ঠিক যেন যুধিষ্ঠির-শকুনির পাশাখেলা! ভারতীয় রাজনীতির যে অধ্যায়ের সঙ্গে জড়িত ছিলেন জ্যোতি বসুও

VP Singh Chandrashekhar Clash Politics : এতটা পর্যন্ত চন্দ্রশেখর নিশ্চিন্তে ছিলেন। কিন্তু এরপর যা হয় তা সম্পূর্ণ 'আউট অফ সিলেবাস'।

আজকে আপনাদের শোনাব ভারতের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক বিশ্বাসঘাতকতার গল্প। এমন এক ঘটনা যখন প্রথম জন দ্বিতীয় জনকে আটকাতে তৃতীয় একজনকে প্রধানমন্ত্রী বানাতে চান। কিন্তু সেই তৃতীয় মানুষটি শেষ মুহূর্তে নিজের নাম সরিয়ে দ্বিতীয়কে প্রধানমন্ত্রী বানিয়ে দেন। আজকে আপনাদের শোনাব কীভাবে চৌধুরী দেবী লাল, চন্দ্রশেখরকে মাত দিয়ে শেষ মুহূর্তে বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং-কে দেশের প্রধানমন্ত্রী বানিয়ে দেন। আর এই ঘটনার ফলেই ভারতীয় রাজনীতিতে উত্থান হয় লালু-নীতিশ-মুলায়মদের।

১৯৮৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বফর্সের কারণে কংগ্রেসের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়। ৪২৫ থেকে আসন সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ১৯৮। সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় সরকার বানাতে অক্ষম হন রাজীব গান্ধী। পরিবর্তে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় বিপক্ষ জোট অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় মোর্চা। এই রাষ্ট্রীয় মোর্চায় সবচেয়ে বড় দল ছিল জনতা দল (১৪২); তাদের সঙ্গে ছিল বিজেপি (৮২), বামফ্রন্ট (৫২) এবং টিডিপি, ডিএমকে, অহম গণ পরিষদ-সহ অন্যান্য দল। সব মিলিয়ে রাষ্ট্রীয় মোর্চার আসন সংখ্যা ছিল ২৮৯, যা সংখ্যাগরিষ্ঠতার থেকে বেশি। স্বভাবতই, সবচেয়ে বড় দল হওয়ায় জনতা দলের নেতাই হবেন প্রধানমন্ত্রী।

জনতা দলের নেতা হওয়ার দৌড়ে ছিলেন তিনজন - বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং, চন্দ্রশেখর এবং তুলনামূলক দুর্বল প্রার্থী চৌধুরী দেবী লাল। ভিপি সিং রাজীব গান্ধী সরকারের ডিফেন্স মিনিস্টার বা প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ছিলেন। তিনিই দেশজুড়ে কংগ্রেস-বিরোধী আন্দোলনকে জোরদার করেছিলেন। চন্দ্রশেখর ছিলেন সেই ১৯৭৭ সাল থেকে জনতা পার্টির অধ্যক্ষ। জনতা দলে যোগদানের সময় সবচেয়ে বড় দল ছিল জনতা পার্টিই। আর চৌধুরী দেবী লাল ছিলেন হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী, যিনি ১৯৮৭ সালে কংগ্রেসের বিজয়রথ থামিয়ে দিয়েছিলেন হরিয়ানায়।

আরও পড়ুন : ‘অটল মুখোশ মাত্র!’ এক চিঠিতেই বিজেপির ‘কম্পিউটার ম্যানে’র জীবন শেষ করেছিলেন বাজপেয়ী

VP singh, Chandrashekhar and chaudhury debi lal

ভিপি সিং, চন্দ্রশেখর এবং চৌধুরী দেবী লাল

জনতা দলের নেতা কে হবেন তা নিয়ে বিস্তর চর্চা চলতে থাকে দিল্লির অন্তঃপুরে। দল ভাঙানো, লবি তৈরী করা, বাক-বিতণ্ডা এসবের জেরে সংসদীয় দলের মিটিং ক্রমশ পিছতে থাকে। ৩০ নভেম্বর বৈঠক বসে চন্দ্রশেখরের বাসভবনে। চন্দ্রশেখর যখন জ্যোতি বসু, নাম্বুদিরিপাদ, অটল বিহারী বাজপেয়ীদের সঙ্গে বৈঠক করছেন সেই সময় তার বাড়ির বাইরে ধর্না দেন রাম জেঠমালানি। তিনি দাবি করতে থাকেন, চন্দ্রশেখর যেন তাঁর প্রার্থীপদ তুলে নেন। কিছুক্ষণ ধর্না দেওয়ার পর চন্দ্রশেখরের অনুগামীরা এসে জেঠমালানিকে আক্ষরিক অর্থেই জুতো মেরে ফেরত পাঠান। এদিকে চন্দ্রশেখরের মতো আরেকটি মিটিং চলছিল দিল্লির ওড়িশা ভবনে। উদ্দেশ্য ছিল চৌধুরী দেবী লালের কাঁধে বন্দুক রেখে চন্দ্রশেখরকে মাত দেওয়া এবং বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং-কে প্রধানমন্ত্রী বানানো। সেই মর্মে ওড়িশা ভবনে মিটিং করছিলেন বিজু পট্টনায়েক, অরুণ নেহেরু, সাংবাদিক কুলদীপ নায়ার, জি সি শেঠি-সহ অন্যান্যরা। বিজু পট্টনায়করা যে প্ল্যান বানান তাতে মুখ্য ভূমিকা ছিল চৌধুরী দেবী লালের। চন্দ্রশেখর ভেবেছিলেন, বিজেপি এবং বামফ্রন্টের মধ্যে যে নীতিগত বিরোধ দেখা দেবে তা সামলাতে পারবেন না দেবী লাল। এখন প্রধানমন্ত্রী হলেও তাকে এক-দেড় বছরের মধ্যেই কুর্সি খালি করতে হবে। তাই এখন দেবী লালকেই প্রধানমন্ত্রী বানানো হোক, এতে ভিপি সিংকেও রুখে দেওয়া যাবে।

