বোড়ের মাথার দাম সবচেয়ে কম — এক পয়েন্ট, রাজার পাঁচ, মন্ত্রীর চার, নৌকো ও ঘোড়ার যথাক্রমে দুই ও তিন।
ধান পাহারায় সময় কাটাতে মেয়েদের খেলা! চতুরঙ্গ থেকে যেভাবে সৃষ্টি হলো দাবার
History of Chess: সম্মুখ সমরে ব্যবহৃত চতুরঙ্গ সেনা (পদাতিক, অশ্বারোহী, গজানীক এবং রথারোহী) ক্ষুদ্রকায় হয়ে উঠে আসে চতুরঙ্গের চৌষট্টি চৌখুপি জুড়ে যার মধ্যে দিয়ে আসলে প্রকাশ পায় রাজশক্তির গরিমা।
কথায় বলে “তাস দাবা পাশা, তিন কর্মনাশা”। অর্থাৎ এই তিনটি জিনিসে অকারণ সময় নষ্ট হয় এবং সেই কারণে এই তিনে আসক্তি ক্ষতিকারক। আসলে শুধু সময় নষ্ট নয়, এই তিনটিই দ্যূতক্রীড়া হিসেবে স্বীকৃত এবং জনপ্রিয় বহু যুগ ধরে। সুতরাং সময় অপচয়ের সঙ্গে সঙ্গে অর্থ অপচয়ের ব্যাপারটি কিঞ্চিৎ বেশিই গুরুত্বপূর্ণ। তাস যদিও চৈনিক আবিষ্কার, দাবা এবং পাশা, প্রাচীন ভারতে উদ্ভুত— এ তথ্য মোটামুটিভাবে ইতিহাস ও ইতিহাসবিদরা মেনে নিয়েছেন। পাশার কথা ভাবতে গেলে প্রথমেই মনে পড়বে মহাভারতের সভা পর্বের অন্তর্গত দ্যূত অধ্যায়, যেখানে দুর্যোধনের প্রতিভূরূপে মাতুল শকুনি কপটতার আশ্রয় নিয়ে পরাজিত করছেন যুধিষ্ঠিরকে। আসলে দুই ক্ষত্রিয় যুযুধান পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ হলে যে পাণ্ডবদের জয় সুনিশ্চিত তা শকুনি বুঝেছিলেন এবং সেই কারণেই দুর্যোধনের প্রতি তাঁর কপট উপদেশ, “তুমি তলোয়ার দিয়ে যা করতে পারো না, ছলনা দিয়ে করতে পারো। তুমি মূর্খ ক্ষত্রিয়, সর্বদা তরবারির কথা চিন্তা কর, সর্বদা বিষের চিন্তা কর, সর্বদা হত্যার চিন্তা কর।" মাতুলের উপদেশে যুধিষ্ঠিরকে পাশা খেলায় আমন্ত্রণ জানালেন দুর্যোধন। যেহেতু কোনও ক্ষত্রিয়ের দ্যূতক্রীড়ায় আমন্ত্রণে 'না' বলা অধর্ম, যুধিষ্ঠিরকে আসতে হয়েছিল, বসতে হয়েছিল পাশা খেলায়– শকুনি যে কপটতার আশ্রয় নিয়েছেন সে কথা বুঝেও।
পাশা খেলার আরেক অধ্যায় – নল-দময়ন্তীর উপকাহিনি। সেখানে ছলনার খলনায়ক কলি আর দ্বাপর। অশুচি মুহূর্তে নলের শরীরে প্রবেশ করে কলি তাঁকে মানসিকভাবে আচ্ছন্ন করে ফেলে এবং তারপর দময়ন্তীকে না পাওয়ার প্রতিশোধ সে নেয় নলকে সর্বস্বান্ত ও সিংহাসনচ্যুত করে। ভাই পুষ্করের হাতে পাশা খেলায় নলের বারংবার পরাজয় হয়।
