আজও বিস্ময়! ব্রিটিশদের থেকে আত্মগোপন করতে এই রাজবাড়িতে ছিলেন নজরুল
ঠাঁটবাট নেই, রাজ্যপাট নেই, জীর্ণ রাজবাড়ি, তবু এখনও ইতিহাস কথা বলে রাজবাড়ির ছাদ, খিলান, কড়ি-বরগায়।
ফিসফিস কানাকানি
কথা বলে ইতিহাস
খিলানের দরজায়
করে যেন হাঁসফাঁস
ঘটনার ঘনঘটা
চারিদিকে ছড়িয়ে,
কতো প্রেম কাহিনী
নেবো আজ কুড়িয়ে।
হেতমপুর, পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার, সিউড়ি মহকুমার অন্তর্গত একটি সুবৃহৎ গ্রাম। এটি দুবরাজপুরের নিকট অবস্থিত। এখানকার রাজবাড়িটিতে ৯৯৯টি দরজা থাকার জন্য এটি 'হেতমপুর হাজারদুয়ারি' নামে খ্যাত।
হেতমপুরের পূর্ব নাম ছিল 'রাঘবপুর'। হেতমপুর রাজবাড়ির ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে রাজনগরের ইতিহাস। এখানকার রাজবাড়ির সুউচ্চ পিলার শোনায় ভাগ্যবদলের কাহিনি। রাজা রাঘব রায়ের আমলে তাঁর নামানুসারে এই অঞ্চলের নাম হয় রাঘবপুর। রাজনগর মূলত ছিল মুসলিম-অধ্যুষিত এলাকা। রাজনগরের রাজা আসাদুল্লাহ খানের মৃত্যুতে তাঁর পুত্র বাদিউজ্জামান খান সিংহাসনে বসেন। তাঁর রাজত্বকালে তহশিলদারদের সঙ্গে প্রবল বিরোধ বাধে রাজস্ব এবং কর আদায়কে কেন্দ্র করে। পরিস্থিতি সামাল দিতে রাজনগরের সেনাপতি হেতম খানকে পাঠানো হয় রাঘবপুরে। অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে রাঘব রায়কে পরাজিত করে বিদ্রোহ দমন করেন হেতম খান। তখন বাদিউজ্জামান খুশি হয়ে 'রাঘবপুর' হেতম খানকে উপহারস্বরূপ প্রদান করেন। সেই সময় থেকে 'রাঘবপুর-এর নাম বদল হয়ে 'হেতমপুর' নাম হয়।হাতেম খান মারা যান ১৭৫৫ সালে।
আরও পড়ুন: ১০৮টি মন্দিরে অবস্থান করতেন শিব, এই জমিদারিতে রয়েছে অজস্র কিংবদন্তি
রাঘব রায়ের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র রাজনগরের রাজার নায়েব নিযুক্ত হন। এক সময়ের রাজার পুত্র ভাগ্যদোষে গোমস্তার পদাধিকারী হন। এরপর থেকে রায় পরিবারের প্রত্যেকে বংশানুক্রমিকভাবে গোমস্তা ও ইজারাদার হিসেবে নিযুক্ত হতে থাকেন। এই সময় মুরলীধর চক্রবর্তী নামে এক ব্যক্তি বাঁকুড়া থেকে আসেন কাজের খোঁজে। তিনি বাদিউজ্জামান-এর পরিবারের ভৃত্য হিসেবে নিযুক্ত হন। তাঁর উত্তরসূরি চৈতন্য চক্রবর্তী ছিলেন সুগায়ক। বাদিউজ্জামানের উত্তরসূরি হাফেজ খান তাঁর অসাধারণ গান শুনে মুগ্ধ হয়ে, তাঁকে হেতমপুর দুর্গের দেখাশোনার দায়িত্ব দেন।