কোচের প্রিয় ছাত্র ছিলেন না, তবু কোন মন্ত্রে ভারত জয় করলেন সচিন?

Sachin Tendulkar: সচিনের চেয়ে বেশি প্রতিভা নিয়ে হয়তো অনেকেই এসেছিলেন। কিন্তু, স্রেফ প্রতিভা দিয়ে একটা আস্ত দেশের ক্রিকেট ঈশ্বর হয়ে ওঠা যায় না।

সেঞ্চুরি করার পরেই একটা ট্রেডমার্ক স্টাইলে উদযাপন। ব্যাট উঁচিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে এক নীরব উদযাপনই বটে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১০০ বার এই কাজটাই করেছেন তিনি। আদতে আকাশের দিকে তাকিয়ে নিজের বাবাকে স্মরণ করতেন তিনি। ক্রিকেট ইতিহাসে এই কীর্তি শুধুমাত্র একজনেরই। তিনি পাল্টে দিয়েছিলেন উপমহাদেশের গোটা ক্রিকেট সংস্কৃতিকেই। তাঁর একটা স্ট্রেট ড্রাইভ যেন সীমান্তের রক্তরেখাকেও ভেঙে ছারখার করে দিতে পারে। তার একটা আপার কাট যেন আছড়ে পড়ে লাইন-অব-কন্ট্রোলের উপরে। তাঁর একটা স্কোয়ার কাট যেন মিলিয়ে দেয় গোটা ক্রিকেট বিশ্বকে। আর ভক্তদের মুখে শোনা যায় একটাই ধ্বনি "সচিন... সচিন!"

ক্রিকেট ইতিহাসে ৪৩৬ বার তিনি ডাগ আউট থেকে বাইশ গজে ব্যাট হাতে হেঁটে গিয়েছেন, রঙিন পোশাকে। কখনও ব্যাট নিয়ে খানিক শ্যাডো করে নিয়েছেন, আবার কখনও হেলমেট এদিক সেদিক করে একটু জগিং করে নিয়েছেন। ১৮ মার্চ ২০১২, ঢাকার শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে তিনি আবার উপস্থিত নিজের আন্তর্জাতিক এক দিবসীয় কেরিয়ারের ইতি টেনে নিতে। বিপরীতে রয়েছে পাকিস্তান। এশিয়া কাপের হয়তো সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ। পাকিস্তান টসে জিতে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। মহাম্মদ হাফিজ এবং নাসির জামশেদের জোড়া সেঞ্চুরিতে ৩২৯ রানের বড় সংগ্রহ গড়ে তুলেছিল পাকিস্তান।

জবাবে ব্যাট করতে গৌতম গম্ভীরকে সঙ্গে নিয়ে সেই শেষবারের মতো রঙিন পোশাকে ২২ গজে নেমেছিলেন সচিন তেন্ডুলকার। এর আগে যদিও বল করেছিলেন তিনি। তবে শেষ ওয়ানডে ম্যাচটা আরও বেশি স্মরণীয় হয়ে থাকত যদি উইকেটের তালিকায় একটু কলমের খোঁচা পড়ত। তাছাড়া আগের ম্যাচেই এক অনন্য রেকর্ড গড়েছিলেন সচিন তেন্ডুলকার। বাংলাদেশের বিপক্ষে নিজের শততম শতক হাঁকিয়েছিলেন তিনি। আর সেটাই হয়ে উঠল এক দুর্ভেদ্য মাইলফলক।

আরও পড়ুন- “কাজটা যদি করে দেন”, সচিনকে কীসের কথা বলেছিলেন সেহওয়াগ? অবশেষে রহস্য প্রকাশ্যে

