মুর্শিদাবাদে ঠিকাদারের টিপসই বদলে দিল তদন্তের দিশা! যেভাবে আবিষ্কার হলো 'ফিঙ্গারপ্রিন্ট'

Fingerprints : হার্শল ঠিকাদারের হাত কালির দোয়াতে চুবিয়ে দেন এবং চুক্তিপত্রের শেষ পৃষ্ঠার পিছনে সব আঙুলের ছাপ তুলিয়ে নেন।

অগাস্ট, ১৮৮০। কোনওক্রমে ভগ্নপ্রায় শরীরটাকে টেনে নিয়ে গিয়ে টেবিলে বসলেন এক বৃদ্ধ। টেবিলের মধ্যে রাখা রয়েছে একটি খাম বন্ধ চিঠি। বৃদ্ধ চিঠিটি পড়ে সেটিকে আবার খামের ভেতর ঢুকিয়ে রেখে দিলেন। কিছু একটা চিন্তা করলেন এবং বেয়ারাকে ডাকলেন। বেয়ারাকে ডেকে নির্দেশ দিলেন চিঠিটি তাঁর এক বন্ধুর ঠিকানায় পোস্ট করে দিতে। এই বন্ধুটি আসলে ছিলেন প্রখ্যাত গণিতজ্ঞ ফ্রান্সিস গ্যাল্টন এবং এতক্ষণ ধরে আপনাদের যে বৃদ্ধের কথা বলছি, তিনি হলেন চার্লস ডারউইন। তবে ডারউইন চিঠি পাঠানো সত্বেও তার কোনও জবাব আসেনি গ্যাল্টনের পক্ষ থেকে।

ডারউইনের চিঠি পাঠানোর কয়েকমাস পর, ১০ নভেম্বর প্রখ্যাত বিজ্ঞান পত্রিকা ‘নেচার’-এ একটি গবেষণা পত্র প্রকাশিত হয়। এই গবেষণা পত্রের মূল বিষয়বস্তু ছিল কীভাবে আঙুলের ছাপের মাধ্যমে অপরাধের তদন্ত করা যায়। এই গবেষণা পত্রটি লিখেছিলেন হেনরি ফল্ডস (Henry Faulds)। গবেষণা পত্রটি প্রকাশ পেতেই সারা বিশ্বে বিখ্যাত হয়ে যান হেনরি। বিংশ শতাব্দীর শুরুর ভাগ থেকেই মোটামুটি সমস্ত ইউরোপে এই আঙুলের ছাপের মাধ্যমে তদন্তের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। বলাই বাহুল্য, এর সম্পূর্ণ কৃতিত্ব গিয়ে বর্তায় হেনরি ফল্ডসের উপর। তবে খ্যাতিরও নিজস্ব কিছু সমস্যা রয়েছে। হেনরি ফল্ডসের নাম লোকমুখে ছড়িয়ে পড়তে পড়তে গিয়ে পৌঁছয় আরেক ব্রিটিশ ব্যক্তির কানে। তাঁর নাম উইলিয়াম হার্শল (William Herschel)। হার্শল যখন জানতে পারেন, ফল্ডসকে ফিঙ্গারপ্রিন্ট প্রযুক্তির জনক বলা হচ্ছে; তিনি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন। কেননা এই পদ্ধতির আবিষ্কার তো করেছিলেন তিনি এবং হেনরি ফল্ডসের অনেক আগেই করেছিলেন। সেই মর্মে হার্শল একটি চিঠি লেখেন নেচার পত্রিকার কর্তৃপক্ষকে। এরপর সুদীর্ঘ আড়াই দশক, একপ্রকার পত্রযুদ্ধ চলে হেনরি ফল্ডস এবং উইলিয়াম হার্শলের। অবশেষে এই পত্রযুদ্ধ থামাতে আসরে নামেন গ্যাল্টন।

ফ্রান্সিস গ্যাল্টন

আরও পড়ুন- নিরক্ষর হয়েও আস্ত একটা বইয়ের লেখক, প্রান্তিক মানুষদের লড়াইয়ের আখ্যান ‘নিরক্ষরের গল্পগুচ্ছ’

ফ্রান্সিস সেই গণিতজ্ঞই যিনি ডারউইনের পাঠানো চিঠির জবাব দেননি। আসলে চার্লস ডারউইন যে চিঠিটি গ্যাল্টনকে পাঠান সেটি ছিল হেনরি ফল্ডসের লেখা। এই চিঠিতে লেখা ছিল কীভাবে ফিঙ্গারপ্রিন্টের মাধ্যমে অপরাধের তদন্ত করা যায়। চিঠিটি পড়ে অত্যন্ত অবাক হয়েছিলেন ফ্রান্সিস গ্যাল্টন। কেননা তাঁকে কয়েকদিন আগে এই একই পদ্ধতির কথা বলেছিলেন তাঁর বন্ধু উইলিয়াম হার্শল। নেচার পত্রিকায় ফল্ডসের গবেষণাপত্র প্রকাশিত হওয়ার কয়েকদিন পর একটি সভায় গ্যাল্টন নিজের বন্ধু উইলিয়াম হার্শলের আবিষ্কারের কথা উল্লেখ করেন। স্বভাবতই হইচই পড়ে যায় সর্বত্র। অনেকেই দাবি করতে থাকেন, গ্যাল্টন অনৈতিকভাবে ফল্ডসের কৃতিত্ব নিজের বন্ধুকে দিচ্ছেন। কিন্তু আসল কৃতিত্ব কার? তা জানতে হলে আগে জানতে হবে দু'জনে কীভাবে এই পদ্ধতির আবিষ্কার করেছিলেন।

