মাত্র ৯ সেকেন্ড! তাসের ঘরের মতো ভেঙে যাবে নয়ডার টুইন টাওয়ার, তাকিয়ে গোটা দেশ

Noida Twin Tower demolition: রবিবার সেই মাহেন্দ্রক্ষণ – রিমোটের এক ক্লিক আর তাতেই লুটিয়ে পড়বে গগনচুম্বী টাওয়ার। এ যেন হাই ভোল্টেজ ম্যাচ! এতই উত্তেজনা!

রবিবার ঠিক দুপুর আড়াইটে। সবে লাঞ্চ সেরে রাবিবাসরীয় দিবানিদ্রার প্রস্তুতি। না, এদিন দুপুরটা কাটবে অন্যভাবে। একরাশ কৌতূহল নিয়ে জোড়া জোড়া চোখ নিবিষ্ট হবে টিভির পর্দায়। রিমোটে আঙুলের আলতো চাপ। একটা বিস্ফোরণ। চোখের নিমেষে ধূলোয় মিশে গেল ১০০ মিটারের বেশি লম্বা টুইন টাওয়ার। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে নয়ডায় এভাবেই ভেঙে ফেলা হবে বেআইনিভাবে তৈরি ৪০ তলা বিশিষ্ট যমজ বহুতল। একদিকে এশিয়া কাপের ভারত-পাক ম্যাচ এবং অন্যদিকে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মোহন-ইস্ট ডার্বি। এই দু’য়ের পাশাপাশি নয়ডার টুইন টাওয়ার ভাঙা নিয়ে ভারত-পাক ম্যাচের মতোই উত্তেজনা। কোনও অঘটন এড়াতে আগাম প্রস্তুতি সারা হয়ে গেছে। অ্যাম্বুলেন্স, হাসপাতাল তৈরি।

মাত্র ৯ সেকেন্ড। নয়ডায় ৪০ তলার গগনচুম্বী টুইন টাওয়ার গুঁড়িয়ে দিতে এই সময়টুকু যথেষ্ট। রবিবার অর্থাৎ ২৮ অগাস্ট, দুপুর আড়াইয়ের সময় রাজধানীর উপকণ্ঠে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়বে যমজ বহুতল। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ `সুপারটেক’ টুইন টাওয়ার ভেঙে ফেলা হচ্ছে। উচ্চতা ১০০ মিটার। এই যমজ টাওয়ার কুতুব মিনারের চেয়েও লম্বা। বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক ব্যবহার করে এই দুই বহুতল ভাঙা হবে বলে জানা গেছে। নয়ডার সেক্টর ৯৩ তে সব প্রস্তুতি সারা।

মুম্বই এবং দক্ষিণ আফ্রিকার দু’টি সংস্থা যৌথভাবে ওই টাওয়ার দু’টি ভেঙে ফেলার কাজ করবে। এই দু’টি বহুতল মিলিয়ে মোট ৯০০ টি ফ্ল্যাট ছিল। মোট সাড়ে লক্ষ স্কোয়ার ফিট এলাকা জুড়ে রয়েছে এই টুইন টাওয়ার। টাওয়ার সংলগ্ন এলাকায় বাস প্রায় পাঁচ হাজার পরিবারের। নির্দিষ্ট দিনে তাঁদের সকাল ৭টার মধ্যে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। বিকেল ৪টের পর তাঁদের আবার ফিরিয়ে আনা হবে।

বেশ কিছু বাসিন্দা অন্যত্র চলে গিয়েছেন এবং অনেকে তাঁদের মূল্যবান জিনিসপত্র, বিশেষ করে বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি, বিস্ফোরণের আফটারশক থেকে ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে গুছিয়ে নিচ্ছেন বলে জানা যাচ্ছে। এলাকার বেশিরভাগ বাসিন্দারা এই বিষয়ে নিয়ে ভীত নন, তবে তাদের জানালার কাঁচের ক্ষতি হতে পারে এবং বাড়িতে ব্যাপক ধুলোর ঢুকতে পারে। সেই সম্পর্কে তারা বেশ কিছুটা শঙ্কার মধ্যে রয়েছেন বলে জানা গিয়েছে। এমারল্ড কোর্ট এবং এটিএস সোসাইটির বাসিন্দাদের ধ্বংসকারী সংস্থা, এডিফিস দ্বারা বিস্ফোরণের কারণে কাঠামোগত ক্ষতির জন্য ক্ষতিপূরণের আশ্বাস দিয়েছে বলে জানা গিয়েছে।

কীভাবে ভাঙা হবে বহুতল

টুইন টাওার ভাঙতে ৩৭০০ কেজি বিস্ফোরক ব্যবহার করা হবে। জানা গিয়েছে, নিয়ন্ত্রিত একটা বিস্ফোরণের মাধ্যমে গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে যমজ বহুতল। অর্থাৎ এক্ষেত্রে একাধিক বিস্ফোরণ ঘটানো হবে না। ৩ হাজার ৭০০ কেজির বেশি বিস্ফোরক পদার্থ এতে ব্যবহৃত হবে। ডিটোনেটর শক, টিউবের মতো বিস্ফোরক প্রবল শব্দ করে ফাটবে পরপর। সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে সময় লাগবে ৯ থেকে ১০ সেকেন্ড। ৫৫ হাজার টন ধ্বংসাবশেষ তৈরি হবে এর থেকে। তার মধ্যে কিছুটা নিয়ে যাওয়ার হবে নিকবর্তী ফাঁকা জায়গায়। বাকিটা রাখা হবে টুইন টাওয়ারের নিচের একটা গর্তে। অবৈধ নির্মাণের অভিযোগে নয়ডার এই টুইন টাওয়ার ভেঙে ফেলার নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। কাছেই একটি হাসপাতালে রবিবারের জন্য ইতিমধ্যে ৫০ টি বেড বুক করে রাখা হয়েছে। যদি এই ধ্বংসকার্যের পর কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েন, তাই এই ব্যবস্থা।