সামাজিক ইতিহাসের পাতায় পাশা খেলার উল্লেখ থাকলেও, দাবা খেলার ব্যাপারে তা খানিক নীরব। কিন্তু দাবা যে একবারে দেশজ ক্রীড়া এবং ভারত উপমহাদেশ থেকেই তা কালক্রমে ছড়িয়ে পড়েছে ইরান, আরব পার করে ইওরোপ জুড়ে, এ বিষয়ে সবাই একমত। শুরুটা অবশ্যই মহেঞ্জদরো হরপ্পার সিন্ধু সভ্যতা - অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ – ২০০০, যেখানে পাওয়া গেছে ছোট ছোট মাটির পুতুল বা পাথরের ঘুঁটি যা মাটিতে বা পাথরের সমতলের ওপরে কোনও বোর্ড গেমে ব্যবহৃত হতো। মিশরের 'সেনেত' খেলার সঙ্গে এর ছক খানিক মিলে যায়। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে আর্যদের হিন্দুকুশ পর্বত পেরিয়ে এ দেশে আগমন। এবার বোর্ড গেমে যুক্ত হয় – ছক্কা বা অক্ষ বা dice। কিছু খেলায় হারজিতের স্কোর বা পয়েন্ট নির্ধারিত হয় অক্ষপাতনের নিরিখে। এখানে বোর্ডের প্রয়োজন নেই। আবার যে খেলাগুলো বোর্ড নির্ভর, সেখানে দেখা যাচ্ছে বোর্ডের ওপরে ঘুঁটির গতিমুখ এবং অবস্থান পরিবর্তন নির্ধারিত হচ্ছে (race game) এক বা একাধিক ছক্কায় প্রদর্শিত সংখ্যা বা সংখ্যার যোগফলের মাধ্যমে। সাধারণত ৮ x ৮ অথবা ১০ x ১০ ছকের বোর্ড ব্যবহারের চল ছিল – পতঞ্জলির 'মহাভাষ্য'-এ এদের বর্ণনা করা হয়েছে যথাক্রমে 'অষ্টপদ' ও 'দশপদ' হিসেবে। ছকের সংখ্যার নিরিখে বোর্ড ছোট হোক বা বড় – খেলোয়াড়ের সংখ্যা দুই অথবা চার এবং পুরোটাই ছক্কার চালের উপরে নির্ভরশীল। ১০ x ১০ বোর্ডের খেলা ছিল 'মোক্ষ পাতম', যার পদে পদে ছিল মানব জীবনের পাপ (অবাধ্যতা, অহংকার, অশ্লীলতা, লালসা, রাগ, মিথ্যা) ও পুণ্যের (বিশ্বাস, নির্ভরযোগ্যতা, জ্ঞান উদারতা) সোপান। ছক্কার সংখ্যা মেনে পেরোতে হতো ছক – পুণ্যের ঘরে মই বেয়ে উত্তরণ, পাপের ঘরে সর্প দংশনে অবতরণ। শততম ঘরে পৌঁছে নির্বাণ বা মোক্ষ লাভ। কে পৌঁছবে সেই অভীষ্ট লক্ষ্যে তারই প্রতিযোগিতা। ব্রিটিশ মোড়কে 'মোক্ষ পাতম' উনিশ শতকে হয়ে গেছে 'snakes & ladders'!
আরও পড়ুন- খেলা, মোক্ষলাভ নাকি কর্মফল? সাপ লুডোর যে ইতিহাস চমকে দেবে
দক্ষিণ ভারতের গ্রামে গ্রামে বহুযুগ ধরে চলে আসছে 'থাইয়্যাম' খেলা। ধান পাকার সময় গাঁয়ের মেয়েদের ওপরে ভার পড়ে পাখির হাত থেকে ফসল রক্ষার। সময় কাটানোর জন্য ক্ষেতের ধারে, আলের পাশে কাঠি দিয়ে তারা আঁকে থাইয়্যামের ছক। কখনও কড়ি, কখনও বা তেঁতুলের কালচে বাদামি বীজ দিয়ে বানানো ছক্কা যার তিন দিক পাথরে ঘষে ভেতরের সাদা অংশ দৃশ্যমান। চারজন খেলোয়াড়ের প্রত্যেকের হাতে চারটি করে ছক্কা আর বোর্ডের উপরে চারটি করে ঘুঁটি। থাইয়্যামের বোর্ডের সঙ্গে দাবার আদিরূপ 'চতুরঙ্গ'-র মিল স্পষ্ট। আসলে 