চুলের মুঠি ধরে চরম শিক্ষা দিয়েছিলেন শিল্পীকে! আজও বিস্ময় সাত’শ বছরের পুরনো বর্ধমানের বড়মা

Boroma Kali at Barddhaman : কথিত আছে, শাঁখারিকে ডেকে বালিকাবেশে শাঁখা পরেছিলেন দেবী, আজও রহস্যে ঘেরা বর্ধমানের বড়মা

পশ্চিমবঙ্গের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জমে রয়েছে কালী মাহাত্ম্য। কেবল নৈহাটি নয়, আরও এক বিখ্যাত বড়মার পুজোর করা হয় বাংলাতেই। বর্ধমান জেলার অন্তর্গত মানকর, এখানেই রয়েছে প্রায় ৭০০ বছরের প্রাচীন বড়মার অস্তিত্ব। কলকাতা নামের সঙ্গে সরাসরি কালীর প্রসঙ্গ জড়িয়ে থাকলেও কলকাতা ছাড়াও পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোতেও রয়েছে অজস্র বিখ্যাত কালী পুজোর ইতিহাস। সেই ইতিহাস শুনলে গায়ে কাঁটা দেয়। দেবীর রুদ্র মূর্তির ব্যাখ্যা মেলে বিভিন্ন প্রকারে। প্রচলিত কালী রূপের ধারণা বারবার ভেঙেচুরে যায় বিভিন্ন জায়গায়। রহস্য আরও ঘনীভূত হয়।

ভক্ত আর ভক্তির জোর যে ঠিক কতখানি, তা অবশ্য নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। তত্ত্ব, যুক্তি, ব্যাখ্যা যেখানে হিসেব মেলাতে পারে না, সেখানে সমস্ত না মেলা হিসেব মিলিয়ে দেয় বিশ্বাসের জোর। তাই কথিত সমস্ত তত্ত্বই সত্যের মর্যাদা পায়। এই পুজোর ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। শোনা যায়, বর্ধমান জেলার মানকরের এই কালী নাকি স্বয়ং রুদ্রমূর্তি। রাতে দেবী মূর্তির চক্ষুদান করা হয়েছিল বলে শিল্পীর চুলের মুঠি ধরে হ্যাঁচকা টান মেরেছিলেন স্বয়ং। সেই থেকেই রাতে মূর্তি তৈরি বন্ধ এখানে।

আরও পড়ুন - দুটো-চারটে নয়, হাজারটা হাত রয়েছে দেবীর! কেন দক্ষিণ ভারতেও এত জনপ্রিয় বাংলার এই কালী?

বর্ধমান জেলার বর্ধিষ্ণু গ্রাম মানকর। এই মন্দিরে দুর্গাপুজোর পর ত্রয়োদশীর দিন দেবী কালীর কাঠামোয় মাটি পড়ে। অতীতের রীতি মেনেই হয় যাবতীয় পুজো। সারা বাংলায় এই জায়গাটির নাম বিখ্যাত হয়ে আছে আরও একটি বিশেষ কারণে, তা হল প্রসিদ্ধ কদমা। শোনা যায়, দেবীর নৈবেদ্যও নাকি সম্পূর্ণ হয় না এই কদমা ছাড়া। এছাড়াও এখানকার পুজোয় মোট আট রকমের ডাল আটটি উনুনে সেদ্ধ হয়। তাঁর সঙ্গে দেওয়া হয় একপোয়া চালের অন্নভোগ। শাক, শুক্ত থেকে শুরু করেগোবিন্দভোগ চালের পায়েস ও পুকুর থেকে তুলে আনা টাটকা মাছ, সবই থাকে পাতে। পুজোর সময় রাতভর চলে নরনারায়ণ সেবা।

আরও একটি বিশেষ মিথ প্রচলিত আছে এই মন্দিরের অতীত নিয়ে। কথিত আছে, বহুকাল আগে একদিন এক শাঁখারি যাচ্ছিলেন এই মন্দিরের পাশ দিয়েই। ঠিক এরকম সময় এক বালিকা, গায়ের রং কালো ছুটে এসে শাঁখা পরতে চেয়েছিল। শাঁখারি দু’হাতে শাঁখা পরাতেই, ওই বালিকা আরও দু’হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। হতভম্ব হয়ে যান শাঁখারি। কিছু না বুঝতে পেতে সেই অতিরিক্ত দুই হাতেও শাঁখা পরিয়ে দেন। এরপর টাকা চাইলে, বালিকাটি জানিয়েছিল, মন্দিরের কুলুঙ্গিতে বেলপাতা ঢাকা দিতে দুটো টাকা রাখা রয়েছে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যিই নাকি মন্দিরের কুলুঙ্গিতে গিয়ে দেখা যায় টাকা রাখা রয়েছে। ব্যাস, বিশ্বাসের জোর প্রবল হয় এতেই।