এই চৈতন্য চক্রবর্তীর পুত্র রাধানাথ চক্রবর্তী ছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ ও দূরদর্শী। তাঁর বুদ্ধিমত্তার ফলেই এক সময়ের 'ভৃত্য' পরিবার হেতমপুর রাজপরিবারে প্রতিষ্ঠা পায়। ১৭৮১ সাল থেকে ১৭৯১ সালের মধ্যেই তিনি ১৯-টি মৌজা অধিগ্রহণ করেন। ইতিহাস বলে, তিনি মুর্শিদাবাদের তৎকালীন নবাবের কাছ থেকেও কিছু মহল এবং জমিদারি কেনেন। তিনি তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের অধীনতা স্বীকার করে নেন, তার ফলে ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে 'মহারাজা' খেতাব লাভ করেন। ১৮৩৮ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। সেই সময় তাঁর সম্পত্তির পরিমাণ ছিল সমকালীন ২ লক্ষ টাকার কাছাকাছি।
এই বংশের আরেক প্রভাবশালী রাজা ছিলেন রামরঞ্জন চক্রবর্তী। ১৮৭৪ সালে দুর্ভিক্ষের সময় তিনি ব্রিটিশ সরকারকে নানাভাবে সাহায্য করেছিলেন, তার ফলে ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে তিনি 'রাজাবাহাদুর' উপাধি লাভ করেন। এই খেতাব ১৮৭৫ সালে গভর্নর জেনারেল লর্ড লিটন তাঁকে দিয়েছিলেন। লর্ড নর্থ ব্রুক তাঁকে 'রাজা' উপাধি দেন। এরপর ১৯২২ সালে 'মহারাজা' উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন তিনি। তাঁরই আমলে রাজবাড়ির একটি বিশাল অংশ তৈরি হয়েছিল। সেটি 'রঞ্জন প্যালেস' নামে পরিচিত। এরপর ১৯০৫ সালে নতুন রাজবাড়ির নির্মাণকাজ শেষ হয়। হেতমপুর রাজবাড়ির নকশায় রয়েছে ইন্দো-ইউরোপীয় স্থাপত্যের ছাপ। ইউরোপীয় ধাঁচের প্রকাণ্ড দরজা মুগ্ধ করে, অনন্য রুচিশীলতার পরিচয় দেয়। রাজবাড়িটির গঠনশৈলি সত্যিই মনোমুগ্ধকর। রাজবাড়িটির ডানদিক এবং বাঁদিক, দু'দিক-ই একইরকম দেখতে, অনেকটা যেন যমজ ভাইয়ের মতো। অনেকে তাই একে 'টুইন প্যালেস' বলেন। রাজবাড়িটির সামনে আছে বিশাল পিলার, যা রীতিমতো অবাক করে। গঠনের দিক দিয়ে মুর্শিদাবাদের হাজারদুয়ারির সঙ্গে অদ্ভুত মিল আছে এই হেতমপুরের রাজবাড়ির। এই রাজবাড়িতে আছে ৯৯৯টি সেগুন কাঠের তৈরি দরজা। মুর্শিদাবাদের হাজারদুয়ারির সম্মানার্থে এখানে একটি দরজা কম বানানো হয়েছিল। তবু হেতমপুর রাজবাড়িকে 'হেতমপুর হাজারদুয়ারি' বলা হয়ে থাকে।
হেতমপুর রাজবাড়ির সুনাম ছিল দাতা হিসেবে। 'বীরভূম রাজবংশ' বইটি ১৩১৬ বঙ্গাব্দে হেতমপুর রাজবাড়ীর মহিমারঞ্জন চক্রবর্তীর লেখা। হেতমপুর রাজবাড়ি নিয়ে এটি প্রথম লিখিত ইতিহাস। জনশ্রুতি শোনা যায়, বীরভূমে প্রাচীন হিন্দু রাজ্য ছিল এবং তাঁরা ছিলেন পরাক্রমী এবং বীর। সাঁওতাল বিদ্রোহে এঁরা সাঁওতালদের পরাজিত করেছিলেন, এমনকী, বর্গী ও মারাঠা আক্রমণেরও মোকাবিলা করেছিলেন। এই রাজপরিবারের আরও একটি বিশেষ দিক হলো, এঁদের দান কর্ম। দাতা হিসেবে এঁদের ছিল খুব সুনাম। রামরঞ্জন চক্রবর্তী এই অঞ্চলে স্কুল-কলেজ-লাইব্রেরি, দাতব্য চিকিৎসালয় গড়ে দিয়েছিলেন, গরিব মানুষের সেবা করার নিমিত্তে। দুর্ভিক্ষের সময় প্রজাদের অকাতরে দান করেছিলেন। এছাড়া এই পরিবারের মহিমারঞ্জন চক্রবর্তীর উদ্যোগে বীরভূমে সংস্কৃতির প্রভূত বিকাশ ঘটেছিল।