হেনরি ফল্ডস

শুরু করা যাক উইলিয়াম হার্শলকে দিয়ে। ১৮৫৩ সালে মুর্শিদাবাদে কালেক্টর হয়ে আসেন উইলিয়াম হার্শল। এর ৫ বছর পর, অর্থাৎ ১৮৫৮ সালের একটি ঘটনায় তাঁর মাথায় আসে ফিঙ্গারপ্রিন্টের গুরুত্ব। সেবছর রাস্তা তৈরির কাঁচামাল জোগান দেওয়ার জন্য একটি চুক্তি সই হওয়ার কথা ছিল স্থানীয় ঠিকাদার এবং সরকারের মধ্যে। স্বাভাবিকভাবেই সরকারের তরফে সই করতে গিয়েছিলেন হার্শল। সই করার সময় ঘটে এক ঘটনা। হঠাৎ হার্শল ঠিকাদারের হাত কালির দোয়াতে চুবিয়ে দেন এবং চুক্তিপত্রের শেষ পৃষ্ঠার পিছনে সব আঙুলের ছাপ তুলিয়ে নেন। পরবর্তীকালে এই ঘটনা প্রসঙ্গে হার্শল লিখেছিলেন, "ওই ঠিকাদার ছিল অত্যন্ত দুর্নীতিপরায়ণ। আমি ওর সব আঙুলের ছাপ এই কারণে নিয়েছিলাম যাতে সে পরে বলতে না পারে যে চুক্তিপত্রে করা টিপসই আসলে তার নয়।" এই পদ্ধতি এত কার্যকরী হয় যে, এরপর থেকে সব চুক্তিপত্রেই এই একই পদ্ধতি অবলম্বন করা শুরু করেন হার্শল। ১৮৬০ সালে উইলিয়াম হার্শলের বদলি হয়ে যায় নদিয়াতে। নদিয়া ছিল সেই সময় নীল বিদ্রোহের পীঠস্থান। নীল বিদ্রোহের পরে নীল চাষিদের অবস্থা হয়েছিল শোচনীয়। ইংরেজ সরকার তো ছিলই, উপরন্তু স্থানীয় জমিদাররাও তাদের শোষণ করত যথেচ্ছভাবে। হামেশাই জমিদাররা জাল সই করে কৃষকদের থেকে জমি হাতিয়ে নিত অথবা জমির খাজনা চাইত। নদিয়ায় বদলি হয়ে এসে এই দুর্নীতি রুখতে সক্রিয় হন উইলিয়াম হার্শল। এখানে এসেও তিনি চালু করে দেন তাঁর ‘মুর্শিদাবাদ মডেল’।

উইলিয়াম হার্শল

হার্শল নিয়ম করেন, এরপর থেকে সব জমির কাগজপত্রে এবং সরকারি চুক্তিতে আঙুলের ছাপ হবে বাধ্যতামূলক। পরবর্তীকালে হার্শল সরকারের কাছে অনুরোধ করেন, যেন আঙুলের ছাপকে সব সরকারি কাজেই বাধ্যতামূলক করে দেওয়া হয়। তৎকালীন ইংরেজ সরকার এই অনুরোধ খারিজ করে দেয়। এরপর ১৮৭০ সালে হুগলিতে বদলি হয়ে আসেন উইলিয়াম হার্শল। এখানে এসে আরও বড় দুর্নীতি দেখতে পান তিনি। অনেকেই জাল সই করে একে অপরের পেনশন তুলে দিচ্ছেন, প্রভাবশালী আসামিরা সই নকল করে নিজেদের নামে অন্য কাউকে জেলে ঢুকিয়ে দিচ্ছে- এসব খুব সাধারণ ব্যাপার ছিল হুগলিতে। সেই সময় উইলিয়াম হার্শল নিয়ম করেন, সব সরকারি কর্মচারী এবং জেলের আসামিদের আঙুলের ছাপের রেকর্ড রাখা হবে। এই নিয়ম চালু করার ফলে জালিয়াতির সংখ্যা অনেকটা কমে যায়। এর কয়েক বছর পর উইলিয়াম হার্শল ইংল্যান্ডে ফিরে যান। দেশে ফিরে তিনি জানতে পারেন, যে পদ্ধতি তিনি বাংলায় চালু করে গিয়েছিলেন, সেই একই পদ্ধতি হেনরি ফল্ডস নিজের আবিষ্কার বলে চালাচ্ছেন।

আরও পড়ুন- হিমশিম খেয়েছে বিজ্ঞানও! মৃতের ‘আত্মা’ই ধরিয়ে দিলেন নিজের খুনিকে, কীভাবে সম্ভব?