এই ঘটনাটি যখন ঘটে তার অনেক আগেই মন্দির স্থাপন হয়ে গিয়েছিল। শোনা যায়, আজ থেকে সাতশ বছর আগে এখানে কালীপুজো শুরু করেছিলেন রামানন্দ গোস্বামী। ওই যে বিশ্বাস বিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর। ঠিক যেভাবে মনে করা হতো রামকৃষ্ণ দেব দেবীর দেখা পেতেন ঠিক তেমনই এখনকার ভক্তদেরও দাবি, প্রতিষ্ঠাতা রামানন্দ গোস্বামীও নাকি দেবীর দর্শন পেতেন। সেই সময় যে শ্মশানে তিনি সাধনা করতেন, তা আজ বদলে গিয়ে হয়েছে মানকর ভট্টাচার্য পাড়া। সাধক রামানন্দ গোস্বামীকে নিয়ে আরও একটি কথা শোনা যায়। তাঁর ইচ্ছা ছিল জীবন্ত সমাধিস্থ হওয়ার, সেই মতো ভক্তরা তাঁকে এই পাড়াতেই জীবন্ত সমাধি দিয়েছিলেন। তাঁর অবর্তমানে এই পুজোর দায়িত্ব গ্রহণ করেন মানকরের তৎকালীন জমিদার বাণীকণ্ঠ ভট্টাচার্য।

আরও পড়ুন - শিব নয়, পায়ের নীচে থাকে অসুর, সিংহ! চমকে দেবে ৩০০ বছরের পুরনো বাংলার এই কালীর রহস্য

শাঁখা পরার ঘটনাটি এই বাণীকণ্ঠ ভট্টাচার্যের সময়কার। শাঁখারির টাকা তিনি মিটিয়ে দিয়েছিলেন ঠিকই তবে তবে কোনও মেয়ে ছিল না, ফলে আরও স্পষ্ট বিশ্বাস জন্মাতে শুরু করে এখানকাল কালী মাহাত্ম্য নিয়ে। তিনি পালটা ওই শাঁখারিকে বলেছিলেন, যে মেয়েটি শাঁখা পরেছে, তাঁর কাছে নিয়ে যেতে। শাঁখারি যেখানে বসে শাঁখা পরিয়েছিল, সেখানে নিয়ে গেলেও কোনও বালিকাকে দেখা যায়নি। তখন নাকি পাশের পুকুর থেকে স্বয়ং মা কালী উঠে এসেছিলেন চার হতে নতুন শাঁখা পরা অবস্থায়। শাঁখা পরার প্রমাণ মেলে। আর সেই থেকে ওই শাঁখারি এবং পরবর্তীতে তাঁর বংশধররা এখানে বংশ পরম্পরায় দেবীর পুজোর জন্য শাঁখা দান করে আসছেন। যদিও এই সবই মিথ, অথবা গল্প অথবা অন্য কিছু, কিংবা সবটাই বিশ্বাস, কেবলই বিশ্বাস।

তবে এই বড় মা নামের পিছনেও রয়েছে এক রহস্য। শোনা যায়, সত্যিই নাকি তিন বোন ছিলেন এই কালীরা। বাকি দুজনও থাকেন কাছাকাছিই। মেজ বোন হলেন মানকর ভাঙাপাড়ার ক্ষ্যাপাকালী। আর ছোট বোন পাল পাড়ার পঞ্চানন কালী। বর্তমানে ওই ভট্টাচার্য্য জমিদারদের হাতেই রয়েছে এই মন্দিরের দায়ভার। নতুন প্রজন্মের সুদীপ ভট্টাচার্য্য এবং সুশান্ত ভট্টাচার্য্যের উদ্যোগে নতুন করে মন্দির নির্মাণ করা হয়েছে বলেও জানা গিয়েছে। আজও প্রতি বছর কালী পুজোর রাতে ভক্তের ঢল নামে এখানে। দেবী সেজে ওঠেন অনন্য মহিমায়। শুধু ওই একটা দিন নয় সারা বছরই বিশেষ বিশেষ দিনে এখানে ভিড় দেখা যায়। ইতিহাস আর বর্তমান মিলেমিশে যায় অচিরেই। কেবল প্রাচীনত্বের কাঁধে ভিড় দিয়ে লালিত হতে থাকে ঐতিহ্য এবং পুরাণ। ভক্তের বিশ্বাসেই আরও আরও বিখ্যাত হয়ে ওঠেন বর্ধমানের বড়মা।

More Articles