তবে যাই হোক, পাকিস্তানের বিপক্ষে সে ম্যাচের শুরুতেই আউট হয়ে যান গৌতম গম্ভীর। মাঠে নামেন তরুণ বিরাট কোহলি। তখন বিরাট কোহলি সবে সবে আন্তর্জাতিক স্তরে নাম করতে শুরু করেছেন। সচিন সেদিন খুবই সাবধানে এগোচ্ছিলেন। আর নিজের ছন্দে ব্যাটিং চালিয়ে যাচ্ছিলেন বিরাট। ভারতের ব্যাটিংয়ের অতীত আর ভবিষ্যৎ তখন একসঙ্গে ঢাকার মাঠে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। ১৩৩ রানের জুটি ভেঙে সেদিন সঈদ আজমালের বলে স্লিপে ক্যাচ দিয়ে ডাগ আউটের পথে হেঁটে ছিলেন সচিন। তবে আউট হওয়ার আগে সেদিন ওয়ানডে কেরিয়ারের ৯৬ তম অর্ধশতক করে ফেলেছিলেন তিনি। কিন্তু গোটা ক্রিকেট বিশ্ব ভেবেছিল, নিজের শেষ এক দিবসীয় ম্যাচে হয়তো আরও একবার ভেলকি দেখাবেন সচিন। সেই আশা পূর্ণ হয়নি ক্রিকেট বিশ্বের। রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্পের মতো কেমন যেন, 'শেষ হয়েও হইলো না শেষ' হয়েই রয়ে গেল সচিনের সেই ইনিংস।

তবে সেই তৃষ্ণা মিটানোর সুযোগ আর পেলেন না তিনি। সচিন সেবার গেলেন, একবারের জন্য নয়, শেষবারের জন্য! তার কেরিয়ার শেষ হলো না বরং যেন থেমে গেল। রঙিন ৯৬ টা অর্ধশতক এবং ৪৯টা শতক দিয়ে সাজানো সেই কেরিয়ার। তবে সচিন সেই ম্যাচে আউট হয়ে যাবার পরে সচল ছিল বিরাট কোহলির ব্যাট। তরুণ বিরাট সেই ম্যাচে করেছিলেন ১৮৩ রান। হয়তো আরেকটু সুযোগ পেলে দ্বিশতকও সেরে ফেলতে পারতেন তিনি। তবে পাকিস্তানের পেসার ওমার গুল তাঁকে আর সেই সুযোগ দিতে চাননি। তবে হার এড়াতে পারেনি পাকিস্তান। সচিনের শেষ ম্যাচ তো আর ভারত হারতে পারে না! যে সচিন তাঁর ক্রিকেট নৈপুণ্য দিয়ে ভারতকে নিয়ে গেছেন এক অন্য উচ্চতায়, তাঁর বিদায় তো আর এমন সাদামাটা হওয়া চলে না। তাই নিজেদের সবটুকু দিয়ে সেদিন ৩৩০ রানের টার্গেট ছুঁয়ে জয় নিয়েই ক্ষান্ত হয়েছিলেন ভারতের সব ব্যাটাররা। অবিশ্বাস্য এক জয় দিয়েই শেষ হয় কিংবদন্তির কেরিয়ার।

ভারতের ইতিহাসে কিংবদন্তি ব্যাটসম্যানের সংখ্যা নেহাত কম নয়। এই উপমহাদেশ থেকে অনেক 'গ্রেট' ব্যাটসম্যানরা উঠে এসেছেন। অনেক গ্রেটরাই উইলোর কারুকাজ দেখিয়েছেন সবুজ ঘাসের উপর। তবে এই তালিকায় একটি নাম একেবারেই ভিন্ন। তিনি যেন ছাপিয়ে গিয়েছিলেন সব কিছুকে। তিনি ব্যাট হাতে নামলে থমকে যায় গোটা ভারত। এখনও ভারতের অলিতে গলিতে ব্যাট নিয়ে ছুটে চলা কচিকাঁচারা সচিন তেন্ডুলকার হতে চায়, মারতে চায় সেই ট্রেডমার্ক স্ট্রেট ড্রাইভ।

তবে হতে চাইলেই কি আর সচিন হওয়া যায়? ইচ্ছা হলেই কি তাঁর মতো ক্রিকেটে রাজত্ব করা যায়? আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রায় দুই যুগের কেরিয়ার তাঁর। এতটা সময় ধরে ক্রিকেটের সর্বোচ্চ পর্যায়ে এভাবে খেলে যেতে কি আর কেউ কোনওদিন পারবেন? অনেকেই বলেন, সচিনের মতো ক্রিকেট প্রতিভা নিয়ে ক'জনই বা জন্মায়! খানিক ঠিক, ব্যাট হাতে এক অদ্ভুত প্রতিভা নিয়ে তিনি জন্মেছিলেন। কিন্তু এই প্রতিভার সর্বোচ্চ ব্যবহার কীভাবে করতে হয়, তা কিন্তু সচিন নিজেই শিখিয়ে গিয়েছেন গোটা বিশ্বকে। তাঁর চেয়ে প্রতিভাবান ক্রিকেটার নিশ্চয়ই পৃথিবীতে এসেছেন কিন্তু, তারা সচিন তেন্ডুলকার হতে পারেননি। তাঁরাও নিজের নিজের জায়গায় সফল হয়েছেন। তবে গড অব ক্রিকেট, সেই একজনই, সচিন রমেশ তেন্ডুলকার।

