খেলার সুযোগটুকুও জুটত না! যেভাবে দাবার ইতিহাসের বাঁক বদলালেন ডিং লিরেন...
Ding Liren World Chess Champion: চিনের ডিং কিন্তু বেশ ঠান্ডা মেজাজের, শান্ত স্বভাবের মানুষ। দাবার কঠিন চাল ছাড়া, তাঁর মাথায় আর কিছুই চলে না।
"এরকম কোনও বিশেষ ঝলমলে মুহূর্তেই খুঁজে পাওয়া যায় জীবনের আসল মানে।"
২০১৯ সালে এমনই একটি কথা বলেছিলেন ডিং লিরেন। আর আজ হয়তো নতুনভাবে সেই কথাই অনুভব করতে পারছেন তিনি। ম্যাগনাস কার্লসেন ইচ্ছে করেই হয়তো সিংহাসন ছেড়ে দিয়েছিলেন। তাই আগে থেকেই জানা ছিল, নতুন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন পেতে চলেছে দাবা। ফেভারিট হিসেবে ছিলেন ইয়ান নেপোমনিয়াছি। গতবার ম্যাগনাসের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন তিনি। সবাই মনে করেছিলেন, হয়তো এইবার রাশিয়ার মাথায় উঠবে সেরার শিরোপা। কিন্তু এবারও মুকুট পেলেন না এই রুশ গ্র্যান্ডমাস্টার। তাঁকে হারিয়ে নতুন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হলেন চিনের গ্র্যান্ড মাস্টার ডিং লিরেন, অবসান ঘটল কার্লসেন যুগের।
দাবাকে সব সময়ই কঠিন বুদ্ধির খেলা বলা হয়ে থাকে। রাজা, মন্ত্রী এবং হাতি নিয়ে স্নায়ুর যুদ্ধ চলে মুখোমুখি দু'জনের মধ্যে। একজন দাবাড়ু তাঁর জীবনের সেরা খেলাটা খেলতে সব সময়ই মুখিয়ে থাকেন। তাই গত ক'দিন ধরে এই পুরুষ বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে চোখ রাখছিলেন বিশ্বের দাবা প্রেমীরা। অবশেষে অপেক্ষা শেষ। ৩০ এপ্রিল কাজাকস্তানে অনুষ্ঠিত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সেরার শিরোপা জিতে নিলেন চিনের ডিং লিরেন।
কাজাকস্তানের রাজধানী আস্তানাতে অনুষ্ঠিত এই চ্যাম্পিয়নশিপ নিয়ে নাটকীয়তার কমতি ছিল না। প্রথম থেকেই এই টুর্নামেন্ট ছিল হাড্ডাহাড্ডি। প্রথম পর্যায়ের ১৪টি ক্লাসিক্যাল ম্যাচ শেষে দু'জনেরই পয়েন্ট ছিল ৭ করে। দু'জনেই ছিলেন এক্কেবারে সমান জায়গায়। কেউ কারও থেকে এগিয়ে না, কেউ কারও থেকে পিছিয়েও না। তাই প্রয়োজন হয় টাইব্রেকারের। আর এখানেই বাজিমাত করে দেন ডিং। টাইব্রেকার চেজ করে প্রথম তিন ম্যাচ ড্র হওয়ার পরে, শেষ ম্যাচে কালো ঘুঁটি নিয়ে শুরু করেন ডিং। সেই সময় একে অপরকে বাজিমাত করার জন্য বাকি ছিল মাত্র ২৫ মিনিট সময়। সঙ্গে প্রতিটি চালের জন্য মিলছিল বাড়তি ১০ সেকেন্ড করে সময়। চতুর্থ রাউন্ড ছিল একেবারে কুইক ফায়ার গেম। শেষ পর্যন্ত বাজিমাত করে দেন ডিং লিরেন।
আরও পড়ুন- প্রজ্ঞায় মাত গোটা বিশ্ব, বিস্ময়কিশোর হারিয়ে দিয়েছে বিশ্বসেরা দাবাড়ু কার্লসেনকেও!
