আত্মঘাতী বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন ছাত্রছাত্রীদের দেহ! কাবুলে এত রক্ত কেন?
Afghanistan Suicide Blast: রাজধানীর পশ্চিম দিকে দস্ত-ই-বারচি এলাকায় অবস্থিত এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে বিস্ফোরণের সময় পরীক্ষা চলছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতিমূলক ওই পরীক্ষায় বসেছিলেন বহু পড়ুয়...
একের পর এক বিস্ফোরণে কেঁপে উঠছে কাবুল। শুক্রবার সকাল সকাল ফের আত্মঘাতী হামলার শিকার তালিবান অধিকৃত কাবুল। অন্তত ২৩ জনের মৃত্যু হয়েছে এই ঘটনায়। আহতের সংখ্যা ৩৫ পেরিয়ে গেছে। তবে আহত ও নিহতদের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলেই মনে করা হচ্ছে। কাবুল পুলিশের মুখপাত্র খালিদ জাদরাগ সংবাদমাধ্যমকে জানান, স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ আত্মঘাতী বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে কাবুলের 'কাজ এডুকেশন সেন্টার'। রাজধানীর পশ্চিম দিকে দস্ত-ই-বারচি এলাকায় অবস্থিত এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে বিস্ফোরণের সময় পরীক্ষা চলছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতিমূলক ওই পরীক্ষায় বসেছিলেন বহু পড়ুয়া। শুক্রবার এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত কোন সংগঠনই হামলার দায়ের স্বীকার করেনি। হামলায় নিহত ও আহতদের বেশিরভাগই অল্পবয়সী।
সোশ্যাল মিডিয়ায় বিস্ফোরণ পরবর্তী যেসব ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে তাতে দেখা গেছে চারিদিকে ছড়িয়ে রয়েছে রক্তাক্ত ছাত্রছাত্রীর মৃতদেহ। আহতদের রক্তাক্ত দেহগুলি উদ্ধারের কাজ চলছে। আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ মন্ত্রকের মুখপাত্র ট্যুইট করে লিখেছেন, "নিরাপত্তারক্ষীরা ঘটনাস্থলে গিয়েছে।হামলার ধরন এবং ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপারে শীঘ্রই জানানো হবে। সাধারণ মানুষের ওপর এই হামলা প্রমাণ করে শত্রুদের নৃশংসতা এবং অমানবিকতা।"
গত বছর আমেরিকান সেনা আফগানিস্তান ছাড়তেই ঘানি সরকারের পতন ঘটে। এরপর থেকেই তালিবান অধিকৃত আফগানিস্তানে হিংসার ঘটনা ক্রমশ বেড়ে চলেছে। শুক্রবার যে এলাকায় বিস্ফোরণ ঘটেছে সেখানে মূলত সংখ্যালঘু হাজারা সম্প্রদায়ের বাস।বহু বছর ধরে তালিবানদের হাতে নির্যাতিত হয়ে আসছে এই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। এমনকী তালিবানের বিরোধী ইসলামিক স্টেটও হামলা চালায় হাজারা সম্প্রদায়ের ওপর। হাজারাদের ধর্ম বিরোধী বলে মনে করে তারা। তালিবান ক্ষমতায় আসার আগে এই দস্ত-ই-বারচি এলাকায় বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছিল। সেই ঘটনায় প্রায় ৮৫ জনের মৃত্যু হয়। আহত হয়েছিলেন ৩০০-এর বেশি মানুষ। প্রায় একবছর পর এই বিস্ফোরণের দায় স্বীকার করে ইসলামিক স্টেট।
আরও পড়ুন-তালিবান শাসনে কেমন আছে আফগানিস্তানের মেয়েরা? জানলে শিউরে উঠতে হবে