'চতুরঙ্গ'-র উদ্ভাবনের পিছনে ছিল সে সময়ের ক্ষত্রিয় শ্রেণির সামাজিক রীতি। রাজ্য জয় এবং শাসনের ভার ক্ষত্রিয়দের। ফলত যুদ্ধ বিগ্রহ এবং সমারঙ্গনের কৌশলে সে পারদর্শী। সুতরাং একজন ক্ষত্রিয়ের পক্ষে দ্যূতক্রীড়ার আমন্ত্রণে 'না' বলা যেমন অধর্ম তেমনই অধর্ম যুদ্ধের আহ্বান অগ্রাহ্য করা! সম্মুখ সমরে ব্যবহৃত চতুরঙ্গ সেনা (পদাতিক, অশ্বারোহী, গজানীক এবং রথারোহী) ক্ষুদ্রকায় হয়ে উঠে আসে চতুরঙ্গের চৌষট্টি চৌখুপি জুড়ে যার মধ্যে দিয়ে আসলে প্রকাশ পায় রাজশক্তির গরিমা।
রথে চড়ে যুদ্ধে নামতেন বীর এবং খোদ রাজ পরিবারের যোদ্ধারা। সুতরাং রাজ শক্তির প্রতিভূ হিসেবে প্রথম পর্যায়ে ক্ষুদ্রকায় রথ হয়ে যায় বোর্ডের সেনানী। দুই ঘোড়ায় টানা দু'চাকার রথ, বা চার ঘোড়ায় টানা চার চাকার রথ, কোনও রথে আবার যোদ্ধার সঙ্গে থাকত সারথি। অক্ষপাতনের সংখ্যা মিলিয়ে অগ্রসর হতো রথবাহিনী। রথের গতিপথে যদি কোনও চৌখোপে আগে থেকে বসে থাকে অন্য একটি রথ, তাহলে যুদ্ধক্ষেত্রের নিয়মেই তার সঙ্গে বাঁধে সংঘর্ষ এবং ক্ষত্রিয় রীতি মেনে সেটি বোর্ড থেকে অপসারিত হয়। জয় হয় বিপক্ষের। আল বিরুনির লেখায় প্রথম পাওয়া যায় চতুরঙ্গের বিশদ বিবরণ যার সঙ্গে আধুনিক দাবার সঙ্গে রয়েছে বেশ কিছু ফারাক। সময়টা ১০৩১, তাঁর ভারত সফরকাল।
চতুরঙ্গ জনপ্রিয় হয় গুপ্ত এবং হর্ষ বংশের শাসনকালে যা মোটামুটি ভাবে খ্রিস্টিয় তৃতীয় থেকে সপ্তম শতাব্দীর মধ্যে বিস্তৃত ছিল। রাজনৈতিক পরম্পরায় দীর্ঘকাল ভারত ছোট ছোট রাজ্য বা প্রদেশে বিভক্ত। শাসন কায়েমের লক্ষ্যে তাদের মধ্যে লেগে থাকত নিরন্তর যুদ্ধ বিগ্রহ। এর ছাপ পড়েছিল চতুরঙ্গের বোর্ডে। অষ্টাপদ বোর্ড ঘিরে চার খেলোয়াড়। চার বৈদ্যাক (বোড়ে), একটি করে রূক (নৌকো) ও ফরাস (ঘোড়া) নিয়ে তৈরি এক একটি বাহিনী। নেতৃত্বে শাহ (রাজা) এবং তার পিল (মন্ত্রী)। খেলা হয় চারমুখো দু'টি ছক্কার চালের হিসেবে। বোড়ের মাথার দাম সবচেয়ে কম — এক পয়েন্ট, রাজার পাঁচ, মন্ত্রীর চার, নৌকো ও ঘোড়ার যথাক্রমে দুই ও তিন। খেলায় বিজয়ী হলে, অর্থাৎ তিন বাহিনীর রাজা পরাজিত হলে পয়েন্ট হতে পারে সর্বাধিক ৫৪।
আরও পড়ুন- নেশার খেলা থেকে স্নায়ুর যুদ্ধ, জীবনকে মাপছে দাবা
