই ঘোর কাটতে অনেকটা সময় লেগেছিল গুকেশের। ১২ বছর আগে আনন্দের বিরুদ্ধে বিশ্বজয়ের ম্যাচে কার্লসেন যেমন নিজের উপরে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন যে তিনি পারবেন, এখানেও ম্যাগনাসের সামান্য ভুলের সুযোগে নিয়ে গুকেশও বিশ্বাস করতে শুরু করলেন যে তিনি পারবেন। ম্যাগনাস যে ভিনগ্রহের মানুষ নন, তাঁকেও যে হারানো যায় — এই বিশ্বাসটাই গুকেশকে এই জায়গায় নিয়ে এসেছে।

আরও পড়ুন-নেশার খেলা থেকে স্নায়ুর যুদ্ধ, জীবনকে মাপছে দাবা

ম্যাগনাস কার্লসেনকে গুকেশ নিজে বহুবার 'অনুপ্রেরণা' বলে মনে করেছেন। সর্বসমক্ষে, অসম্ভব বিনয় এবং শ্রদ্ধাবোধ নিয়ে উচ্চারণ করেছেন "আমি বিশ্ববিজেতা হতে পারি কিন্তু ম্যাগনাস এখনও শ্রেষ্ঠ"। অন্যদিকে ম্যাগনাসকে দেখলেও অবাক হতে হয়। আন্তর্জাতিক মিডিয়া হোক বা পডকাস্ট বা ইন্টারভিউ— সব জায়গায় গুকেশকে অবজ্ঞা করেছেন, গুকেশের খেলা নিয়ে বিদ্রূপের হাসি হেসেছেন।এই টুর্নামেন্টের আগের ম্যাচেই গুকেশকে হারিয়ে টুইট করেছেন, "হোয়েন ইউ কাম ফর দ্য কিং, ইউ বেটার নট মিস।"

অবজ্ঞা, অবজ্ঞা এবং অবজ্ঞা। গুকেশ কিন্তু বিচলিত হননি। আনন্দ যখন সম্রাজ্য হারাচ্ছেন, তখন তাঁর বয়স ছিল ৪৪, ম্যাগনাস সবে ২১ ছুঁয়েছেন তখন। আর গুকেশ যখন সাম্রাজ্যের দখল নিচ্ছেন তখন সদ্য ১৮ পেরোচ্ছেন। তিনি সর্বকনিষ্ঠ বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। এক তৃতীয় বিশ্বের দেশ থেকে সদ্য ১৮ পেরনো কেউ বিশ্ব মুকুট পরবে, পশ্চিমি দুনিয়ার কাছে এ মেনে নেওয়া সহজ কথা নয়। তাই গুকেশকে প্রতি মুহূর্তেই অগ্নিপরীক্ষা দিতে হচ্ছে। ৩৪-এর পরিণত ম্যাগনাস কিংবদন্তি হলেও ভদ্রতায় তিনি সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ গুকেশের কাছে পরাজিত হয়েছেন। সারা বিশ্ব জেনেছে, একদিন দাবা শিখিয়েছিল ভারত, আগামী দিনেও দাবা শেখাবে ভারতই।

দ্য গোট, দ্য লেজেন্ড ম্যাগনাস কার্লসেন গুঁড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন গুকেশকে। সাদা-কালো দু'রকম ঘুঁটিতেই সদর্পে হারিয়ে বোঝাতে চেয়েছিলেন, তিনিই শ্রেষ্ঠ, তিনিই অপ্রতিরোধ্য। ম্যাগনাস নিঃসন্দেহে এখনও অবিসংবাদিত 'দ্য জায়েন্ট অন বোর্ড'। তবে ১৯ বছরের গুকেশের জন্য এই জয় সাহস জোগাবে, সমৃদ্ধ করবে, আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেবে, হয়তো আরেক অবিসংবাদিত সম্রাট তৈরির পথ প্রশস্ত করবে। অপেক্ষা করবে গোটা ভারত, আর দেখবে গোটা বিশ্ব। ম্যাগনাসের কথার সূত্র ধরেই তাই বলা যায় — "হি কেম ফর দ্য কিং অ্যান্ড দিস টাইম, হি ডিড নট মিস।"

 

লেখক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবা প্রশিক্ষক

More Articles