পরকীয়া, অবাধ যৌনতা! মেসিদের হারের নেপথ্যনায়ক হার্ভে রেনার্ডের জীবন নিয়ে তোলপাড়
FIFA World Cup 2022: আর্জেন্টিনা, বিশ্বকাপের মঞ্চ আর কাতার উষ্ণতা ছাড়িয়েও তিনিই হয়ে উঠেছেন জয়ের টনিক।
আর্জেন্টিনা। ফুটবল-বিশ্বের দাপুটে এই দেশের সামনে দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখেছে সৌদি আরব। তৃতীয় বিশ্বের আর্জেন্টিনাকে খেলার মাঠে নাস্তানাবুদ করেছে মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশ। মাত্র ১০ মিনিটের মেসি-ম্যাজিক ছাড়িয়ে নীল-সাদা পরিবারের সদস্যদের উড়িয়ে দিয়েছেন আল ওয়েসি, আল দাওয়াসারি, সেহরিরা। মার্টিনেজদের মুহূর্তেই শেষ করেছে বিশ্বের ফুটবল মানচিত্রে ৫১ নম্বর স্থানে থাকা এই দল।
একাধিক আলোচনা, জল্পনার মধ্যেই আর্জেন্টিনার (Argentina) হারের ইতিহাসে কালো দিন হিসেবে উঠে এসেছে এদিনের ম্যাচ। কিন্তু এই হারের নেপথ্যে কে? গোলকিপার আল ওয়েস (Al Owais) থেকে শুরু করে সৌদি আরবের জাতীয় দলের অন্যান্য ফুটবলাররা সকলের প্রশংসার মধ্যেই উঠে আসছে আরও একটি নাম। কেউ কেউ বলছেন, এই বিখ্যাত নেপথ্য নায়ক না থাকলে অসাধ্যসাধন করতেই পারতেন না সৌদিরা! কিন্তু কে তিনি?
হার্ভে রেনার্ড
সৌদি আরবের জাতীয় ফুটবল দলের বর্তমান কোচ। পুরো নাম হার্ভে জিন-মারি রজার রেনার্ড ১৯৬৮ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর, ফ্রান্সের এইক্স লেস বেইন্সে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ছোট থেকেই খেলাধুলার শখ। খুব কম বয়সেই রপ্ত করে ফেলেন ফুটবল খেলার অভ্যাস। ফ্রান্সের বাসিন্দাদের মধ্যে ফুটবলের প্রবল জনপ্রিয়তা থাকায় তিনিও সুযোগ পেলেন ফুটবল খেলার। পারিবারিক আপত্তি আসেনি কোনও দিন। এরপর পড়াশুনা আর খেলা চলল একই সঙ্গে। কর্মজীবন, খেলোয়াড় জীবনের মধ্যেই বিতর্কে জড়ালেন সম্পর্ক নিয়েও। প্রথমদিকে বিবাহিত জীবন খুব একটা সুখের হয়নি তাঁর। বহুদিন সম্পর্কে ছিলেন এক বিবাহিত মহিলার সঙ্গে। অবশেষে প্রয়াত ফুটবল-প্রশিক্ষক ব্রুনো মেস্তুর বিধবা স্ত্রী-কে বিয়ে করেন তিনি। তাঁর পরিবারের অধিকাংশ সদস্যদের বর্তমান বাস পোল্যান্ডে। দুই সন্তান রয়েছে তাঁর। এদিকে খেলার সূত্রেও বিতর্কের কেন্দ্রে এসেছেন রেনার্ড। অবাধ যৌনতা এবং পরকীয়ায় নাম জড়ায় তাঁর।
খেলোয়াড় হার্ভে
হার্ভে জীবনে বিশেষ কোনও দলের হয়ে খেলার সুযোগ পাননি। কিন্তু সেই তিনিই পরবর্তীকালে তৈরি করেছেন বিশ্বের সেরাদের! এএস ক্যানস, স্টেট-ডি-ভ্যালুরিস এবং এসসি ড্রাগুইনানের মতো ক্লাবের হয়ে খেলেন তিনি। ভালো পারফম্যান্স থাকলেও এর চেয়ে বড় ক্লাবে সুযোগ হয়নি তাঁর। ১৯৮৩ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত খেলার মধ্যে থাকেন তিনি।
'সাফাইকর্মী হার্ভে'
খেলার জগৎ থেকে অবসর নেওয়ার পরে সাফাইকর্মী হিসেবে কাজ শুরু করেন রজার। সকালে পরিষ্কারের কাজ, সন্ধ্যায় অল্প অল্প করে ফুটবল প্রশিক্ষক হিসেবেও কাজ শুরু করেন তিনি। তখন কাজ চলছে তাঁরই প্রাক্তন ক্লাব ড্রাগুইনানে। এরপর নিজেই একটি কোম্পানি খোলেন। যার কাজ ছিল সাফাইয়ের।
আরও পড়ুন: মেসির জারিজুরি শেষ তাঁর সামনে! সৌদির গোলকিপারকে চেনেন?