উত্তর এবং উত্তর পশ্চিম ভারত থেকে এবার চতুরঙ্গের যাত্রা দক্ষিণের দিকে। 'সাদুরঙ্গম' নাম নিয়ে সে জয় করে দাক্ষিণাত্য এবং সিংহল। দক্ষিণ তামিলনাড়ুর তিরুভারুরের সাদুরাঙ্গা বল্লভনাথের মন্দিরের নথি থেকে জানা যায় যে প্রায় ১৫০০ বছর আগে এই অঞ্চলে খেলাটি খেলা হতো। মহাদেব স্বয়ং এখানে বসে পার্বতীর রূপধারী স্থানীয় রাজার কন্যা রাজরাজেশ্বরীর সঙ্গে একহাত খেলেছিলেন এই খেলা।
আরও এগিয়ে আসা যাক ৫০০ বছর। সময়ের হাত ধরে 'চতুরঙ্গ'-র জায়গায় জনপ্রিয় হয়েছে 'চতুরাজি' অর্থাৎ চার রাজার খেলা। এ বিষয়ে বাংলার কবি রঘুনন্দনের লেখায় পাওয়া যাচ্ছে 'সিংহাসন' কথাটি, যা আসলে বোঝায় এক রাজার অপর রাজাকে পরাজিত করে সিংহাসন লাভ। শুধু সিংহাসন নয়, জয়ী রাজার করায়ত্ব হবে বিজেতার সৈন্য বাহিনীও।
সুতরাং দুই সৈন্যবাহিনীর প্রধান এখন তিনিই। প্রশ্ন হলো, পরাজিত রাজামশাইয়ের কী হলো? এখানেই পাওয়া যায় 'নৃপকৃষ্ট' শব্দটি যার অর্থ বিজেতা রাজা আসলে মৃত নয়, তিনি বন্দি; খেলার নিয়মেই কখনও তিনি ফিরতে পারেন লড়াইয়ের ময়দানে। আর এখানেও এসে পড়ে সমসাময়িক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বা ভাবনার ছাপ। সম্রাট আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের কাল থেকেই একটা দীর্ঘ সময় দেশের বিভিন্ন ছোট প্রদেশ যুদ্ধংদেহি মনোভাব নিয়ে চলত। কিন্তু তার কিছু অলিখিত নিয়ম ছিল, যার মধ্যে অন্যতম, বিজেতা নৃপতিকে হত্যা না করে বশ্যতা স্বীকারান্তে তাঁকে রাজসম্মান দেওয়া। যুদ্ধে পরাস্ত পুরুরাজের সঙ্গে আলেকজান্ডারের কথোপকথন মনে পড়ে? তার অন্তঃস্থলেও তো এক পরাভূত নৃপতিকে সম্মান জ্ঞাপনের বার্তা। সুতরাং, রাজা বন্দি হলে খেলা শেষ হয় 'শাহ মাত' বা 'চেকমেট' কিংবা 'কিস্তিমাত' বলে অর্থাৎ রাজা মৃত নন, তিনি বন্দি। দ্বিতীয়ত, বহু প্রদেশে বিভক্ত রাজ্যগুলোকে একত্রীকরণের ভাবনা বা লক্ষ্য বা নীতি বরাবরই দেখা যেত প্রাদেশিক রাজাদের মধ্যে। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দী থেকে খ্রিস্টাব্দ ষষ্ঠ শতাব্দী — যে সময়ে এই ফলক ক্রীড়া উদ্ভাবন হয়েছে — মৌর্য্য, গুপ্ত এবং পুষ্যভূতি সাম্রাজ্যের সৃষ্টি এভাবেই। অর্থাৎ, দ্বিধাবিভক্ত রাষ্ট্র ক্রমশ অগ্রসর হচ্ছে একীকরণের দিকে। চতুরাজির ফলকে তার সম্ভাব্য প্রভাব খেলোয়াড়ের সংখ্যা হ্রাসে — চার থেকে দুইয়ে।
আরও পড়ুন- চৌষট্টির খোপে বিদ্রোহী! নজরুলের দাবাপ্রেম রয়ে গেছে অগোচরেই
কিন্তু একটি প্রশ্নের উত্তর খোঁজা এখনও রয়ে গেছে বাকি। অক্ষচালনা থেকে কবে মুক্তি পেল চতুরাজির বোর্ড? কবে, কীভাবে সে হয়ে উঠল মানসিক চিন্তা দ্বারা চালিত সমর কৌশলের ক্রীড়া?