বিজু পট্টনায়েক, অরুণ নেহেরুরাও তাইই ভেবেছিলেন। তাঁরাও দেবী লাল-কে একই জিনিস বোঝান; কিন্তু একটু অন্যভাবে। দেবী লাল ক্ষমতা পেয়ে ক্ষমতা ছাড়তে নারাজ ছিলেন। ক্ষমতা পেয়ে ছেড়ে দেওয়ার থেকে সেটা না পাওয়াই শ্রেয়। তাই দেবী লাল প্রধানমন্ত্রী হতে অস্বীকার করে দেন। তখন তাঁকে প্রস্তাব দেওয়া হয় উপ-প্রধানমন্ত্রী হওয়ার। অরুণ নেহেরু তাঁকে বোঝান, প্রথমে তাঁর নাম প্রস্তাব করা হবে প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য। তিনি যেন সেই প্রস্তাব নাকচ করে বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং-কে প্রধানমন্ত্রী বানানোর আর্জি করেন। পরিবর্তে তাকে ভিপি সিং সরকারে উপ-প্রধানমন্ত্রী বানানো হবে।

আরও পড়ুন : বারবার সুযোগ পেয়েও ‘ঐতিহাসিক ভুল’, জ্যোতি বসু প্রধানমন্ত্রী হলে অন‍্যভাবে লেখা হত ভারতের ইতিহাস

পরদিন অর্থাৎ ১ ডিসেম্বর ১৯৮৯, শুরু হল সেই নাটক। ভিপি সিং, দেবী লাল এবং ভাইরাল জ্বরে আক্রান্ত চন্দ্রশেখর, তিনজনেই বসে পড়েন বৈঠকে। বৈঠক শুরু হতে না হতেই বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং দাঁড়িয়ে চৌধুরী দেবী লালের নাম প্রস্তাব করেন প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য। চন্দ্রশেখরও রাজি হয়ে যান। এতটা পর্যন্ত চন্দ্রশেখর নিশ্চিন্তে ছিলেন। কিন্তু এরপর যা হয় তা সম্পূর্ণ 'আউট অফ সিলেবাস'। ৬ ফুট ৩ ইঞ্চি উচ্চতার সুদীর্ঘ চৌধুরী দেবী লাল দাঁড়িয়ে বলেন, “আপনাদের অসংখ্য ধন্যবাদ। কিন্তু আমার পক্ষে এই গুরুদায়িত্ব নেওয়া সম্ভব নয়। আমি বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং-কে অনুরোধ করব প্রধানমন্ত্রী পদের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য।”

VP singh NT Rama Rao

বৈঠকের পর প্রসন্ন চিত্তে দেবী লাল, বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন এন টি রামা রাও এবং করুণানিধি

চন্দ্রশেখর বুঝতে পারেন, খেলা হয়ে গেছে, তিনি হেরে গেছেন। বিরক্ত, ক্ষুব্ধ, হতাশ চন্দ্রশেখর সংবাদমাধ্যমে বলেন, “আমি এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছি না। তবে এই সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ আমার অমতে নেওয়া হয়েছে।” এইটুকু বলেই তিনি বেরিয়ে যান মিটিং ছেড়ে। একইসঙ্গে পণ করে নেন রাজা মাণ্ডা-কে (মাণ্ডা রাজ পরিবারের শেষ রাজা ছিলেন ভিপি সিং) শায়েস্তা করার। এরপর ২ ডিসেম্বর দেশের প্রধানমন্ত্রী হন বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং। উপ-প্রধানমন্ত্রী হন চৌধুরী দেবী লাল, বাণিজ্য মন্ত্রী হন অরুণ নেহেরু, রাম জেঠমালানি হন আইনমন্ত্রী, সাংবাদিক কুলদীপ নায়ার হলেন লন্ডনে ভারতীয় দূতাবাসে হাই-কমিশনার। একই সঙ্গে বিজু পট্টনায়েককে আশ্বস্ত করা হয় যে, আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে ওড়িশায় জনতা দল জিতলে তিনিই হবেন মুখ্যমন্ত্রী। চন্দ্রশেখরকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের অফার দেওয়া হলেও তিনি তা খারিজ করেন। ফলত দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হন মুফতি মহম্মদ সৈয়দ। চন্দ্রশেখর শিবির থেকে হরিকিশোর সিং এবং যশবন্ত সিনহাকে (ইনি ২০২২ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দিতা করেছিলেন) রাজ্য মন্ত্রী বানানো হয়।

আরও পড়ুন : “আমার ছেলে প্রধানমন্ত্রী হবে,” ২০০৪ সালেই বলেছিলেন মোদির মা হিরাবেন!