এই ঘটনার আকস্মিকতায় আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন দুই প্রতিদ্বন্দ্বীই। নতুন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন লিরেনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দ্রুত হলত্যাগ করেন রুশ গ্র্যান্ডমাস্টার। আর বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন শিরোপা জেতার খুশিতে দাবার বোর্ডের সামনেই মাথায় হাত দিয়ে যেন কোথায় হারিয়ে যান লিরেন। ২.৫-১.৫ পয়েন্টের ব্যবধানে জিতে ওপেন ক্যাটাগরিতে চিনের জন্য এক ইতিহাস লিখে গেলেন ডিং। ম্যাচ জিতে নেওয়ার পর চিনের এই তারকা দাবাড়ু বলেন,
"ম্যাচ জেতার মুহূর্তটায় আমি অত্যন্ত আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলাম। নিজেকে একেবারেই সামলে রাখতে পারিনি আমি। মনে হচ্ছিল যেন কেঁদে ফেলব। আমার জন্য এটা একটা অত্যন্ত কঠিন টুর্নামেন্ট ছিল।"
তবে যাই হোক, চিনের ডিং কিন্তু বেশ ঠান্ডা মেজাজের, শান্ত স্বভাবের মানুষ। দাবার কঠিন চাল ছাড়া, তাঁর মাথায় আর কিছুই চলে না। যখন তিনি খেলায় মগ্ন, তখন কোনও কিছুই তাঁকে যেন টলিয়ে দিতে পারে না। প্রতিপক্ষের দাবাড়ু তাঁকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। চিনের এই দাবাড়ু নিজের খেলা নিয়েই ভাবেন। অদ্ভুত এক মানুষ তিনি। রাজা, মন্ত্রী, হাতি, ঘোড়া কোনও কিছু দিয়েই যেন ডিং লিরেনকে আটকানো সম্ভব নয়।
৩০ বছর বয়সী ডিং চিনের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রেটিং পাওয়া দাবাড়ু। তাঁর জয়ের ফলে অবসান ঘটেছে পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ম্যাগনাস কার্লসেনের ১০ বছরের রাজত্বের। গত বছর জুলাই মাসেই কার্লসেন ঘোষণা করেন, চ্যাম্পিয়নশিপ ধরে রাখার লড়াইতে তিনি আর অবতীর্ণ হবেন না। আর এতেই যেন ভাগ্য খুলে যায় ডিং লিরেনের! বিশ্ব চ্যাম্পিয়নকে কে চ্যালেঞ্জ জানাবে, তা নির্ধারিত হয় যে আসরে, সেখানে ক্যান্ডিডেট টুর্নামেন্টে খেলার সুযোগ পেয়ে যান ডিং। যেহেতু, এবারের লড়াইয়ে ম্যাগনাস নেই, তাই রানার আপ হয়ে বিশ্ব দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার যোগ্যতা অর্জন করেন ডিং লিরেন।
তবে, লিরেনের এই যাত্রাপথ এতটাও সহজ ছিল না। বিশ্ব দাবার মঞ্চে পা রাখতে, তাঁকে অনেক কাঠ খড় পোড়াতে হয়েছে। কারণ, দাবায় পথচলা এতটা সহজ নয়। দাবার মতো মঞ্চে দেশের সমর্থন পাওয়া বেশ বড় ব্যাপার। তাই বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের টুর্নামেন্টে পৌঁছনোর এই সফর তাঁর কাছে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। প্রথমে জমকালো বিশ্বসেরার বাছাই পর্ব ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্টেই সুযোগ পাননি তিনি। কারণ সেই সময় রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের পর, রুশ দাবাড়ু সেরগেই কারিয়াকিন খোলাখুলি সমর্থন করেছিলেন রাশিয়াকে। এই নিয়ে প্রকাশ্যে বক্তৃতা এবং বিবৃতিও দিয়েছিলেন তিনি।
আরও পড়ুন- কোচের প্রিয় ছাত্র ছিলেন না, তবু কোন মন্ত্রে ভারত জয় করলেন সচিন?