রাজবাড়িটির আনাচকানাচে যেন ইতিহাস কথা বলে চলেছে। শোনা যায়, পুজোর সময় নাকি রাজবাড়ির সামনে বিশাল মেলা বসত। তখনকার দিনের বিখ্যাত 'নট্টকোম্পানি' যাত্রাপালার আয়োজন করা হতো। এখনও যেন মনে হয়, এই বাড়ির জৌলুস আর আভিজাত্য এতটুকুও মলিন হয়নি, মনে হয় যেন নাচ-গানের আসরে, আতরের গন্ধে এবং রঙিন আলোয় চারিদিক ভরে উঠেছে। রাজবাড়ির কিছু দূরেই চন্দ্রনাথ শিবের মন্দির। ১৮৪৭ সালে এটি তৈরি করান মহারাজের রামরঞ্জন চক্রবর্তী বাহাদুরের পিতা মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র চক্রবর্তী।
(The University of Calcutta, The Calendar,1928, 27th of June, page-484), (Padma Sundari Devi, wife of Maharaja RamRanjan Chakroborti).
কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নথি থেকে জানা যায়, ১৮৯৭ সালে, ২৭ জুন মহারাজা রামরঞ্জন চক্রবর্তীর পত্নী পদ্মাসুন্দরী দেবী হেতমপুরের কৃষ্ণচন্দ্র কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি কিছু সম্পত্তিও কলেজকে প্রদান করেছিলেন, যার থেকে কলেজের বার্ষিক উপার্জন হতো তৎকালীন ৬১০০ টাকা।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে হেতমপুর রাজবাড়ির যথেষ্ট অবদান রয়েছে। ব্রিটিশদের নজর এড়াতে এই রাজবাড়িটিতেই আশ্রয় নিয়েছিলেন বিদ্রোহী কবি কাজি নজরুল ইসলাম এবং চারণকবি মুকুন্দ দাস। এই রাজবাড়ির দোতলার একটি ঘরে তাঁরা আশ্রয় নিয়েছিলেন। যদিও শেষরক্ষা হয়নি, ব্রিটিশের হাতে তাঁরা ধরা পড়েছিলেন। জেলে বসে নজরুলের লেখনী-তে এই রাজবাড়ির উল্লেখ আছে। বহু স্বাধীনতা সংগ্রামীর গোপন আস্তানা ছিল এই হেতমপুর রাজবাড়ি। এই রাজবাড়িতে বসেই বহু ব্রিটিশ অফিসারকে হত্যার নকশা পরিকল্পিত হয়েছিল। জনশ্রুতি আছে, ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই রাজবাড়িতে তৎকালীন রাজা বিশ্বরঞ্জন চক্রবর্তী বীরভূম জেলায় প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেছিলেন।
ঠাঁটবাট নেই, রাজ্যপাট নেই, জীর্ণ রাজবাড়ি, তবু এখনও ইতিহাস কথা বলে রাজবাড়ির ছাদ, খিলান, কড়ি-বরগায়। কত স্মৃতি, কত ঘটনা, কত ষড়যন্ত্র, কত আচার-অনুষ্ঠানের সাক্ষী এই রাজবাড়ি। সাতের দশকের পর থেকেই ক্রমশ ভেঙে পরে রাজবাড়ির অবস্থা। বর্তমানে কিছুই অবশিষ্ট না থাকলেও আভিজাত্য রয়েই গেছে।