এর সম্ভাব্য উত্তর খুঁজেছেন রুশ গ্র্যান্ড মাস্টার ইউরি লভোভিচ আভারবাখ তাঁর 'আ হিস্ট্রি অফ চেস: ফ্রম চতুরঙ্গ টু প্রেসেন্ট ডে' বইয়ে। কৌটিল্যর 'অর্থশাস্ত্র' অনুসারে দ্যূতক্রীড়া নিষিদ্ধ নয়, কিন্তু সে খেলায় প্রতারণা বা কপটতার চেষ্টা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। পরবর্তীকালে মনুসংহিতায় পাওয়া যাচ্ছে ঠিক উল্টো ছবি — বন্ধ করা হোক দ্যূতক্রীড়া — যারা খেলায় অংশ নেয় বা যারা পৃষ্ঠপোষক, শাসক যেন দুইয়েরই শাস্তি বিধান করেন। ছক্কার সাহায্যে যে খেলা হয় তাই হলো জুয়া — এটাই ছিল সাধারণের বিশ্বাস । অতএব বেরলো আইনের ফাঁক! সরে গেল ছক্কার ব্যবহার। তবে খেলা এগোবে কীভাবে? এখানেই হয়তো দিকনির্দেশ পাওয়া যায় অন্য এক বৈদেশিক প্রভাবের।
ভারতীয় দর্শনের বিভিন্ন শাখায় কর্মতত্ত্ববাদের প্রভাব তাৎপর্যপূর্ণ। ব্যক্তিজীবন নির্দেশিত ও চালিত হয় কর্মফলের দ্বারা- এই ছিল বিশ্বাস। সৎ অভিপ্রায় এবং সুকর্ম, ভবিষ্যৎ এবং পুনর্জন্মেও তার অবদান রাখে। ফলত, ব্যক্তির সাফল্য বা অসাফল্য আদপে তার কর্মফলের উপরে নির্ভরশীল — মনোগত ইচ্ছাশক্তির উপরে নয়। অক্ষপাতনের মাধ্যমে চতুরঙ্গের মতো ফলক ক্রীড়ার হারজিত নির্ণয় একাধারে এই কর্মতত্ত্বের দর্শনকেই সমর্থন করে। অতএব সেই কাঠামোকে ভেঙে, সম্পূর্ণ স্বাধীন চিন্তার মাধ্যমে নিজের ভাগ্যকে নির্ধারণ করবার বিষয়টি একদিক থেকে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন বলা যায়। সেক্ষেত্রে, চতুরঙ্গের উপরে গ্রিক সভ্যতার প্রভাবের তত্ত্ব, যা ইউরি তাঁর বইতে লিখেছেন, তা খুব একটা অপ্রাসঙ্গিক নয় বলেই মনে হয়।
খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে আলেকজান্ডারের হিন্দুকুশ পেরিয়ে ভারত উপমহাদেশে প্রবেশের সঙ্গে উত্তর পশ্চিম অঞ্চল জুড়ে গ্রিক আর দেশজ সংস্কৃতির মিশেল তার সাক্ষ্য রেখেছে স্থাপত্য ও শিল্পকলায়। বহিঃবাণিজ্যের যাত্রাপথ তৈরি হয়েছে ভূমধ্যসাগর ঘেরা গ্রিস থেকে কৃষ্ণসাগর পেরিয়ে পারস্যের ব্যাকট্রিয়া অঞ্চল হয়ে গান্ধার প্রদেশ অবধি। সুতরাং দার্শনিক প্লেটো কুবিয়া (kubeia) এবং পেটিয়া (petteia) – যে খেলা দু'টির কথা লিখেছেন তাও একদিন হয়ত দেশান্তরি হয়ে এসেছিল ভারতে। এর মধ্যে পেটিয়া ছিল সম্পূর্ণভাবে মানসিক চিন্তা দ্বারা চালিত খেলা – যেখানে সমরাঙ্গনের কৌশলগত দিকটি ছিল খেলোয়াড়ের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের পরিণাম – অক্ষপাতনের কোনও ভূমিকা ছিল না। আর এখানেই জয়ী গ্রিসের যুক্তিবাদ! কিন্তু কীভাবে, কোথায় এবং কখন দু'টি খেলা, অষ্টপদ এবং পেটিয়া মিলে গিয়ে দাবা খেলার বিকাশ ঘটিয়েছে, দুর্ভাগ্যবশত, আমাদের কাছে তার কোনও প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই। কিন্তু এটুকু অনুমান করা যেতে পারে, তা খ্রিস্টপূর্ব কালেই শুরু হয়েছিল মিলনের প্রক্রিয়া এবং সময়ের অগ্রগতির মাঝে এই সহাবস্থান আমাদের দিয়েছে বত্রিশ ঘুঁটি, চৌষট্টি ছকের এই লড়াইয়ের ময়দান যার হারজিতের রসদ মগজাস্ত্র ছাড়া আর কিছুই নয়!