যদি, সবকিছু ঠিক থাকত এবং সেরগেই রাশিয়াকে সমর্থন না করতেন, তাহলে হয়তো তিনি এই ক্যান্ডিডেট টুর্নামেন্টে জায়গা পেতেন। কিন্তু ক্যান্ডিডেট দাবা শুরু হওয়ার আগে শেষ মুহূর্তে সেরগেইকে নিষিদ্ধ করে আন্তর্জাতিক দাবা ফেডারেশন ফিদে। ফলে, শেষ মুহূর্তে নিজের ডাক পান ডিং লিরেন। ক্যান্ডিডেট টুর্নামেন্টেও রানার আপের স্থান দখল করতে পেরেছিলেন তিনি। সেই কারণে ফেভারিট তিনি কখনই ছিলেন না। কিন্তু, সব সময় কি আর ফেভারিটই জয় পায়? কখনও কখনও, সঠিক সময়েরও দরকার হয়। আর সেই ঠিক সময়ই হয়তো ইতিহাস লিখিয়ে নিল ডিং লিরেনকে দিয়ে। অবিশ্বাস্য লড়াই করে মাসের শেষ দিনে বিশ্ব দাবার মুকুট মাথায় তুললেন চিনের এই দাবাড়ু।
বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়ে ডিং বলেন,
"এটা আমার কাছে ড্রিম কাম ট্রু। চার বছর বয়স থেকে দাবা শেখা শুরু করেছিলাম আমি। বিভিন্ন উপায়ে নিজের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য ২৬ বছর ধরে খেলে যাচ্ছি। কিন্তু কোনওবার, এত বড় জয়ের স্বাদ পাইনি। আমার মনে হয় আমি সবকিছু করেছি দাবার জন্য। মাঝেমধ্যে মনে হয়েছিল, আমি দাবার প্রতি নেশাগ্রস্ত। কারণ টুর্নামেন্ট ছাড়া আমার ভালই লাগত না। অন্য কিছুতে খুশি হওয়াও আমার পক্ষে কঠিন ছিল। তাই এই ম্যাচ আবার আত্মার গভীরতাকে একেবারে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত করছে।"
ফাইনাল ও চতুর্থ গেমের টাইব্রেকারের পর যখন হাল ছেড়ে দিলেন নেপোমনিয়াছি, তখন মাথার দুই পাশে হাত দিয়ে বসে থাকা ডিং লিরেনের চোখে আনন্দাশ্রু। নিজেকে যেন বারবার বোঝাচ্ছিলেন, তিনি পেরেছেন, তিনি সত্যিই বিশ্ব দাবা চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে নিয়েছেন। প্রথম চিনা দাবাড়ু হিসেবে এই নজির গড়েছেন তিনি। তিনি হয়তো ফিরে গিয়েছিলেন, নিজের প্রথম দাবা শেখার দিনগুলিতে। বারবার তার মনে পড়ছিল, সেই লড়াই। শুধুমাত্র মহিলা দাবাড়ুরাই নন, চিনের পুরুষরাও দাবার জগতে কিছু করে দেখাতে পারে, এই কথাটিই যেন দাবা খেলা শুরু করার দিন থেকে পণ করে নিয়েছিলেন ডিং। আর ২৬ বছরের অক্লান্ত লড়াইয়ের পরে অবশেষে মিলল স্বস্তি। পুরুষ দাবার দুনিয়া এবার পেল এক নতুন গ্র্যান্ডমাস্টার। ইতিহাস রচনা করলেন ডিং, থুড়ি কিং লিরেন।