কার হাতে রিমোট

রিমোটে আলতো চাপ। আর তাতেই গুঁড়িয়ে যাবে যমজ আট্টালিকা। বেআইনি ভাবে তৈরি নয়ডার সুপারটেক টুইন টাওয়ার ভেঙে ফেলার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এডিফিস ইঞ্জিনিয়ারিং (Edifice Engineering) নামে এক সংস্থাকে। ওই সংস্থা সূত্রে খবর, রবিবার বিস্ফোরণের মাধ্যমে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া দু’টি টাওয়ার। আর সেই মাহেন্দ্রক্ষণে বিস্ফোরণের রিমোট থাকবে চেতান দত্তর হাতে। ৪৯ বছরের চেতন হরিয়ানার হিসারের বাসিন্দা। “মনে হচ্ছে স্বপ্ন যেন সত্যি হল।” বিষয়টি জানার পর সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া প্রথম প্রতিক্রিয়ায় বলেন ওই ব্যক্তি। ঠিক কী বলেছেন তিনি? চেতনের কথায়, “নয়ডায় টুইন টাওয়ার ভেঙে ফেলা সংক্রান্ত সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ একজন WhatsApp-এ পাঠিয়েছিল। তখন থেকেই ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছি, আমাকে যেন বিল্ডিং ভাঙার দায়িত্ব দেওয়া হয়। গত জুলাইতে এই কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা এডিফিস ইঞ্জিনিয়ারিং –এর তরফে আমাকে এর জন্য অনুরোধ করা হয়।” প্রসঙ্গত, গত ২০০২ থেকে এই ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন তিনি। চেতনের নিজের একটি সংস্থা রয়েছে। ওই সংস্থাই বাড়ি ভাঙার কাজ করে। “গত ১০ দিন ধরে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ওই টুইন টাওয়ারে বিস্ফোরক বিছানো হয়েছে। আমরা তৈরি।” সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন চেতন।

কেন ভাঙা হচ্ছে

নিয়ম মেনে তৈরি হয়নি নয়ডার বহুতল। আবাসন আইন লঙ্ঘন করা হয়েছে। তাই সুপ্রিম কোর্ট বহু কোটি টাকার এই টাওয়ার ভাঙার নির্দেশ দেয়। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ভাঙা পড়তে চলেছে নয়ডার কোটি টাকার টুইন আবাসন। নয়ডার এমারেল্ড কোর্ট প্রজেক্ট এলাকায় এই বহুতল সুপারটেক বিল্ডিং নামে পরিচিত। বহুতল নির্মাণ আইন লঙ্ঘনের জেরে আগামি তিন মাসের মধ্যে এই নির্মীয়মাণ বহুতল ভাঙতে নির্দেশ দিয়েছে শীর্ষ আদালত। (সুপ্রিম কোর্ট গত বছর এই রায় দেয়)। পাশাপাশি ১২% সুদ-সহ গোটা টাকা সেই বহুতলে ফ্ল্যাট বুকিং করা গ্রাহকদের ফেরত দিতে নির্দেশ দেন বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়। বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ বলেছিল, ‘নয়ডা কতৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে আগামি ৩ মাসের মধ্যে এই ভাঙার কাজ শুরু করতে হবে। তাদের পরামর্শদাতা হিসেবে থাকবে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি। গোটা প্রক্রিয়ার খরচ বহন করবে সুপারটেক সংস্থা।‘

সুপ্রিম কোর্টের মন্তব্য, ‘নয়ডা কতৃপক্ষের সঙ্গে যোগসাজশ করে সুপারটেক সংস্থা এই বহুতল নির্মাণ করছে। ৪০ তলার এই বহুতলে ৯১৫টি ফ্ল্যাট এবং দোকানঘর থাকবে। কিন্তু অবৈধ এই নির্মাণ নিয়ে এলাহাবাদ হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণ সঠিক। তাই হাইকোর্টের বহুতল ভাঙার রায়কেই কার্যকর রাখল সুপ্রিম কোর্ট।‘

চলতি বছরেই এই নির্মাণের বিরোধিতা করে একাধিক মামলা দায়ের হয়েছে। সেই মামলাগুলোর মধ্যে অন্যতম অভিযোগ, ‘বিল্ডিং প্ল্যান গ্রাহকদের হাতে তুলে না দেওয়া।‘ বারবার প্ল্যান চাইলেও গড়িমসি করে সেই আবেদন খারিজ করেছে সুপারটেক কতৃপক্ষ। পাশাপাশি নানাভাবে পরিবেশ এবং আবাসন আইন লঙ্ঘনের অভিযোগেও মামলা দায়ের হয়েছে হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্টে।

যে অট্টালিকার গায়ে অবৈধ তকমা, যে অট্টালিকা আবাসন আইন মানেনি, সেই অট্টালিকা নয়ডার বুকে মাথা তুলে আকাশ স্পর্শ করলেও, তাকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিতে কসুর করেনি সুপ্রিম কোর্ট। রবিবার সেই মাহেন্দ্রক্ষণ – রিমোটের এক ক্লিক আর তাতেই লুটিয়ে পড়বে গগনচুম্বী টাওয়ার। এ যেন হাই ভোল্টেজ ম্যাচ! এতই উত্তেজনা!

More Articles