গত বছর তালিবান গোষ্ঠী আফগনিস্তানের ক্ষমতা পুনর্দখল করলে হাজারাদের ওপর নির্যাতন ক্রমশ বাড়তে থাকে। এই মুহূর্তে সে দেশে বসবাসকারী হাজারা সম্প্রদায়ের মানুষরা গণহত্যার শিকার হতে পারেন বলে আশঙ্কা করছেন। সাম্প্রতিক সময়ে আফগানিস্তান জুড়ে যেভাবে বিস্ফোরণ, হামলার ঘটনা ঘটেছে তার মধ্যে হাজারা সম্প্রদায়ের মানুষরা সর্বাধিক বিপদসংকুল বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা। হাজারা সংখ্যালঘু মানুষরা শিয়া সম্প্রদায়ের মুসলিম। আফগানিস্তানের অন্যতম বৃহৎ এই সংখ্যালঘু সম্প্রদায় অতীতে পশতুন শাসকদের সময়ে তাঁদের দাসত্ব করেছে। পৈতৃক সম্পত্তি থেকে বহিষ্কার করে গণহত্যায় প্রাণ হারিয়েছে বহু মানুষ। নির্যাতনের এমন দীর্ঘ ইতিহাসের কারণে অনেকেই হাজারাদের পৃথিবীর সর্বাধিক নির্যাতিত মানুষের মধ্যে অন্যতম বলে মনে করেন।
১৯ শতকের শেষের দিকে পশতুন শাসক আব্দুর রহমান খান হাজারা সম্প্রদায়ের বাসস্থান হাজারত এলাকা নিজের দখলে আনার চেষ্টা করেন। ফলস্বরূপ তিনি এই সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে নৃশংস রক্তাক্ত যুদ্ধ শুরু করেন। লুটতরাজ, গণহত্যা, দাসত্ব স্বীকার করে বাধ্য করার পাশাপাশি কেড়ে নেওয়া হয়েছিল তাঁদের জমি বাড়ি। বিশেষজ্ঞদের অনুমান, হাজারা সম্প্রদায়ের ৬০ শতাংশ মানুষ এই হিংসার কারণে মারা যায়। তাই এই ঘটনা গণহত্যার সামিল। পরবর্তী কয়েক দশক ধরে এই সম্প্রদায়ের মানুষ দমন, বৈষম্য এবং আর্থ-সামাজিক নিপীড়নের শিকার হন। এমনকী এঁদের অনেকে রাষ্ট্রীয় পরিচয়পত্র পাওয়ার জন্য তাঁদের পরিচয় গোপন করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত হাজারা জনসংখ্যার একটা বড় অংশ উচ্চশিক্ষা, সেনাবাহিনীতে চাকরি ও সরকারি পদে চাকরি পাওয়া থেকে বঞ্চিত ছিল।
১৯৮৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন তাঁদের সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের পর আফগানিস্তানের বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। ১৯৯৩ সালে হাজারা সশস্ত্র বাহিনী কাবুলের শিয়া অধ্যুষিত এলাকার বেশিরভাগ দখল করে নিলে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বুরহানুদ্দিন রব্বানি উদ্বিগ্ন হয়ে তাঁদের উপর হামলার সিদ্ধান্ত নেন। তীব্র গোলাবর্ষণ এবং হাজারা পুরুষদের বেছে বেছে খুনের কারণে বহু মানুষের মৃত্যু হয়। কেউ কেউ ভয়ে ভিটেমাটি ছেড়ে পালিয়ে বাঁচেন প্রাণে। ১৯৯৬ সালে তালিবান গোষ্ঠীর হাতে ক্ষমতা যাওয়ার পরেও নির্যাতনের ছবি বদলায়নি। বরং হাজারাদের শেষ করে দেওয়াই ছিল তাঁদের প্রধান মন্ত্র।
১৯৯৮ সালে যখন তালিবান গোষ্ঠী সম্পূর্ণ আফগানিস্তান দখলের চেষ্টা করছে তখন হাজারাতের খাবার সরবরাহের পথ বন্ধ করে দেয় তারা। ফলে অভুক্ত অবস্থায় বহু মানুষের দিন কাটতে শুরু করে। ওই বছর অগাস্ট মাসেই তালিবানরা উত্তর আফগানিস্তানের মাজার-ই-শরীফ জায়গাটি দখল করে তাজিক, উজবেক এবং হাজারাদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে। একাধিক মানবাধিকার সংগঠন জানিয়েছিল এই ঘটনায় প্রায় ২০০০ জনের মৃত্যু হয়েছে, যার মধ্যে দেড় হাজার মানুষ হাজারা সম্প্রদায়ের।
আরও পড়ুন- গায়ে জাতীয় দলের জার্সি, মনে চিকিৎসার মন্ত্র, বিশ্বের বিস্ময় আফগান শরণার্থী নাদিয়া নাদিম