Chandrashekhar, Lalu prasad yadav, mulayam

চন্দ্রশেখরের কারণেই রাজনৈতিক উত্থান হয় লালু প্রসাদ যাদব এবং মুলায়ম সিং যাদবের

যদি ভেবে থাকেন ঘটনা এখানেই শেষ তাহলে ভুল ভাবছেন। এখনও তো চন্দ্রশেখরের চাল বাকি আছে। ভিপি সিং প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই উত্তরপ্রদেশ এবং বিহারে বিধানসভা নির্বাচন হয়। দুই জায়গাতেই জনতা দল বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে সরকার বানায়। তবে এবার বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংকে মাত দেন চন্দ্রশেখর। ভিপি সিং প্রধানমন্ত্রী হবার কয়েকদিন পর উত্তরপ্রদেশে বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল আসে। ভিপি সিংয়ের পছন্দের মুখ্যমন্ত্রী প্রার্থী ছিলেন চৌধুরী চরণ সিংয়ের পুত্র অজিত সিং। কিন্তু বিধায়ক দলের নেতা নির্বাচনের দিন চন্দ্রশেখর কয়েকটি ফোন করেন। তাতেই খেলা ঘুরে যায়। নির্বাচনে হেরে যান অজিত সিং। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হন মুলায়ম সিং যাদব। বাধ্য হয়ে অজিত সিং-কে নিজের ক্যাবিনেটে পর্যটনমন্ত্রী করেন ভিপি সিং।

এরপর ১৯৯০ সালে বিহার বিধানসভা নির্বাচনে বিপুল ভোটে জেতে জনতা দল। সেখানে ভিপি সিংয়ের পছন্দের মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী ছিলেন রামসুন্দর দাস। রামসুন্দরকে আটকাতে চন্দ্রশেখরের কাছে সাহায্য চান লালু প্রসাদ যাদব। বিহারের জনতা দলের বিধায়করা নেতা নির্বাচন করতে ভোটাভুটি করেন। সেই নির্বাচনে চন্দ্রশেখর নিজের এক প্রার্থী রঘুনাথ ঝা-কে পাঠিয়ে দেন। রঘুনাথ নির্বাচন জেতেননি ঠিকই; কিন্তু রামসুন্দর দাসের এত ভোট কাটেন যে লালু প্রসাদ যাদব বিহারের মুখ্যমন্ত্রী হয়ে যান। পরবর্তীতে যেন কোনও অপ্রীতিকর পরিস্থিতি না হয় তার দায়িত্ব দেওয়া ছিল লালুর ‘কখনও বন্ধু, কখনও শত্রু’ নীতিশ কুমার-কে। এই দু'টি চালেই ‘বালিয়ার বাবুসাহেব’ চন্দ্রশেখর স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি ভিপি সিংকে শান্তিতে সরকার চালাতে দেবেন না।

আরও পড়ুন : নেহেরু নন, ইনিই ছিলেন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী

তবে ভিপি সিংয়ের সরকার কীভাবে চলেছিল তা কম-বেশি সকলেরই জানা। মণ্ডল কমিশনের লাগু করা রিজার্ভেশন নিয়ে বিরোধ, মণ্ডল-কমণ্ডলের রাজনীতি, বিজেপির সমর্থন টেনে নেওয়া, ফলস্বরূপ ভিপি সিং সরকারের পতন। মণ্ডল কমিশনের প্রস্তাব মতো রিজার্ভেশন লাগু করার ফলে বিরক্ত চন্দ্রশেখর জনতা দল থেকে আলাদা হয়ে জনতা দল সেক্যুলার বানান। কংগ্রেসের সমর্থনে সাত মাসের জন্য দেশের প্রধানমন্ত্রী হন। তারপরে তিনিও বিভিন্ন কারণে ইস্তফা দিয়ে দেন এবং লোকসভা নির্বাচন হয়। পরবর্তীতে অবশ্য ১৯৯৬-৯৭ সালে জনতা দলের এই সমস্ত নেতারা পুনরায় একত্রিত হন সরকার বানাতে। এবং তারপর দেশে শুরু হয় দু'বছর ব্যাপী এক রাজনৈতিক প্রহসন, যার কথা আপনাদের আগেই ইন্দ্র কুমার গুজরালের বিষয়ে বলতে গিয়ে জানিয়েছি।

More Articles