ভারতের ক্রিকেটের কিংবদন্তি কোচ রমাকান্ত আচরেকারের হাত ধরেই উঠে এসেছিলেন সচিন তেন্ডুলকার, বিনোদ কাম্বলিরা। শিবাজি পার্কের ওই মাঠে সচিনদের সঙ্গে অনুশীলন করতেন আরও এক তরুণ তুর্কি, নাম অনিল গুরাভ। তিনি কিন্তু কোচ রমাকান্তের সব থেকে প্রিয় ছাত্র ছিলেন। এমনকি সচিনকেও তিনি বলতেন অনিলের মতো ব্যাটিং করার চেষ্টা করতে। কিন্তু, অনিল গুরাভ হারিয়ে গিয়েছিলেন শিবাজি পার্কের ওই মাঠ থেকেই। সচিন তেন্ডুলকার নিজেকে তুলে এনেছিলেন কিংবদন্তিদের তালিকায়। নিজের পুরো জীবনটা শৃঙ্খলা এবং কঠিন পরিশ্রমে বেঁধে ফেলেছিলেন তিনি। আর জীবনের সেরা সময়টাই তিনি দিয়েছেন ক্রিকেটকে। পুরো সময়টা তিনি দিয়েছেন বাইশ গজকে। আর সেই ২২ গজও তাঁকে দু'হাত ভরেই ফিরিয়ে দিয়েছে।

আরও পড়ুন- ধুঁকতে থাকা ভারতীয় দলকে লড়তে শিখিয়েছেন সচিন, কেন সেরার সেরা মাস্টারব্লাস্টার

মাত্র ১৭ বছর বয়সে এই ভারতের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা দিয়েছিলেন তিনি। যদিও তাঁর ক্রিকেটযাত্রা এর অনেক আগেই শুরু হয়েছিল। সেই ছোট বয়স থেকেই প্রতিদিন এক রুটিন মেনে চলেছেন তিনি। প্রতিদিন ভোরবেলা উঠে শুরু করছেন ব্যাট হাতে লড়াই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যাটিং করে, নিজেকে পারফেক্ট করে তুলেছিলেন তিনি। শোনা যায়, সারাদিন তিনি এমন অক্লান্ত পরিশ্রম করতেন যে, যখন বাড়িতে ফিরতেন তখন একেবারে ঘুমে ঢলে পড়তেন। ভারতের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার পর তারকা খ্যাতি তাঁর পিছু নিয়েছিল।

কিন্তু তারকা হয়ে গেলেও কঠোর পরিশ্রম একইভাবে বজায় রেখেছিলেন তিনি। ভারতীয় ক্রিকেটের পরিভাষাই বদলে দিয়েছিলেন তিনি। তবে, ক্রিকেট প্রেম তাঁর চিরকালীন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যে ২৪ টা বছর তিনি খেলেছেন, তখনও সেই একই রকম শৃঙ্খলার জীবন। ব্যাট হাতেও সেই একই রকম পরিশ্রম। ব্যাট নিয়ে এরকম অমানবিক পরিশ্রম, বিশ্ব ক্রিকেটে হয়তো খুব কমজনই করতে পেরেছেন। 

সচিনের চেয়ে বেশি প্রতিভা নিয়ে হয়তো অনেকেই এসেছিলেন। কিন্তু, স্রেফ প্রতিভা দিয়ে একটা আস্ত দেশের ক্রিকেট ঈশ্বর হয়ে ওঠা যায় না। যদি প্রশ্ন করা হয়, এই মুহূর্তে ভারতীয় ক্রিকেটে এমন কেউ কি আছেন, যিনি এই জীবন যাপন করতে পারবেন? এমন কি কেউ রয়েছেন, যিনি দিনভর শুধু ক্রিকেটকেই সময় দিতে পারবেন? যদি সেরকম কেউ আবার আসেন, তাহলে আবার হয়তো সচিনকে ছুঁয়ে দেখার দুঃসাহস দেখাতে পারবেন তিনি। ততদিন, ভারতীয় ক্রিকেটের অধিশ্বর রইবেন লিটল মাস্টারই!

More Articles