হেনরি ফল্ডসের জীবনও শুরু হয়েছিল বাংলা থেকেই। পেশায় একজন মিশনারি ডাক্তার ছিলেন তিনি। চার্চ অব স্কটল্যান্ড থেকে তাঁকে দার্জিলিং পাঠানো হয় হাসপাতাল পরিচালনার জন্য। এখানে কয়েক বছর মিশনারি হাসপাতাল চালানোর পর, ১৮৭৩ সালে জাপান চলে যান হেনরি ফল্ডস। জাপানের ইতিহাসে প্রথম পোস্টমর্টেমটি করেছিলেন তিনি। জাপানি প্লেগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে, নিজের দক্ষতায় সেই প্লেগও রুখে দেন ফল্ডস। জাপানে থাকাকালীন, এক বন্ধুর আমন্ত্রণে সেখানকার এক আর্কিওলজিক্যাল সাইটে যান তিনি। সেখানে গিয়ে তিনি দেখেন ২০০০ বছর পুরনো বাসনপত্র এবং মূর্তি উদ্ধার করা হয়েছে মাটির নিচ থেকে। প্রায় ২ হাজার বছর পুরনো কলসির উপর কিছু সূক্ষ্ম রেখা দেখে তাঁর চোখ আটকে যায়। ফল্ডস বোঝেন, এটি আসলে ২০০০ বছর পুরনো কলসি নির্মাতার আঙুলের ছাপ। এই ঘটনার পরেই ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে গবেষণা শুরু করেন হেনরি ফল্ডস। গবেষণা থেকে ফল্ডস বুঝতে পারেন, প্রত্যেক মানুষের ফিঙ্গারপ্রিন্ট একে অপরের থেকে আলাদা হয়। নিজের এবং নিজের ছাত্রদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে তিনি একটি হাইপোথিসিস তৈরি করেন এবং সেটিকে ভিত্তি করে গবেষণা পত্র তৈরি করেন। নিজের গবেষণায় ফল্ডস দাবি করেন, আঙুলের ছাপই মানুষের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য 'আইডেন্টিফিকেশন মার্ক' হতে পারে। আঙুলের ছাপের উপর ভিত্তি করে যে অপরাধীকে ধরা যায় তা হাতে-নাতে প্রমাণ করে দেন ফল্ডস। তাঁর গবেষণাগার থেকে একবার কিছু গুরুত্বপূর্ণ জিনিস চুরি হয়েছিল। শোনা যায়, পুলিশ ডেকে নিজের ও সকলের আঙুলের ছাপ পরীক্ষা করে অপরাধী ধরেছিলেন খোদ হেনরি ফল্ডস। এইসব ঘটনারই উল্লেখ ফল্ডস নিজের গবেষণা পত্রে করেছিলেন। এই গবেষণা পত্র এবং নিজের গবেষণার কথা উল্লেখ করে প্রখ্যাত বৈজ্ঞানিক চার্লস ডারউইনকে একটি চিঠিও লিখেছিলেন হেনরি ফল্ডস। সেই চিঠি পড়ে অভিভূত হয়ে যান ডারউইন, এটি নিজের অত্যন্ত কাছের বন্ধু গ্যাল্টনকেও পাঠিয়ে দেন পড়তে। আগেই বলেছি, ততদিনে গ্যাল্টন এবং উইলিয়াম হার্শলের কথা হয়ে গেছে ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে।

সব শেষে একথা স্বীকার করতেই হবে যে, হেনরি ফল্ডস এবং উইলিয়াম হার্শল দু'জনেই নিজেদের মতো করে এই পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন। এটি কেবলমাত্র একটি কাকতালীয় বিষয় যে দু'জনে একই জিনিস নিয়ে কাজ করেছেন। তাই বর্তমানে দু'জনকেই এই পদ্ধতির জনক বলে মনে করা হয়। প্রায় আড়াই দশক পত্রযুদ্ধ চলার পর হার্শল এবং ফল্ডস একপ্রকার সন্ধি করে নেন গ্যাল্টনের মধ্যস্থতায়। ১৯১৬ সালে এই সম্পূর্ণ বিবাদটি নিয়ে একটি বই লেখেন উইলিয়াম হার্শল। কীভাবে তিনি ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে দুর্নীতি রুখেছিলেন, ফ্রান্সিস গ্যাল্টনের সঙ্গে তাঁর এ বিষয়ে কথোপকথন, হেনরি ফল্ডসের গবেষণাপত্র, তাঁদের পত্রযুদ্ধ এবং পরবর্তীকালে মিটমাট- পুরো ঘটনারই বিবরণ রয়েছে বইটিতে। এই বইটি প্রকাশ পাওয়ায় গোটা বিশ্বের মানুষ দু'জনের বিবাদ সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারণা পান। সেই থেকেই দু'জনকেই এই অভাবনীয় পদ্ধতি আবিষ্কারের কৃতিত্ব দিয়ে আসা হচ্ছে।

 

More Articles