আমেরিকান সেনাবাহিনীর সময় হাজারাদের অবস্থা
আমেরিকান সেনাবাহিনী তালিবান গোষ্ঠীকে সরিয়ে আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করলে হাজারাদের অবস্থা ফিরতে শুরু করে। দেশের মানুষদের তাঁদের প্রতি বৈষম্য থাকলেও তাঁরা সামাজিকভাবে মেলামেশার সুযোগ পায়। এমনকী এই সম্প্রদায়ের তরুণরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার সুযোগ পায় এবং সমাজ বদলে এগিয়ে আসেন। মহিলারাও যথেষ্ট স্বাধীনতা ভোগ করেন এই সময়ে। শিক্ষা ক্ষেত্রে সুযোগ হাজারাদের সমস্ত সামাজিক বৈষম্যকে পিছনে ফেলে এগিয়ে আসতে সাহায্য করে। ২০০১ সালে বন কনফারেন্সের মাধ্যমে যখন তালিবান পরবর্তী সরকার গঠন হয় তখন দেশের জনসংখ্যার ১৯ শতাংশ ছিলেন হাজারা সম্প্রদায়ের মানুষ। তবে, ছবি বদলাতে খুব বেশিদিন সময় লাগেনি। ২০০১ সালের পর তালিবান এবং বিভিন্ন সশস্ত্র বাহিনী এই গোষ্ঠীকে আক্রমণ করতে শুরু করে। ২০১৫ সালে উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট আরও মারাত্মকভাবে তাঁদের ওপর হামলা শুরু করে। আত্মঘাতী হামলার মাধ্যমে এই সম্প্রদায়ের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ, এমনকী হাসপাতালেও তাঁদের উপর আক্রমণ করতে শুরু করে ইসলামিক স্টেট।
গত বছর ফের তালিবান গোষ্ঠী আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করলে হাজারাদের দীর্ঘ লড়াইয়ের মাধ্যমে অর্জন করা সামান্য অধিকারটুকু সংকটের মুখে পড়ে। গত বছর সেপ্টেম্বর, অক্টোবর মাসে পশ্চিমী একাধিক সংবাদ মাধ্যম জানিয়েছিল তালিবানরা ক্ষমতা দখলের সময় এই গোষ্ঠীর প্রায় চার হাজার মানুষকে তাঁদের জমি থেকে উচ্ছেদ করে তালিবানরা এবং জানিয়ে দেয় যে এই জমির উপর তাঁদের কোনও অধিকার নেই। ক্ষমতা দখলের পরেও তাঁদের ওপর বারবার হামলা নেমে এসেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে আফগানিস্তানে বিস্ফোরণ
শুক্রবার আফগানিস্তানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হাজারাদের ওপর আত্মঘাতী বিস্ফোরণ তাঁদের অবস্থা যে কতখানি ভয়াবহ, তারই প্রমাণ। তালিবানদের ক্ষমতা দখলের পর দেশজুড়ে হিংসা বেড়েই চলেছে। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে কাবুলে রাশিয়ার দূতাবাসের সামনে বিস্ফোরণ হয়। তালিবান সরকারের তরফে বিস্ফোরণের আগে জঙ্গিকে শনাক্ত করা গেলেও বিস্ফোরণ এড়ানো সম্ভব হয়নি। এই ঘটনায় কেউ নিহত না হলেও তালিবান সরকার গঠনের পর এই প্রথম কোনও দূতাবাসের সামনে বিস্ফোরণ হল। গত মাসে কাবুলের সার-এ-কোটাল মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনায় প্রায় ৬০ জনের মৃত্যু হয়। সাউথ এশিয়ান টেরোরিজম পোর্টালের মতে তালিবানের ক্ষমতায় আসার পর ২০২২ সালে এখনও পর্যন্ত ২০৭ টি বিস্ফোরণ বা হিংসার ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে ৮৩ শতাংশ বিস্ফোরণ এবং অন্ততপক্ষে ৬টি আত্মঘাতী হামলার ঘটনা সামনে এসেছে। কয়েক দিনের ব্যবধানেই সাম্প্রতিক সময়ে বার বার কেঁপে উঠেছে আফগানিস্তান, একথা বিশ্ববাসীর কাছে অজানা নয়। ফলে হাজারাদের মনের শঙ্কা একেবারে অবহেলা করার মতোও নয়।