ফুটবল-প্রশিক্ষক হার্ভে
ড্রাগুইনানের প্রশিক্ষণ আশীর্বাদ হিসেবে দেখা দেয় তাঁর জীবনে। ক্রমেই পরিচিত পেতে শুরু করেন। সাফাইয়ের কাজ থেকে তাঁর পরিবর্তন ঘরে সাফল্য পাওয়ার লড়াইয়ে। এবার তিনি হয়ে ওঠেন ফুটবল দলের কোচ।
১৯৯৯ সাল নাগাদ এসসি ড্রাগুইনানের কোচ হিসেবে কাজ শুরু করেন। ২০০১ নাগাদ ছাড়েন এই চাকরি। ২০০২ নাগাদ সহকারী কোচ হিসেবে যোগ দেন সাংহাই কস্কো ক্লাবে। এরপর কাজ চালান কেমব্রিজ ইউনাইটেডের সঙ্গে। এরপর ভিয়েতনামের সং-দা-নাম-ডিন, ঘানা ন্যাশনাল সাইডের মতো একাধিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করেন তিনি।
জনপ্রিয়তায় হার্ভে
২০০৮
তাঁর কোচিং কেরিয়ার মোড় নেয় অন্য পথে। জাম্বিয়ার জাতীয় ফুটবল দলের কোচ হিসেবে শুরু করেন কাজ। ক্রমশ উন্নত হয় দল। ২০১০ সালে প্রায় ১৪ বছর পর ইতিহাস রচনা করে জাম্বিয়া। আফ্রিকা কাপ অফ্ নেশনের মতো গুরুত্বপূর্ণ সিরিজে কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠে জাম্বিয়া। তাঁর প্রশিক্ষণেই এই অসাধ্যসাধন করে এই দল। এরপর জাম্বিয়া ছেড়ে অ্যাঙ্গোলার ফুটবল দলের ম্যানেজার হলেও বেশিদিন থাকেননি তিনি।
এরপর আবার ক্লাব ফুটবলে ফেরেন তিনি। আলজেরিয়ার ইউএসএম আলজার ক্লাবের প্রধান কোচ হন হার্ভে।
২০১১
ফের জাম্বিয়ায় ফেরেন রেনার্ড। মাত্র ১ বছর পর ২০১২ সালে ইতিহাস সৃষ্টি হয় ফের। জাম্বিয়া আফ্রিকা কাপ অফ্ নেশনের চ্যাম্পিয়ন হয়। বিশ্বের ফুটবল রাজত্বে ফের উঠে আসে এই দলের প্রশিক্ষকের নাম।
২০১৩
এই একই দলের ব্যর্থতার দায় নিয়ে সরে যান তিনি। এরপর সোসাক্স, আইভরি কোস্ট, লিলের সঙ্গেও কাজ করেন হার্ভে।
২০১৬
আবার বিশ্বজয় করার নতুন পথ শুরু করেন এই প্রশিক্ষক। যোগ দেন মরক্কোর জাতীয় ফুটবল দলের প্রশিক্ষক-ম্যানেজার হিসেবে। তাঁর অধীনে চলে কঠিন পরিশ্রম। এক বছর পরে ইতিহাস সৃষ্টি করেন তিনি। দলকে প্রায় দুই দশক পর ফুটবল বিশ্বকাপের যোগ্যতা অর্জন পর্বে জেতান। মরক্কো ২০১৮ এর রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে সুযোগ পায়। এরপর ফের একটি টুর্নামেন্টে মরক্কোর ব্যর্থতার দায় নিয়ে সরে যান দুঁদে এই প্রশিক্ষক।
সৌদি আরবে হার্ভে
২০১৯, জুলাই। বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি হার্ভেকে। তাঁকে নিযুক্ত করা হয় সৌদি আরবের জাতীয় ফুটবল দলের প্রশিক্ষক হিসেবে। একাধিক জয়ে বারবার ইতিহাস গড়তে শুরু করে সৌদি আরব। মধ্য প্রাচ্যের দেশে খেলার আকালে আলোচনায় আসে এই দেশ। ওয়েসদের কঠিন অনুশীলন আর হার্ভের দক্ষ কৌশল এগিয়ে নেয় এই দলকে। বিশ্বকাপের যোগ্যতা অর্জন করে সৌদি আরব। অবশেষে ২২ নভেম্বর, শনিবার। কাতারে বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই বড় প্রতিপক্ষকে হারিয়ে রেকর্ড গড়ল এই দল। ২-১ গোলে মেসিদের ম্যাজিক চুরমার করে দিলেন হার্ভের ছেলেরা। অনেকেই বলছেন এভাবেও ফিরে আসার নেপথ্যের নায়ক আসলে হার্ভে।
নিজের খেলোয়াড় সত্তায় বিরাট ছাপ না রাখতে পারলেও একদা ব্যর্থ এই মানুষটিই হয়ে উঠেছেন মসিহা। একের পর এক দলের সাফল্যে বারবার উঠে এসেছে তাঁর নাম। দলের, দেশের ইতিহাসের সঙ্গেই আলোচিত হয়েছে কোচ হার্ভের কথাও। ক্রমশ প্রকাশ্যে এসেছেন তিনি। ক্লাব ফুটবল ছাড়িয়ে দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রেই উপযোগী হয়েছেন তিনি। এক বিরাট ভূমিকায় নজির স্থাপন করেছেন রেনার্ড। জাম্বিয়া থেকে মরক্কো হয়ে সৌদি আরব। তাঁর চলার পথে তৈরি হয়েছে এক একটি মাইলস্টোন। যেখানে আর্জেন্টিনা, বিশ্বকাপের মঞ্চ আর কাতার উষ্ণতা ছাড়িয়েও তিনিই হয়ে উঠেছেন জয়ের টনিক। আরবীয় ফুটবল সাম্রাজ্যের বাজপাখি। আর খেলোয়াড়দের শিক্ষার সম্রাট।