দেবতারা কি নিজেদের বাঁচাতে পারেন না? বিপর্যয় কীভাবে বদলে দিচ্ছে পাহাড়ের ধর্মীয় বিশ্বাস?

Kedarnath Flood: ৩০ ফুটের এক আয়তাকার পাথর পাহাড়ের নিচে গড়িয়ে পড়ে এবং প্রাচীন মন্দিরের ঠিক আগে আটকে যায়

দেবতারা স্বর্গে থাকেন। মানুষ ভাবে দেবতারা মানুষের মতোই দেখতে, খানিক লার্জার দ্যান লাইফ মানুষ। লার্জার দ্যান লাইফ মানুষদের আমজনতা এমন একটা জায়গায় রাখে যেখানে আসলে সে নিজে থাকতে চেয়েছে। কাম্য বাসা, কাম্য পরিবেশ যা তাঁকে রোজের দীনতা, হীনতা, পাঁক ও গ্লানি থেকে সরিয়ে রাখবে। সবুজের গালিচা বিছিয়ে দেবে, শুভ্র মেঘ ভাসিয়ে দেবে, সেরা যা কিছু, সব সেখানেই। এই জমিনে এমন কিছু দেখলে তাই মানুষ তার নাম দেয় ভূস্বর্গ, নাম দেয় দেবভূমি। সেখানে দেবতাদের বাসা গড়ে দেয় মানুষই। কেন্দ্রীয় হিমালয়ে অবস্থিত কেদারনাথের বিখ্যাত তীর্থস্থান এভাবেই হয়ে ওঠে ঠাকুরের আপন দেশ। সেই আপন দেশ বিগত কয়েক দশকে টলমলে! প্রাকৃতিক বিপর্যয় কতখানি বিধ্বংসী ঠারেঠারে বুঝিয়ে দিয়েছে দেবভূমি। মানুষ তো ভয়েই ভক্তি করে এসেছে। তুষ্ট করতে চেয়েছে ভয়কে। ভয়ের কাছে দু'হাত পেতে প্রার্থনা করেছে, আশীর্বাদ চেয়েছে। সেই আশীর্বাদের হাত বদলে গিয়েছে অভিশাপে। দেবভূমির মানুষের ধর্মীয় আস্থা বদলাচ্ছে দ্রুত!

চার ধাম যাত্রা ঘিরে প্রতিবারই উত্তর ভারতে হইচই পড়ে। চারটি দুর্গম পাহাড়ে যাওয়ার ধুম পড়ে দেবতার দর্শনে। প্রবল কষ্টকর সেই যাত্রায় যারা পা মেলান, এই বিশ্বাসেই মেলান যে জীবনের সমস্ত 'পাপ' এই কঠোর যাত্রায় ক্ষয়ে যাবে দেবতার শরণে যেতে গিয়ে। ২০,০০০ ফুট উচ্চতায় বরফে ঢাকা পাহাড়ে কেদারনাথ মন্দির এই চারটি প্রধান ধামের মধ্যে একটি। প্রলয়ের দেবতা শিব কেদারনাথের এক তৃণভূমির মাঝে শিলা হিসাবে উঠে এসেছেন নাকি। দীর্ঘকাল ধরে শিবলিঙ্গ পূজিত হচ্ছে এখানে। প্রায় ১২,০০০ ফুট উচ্চতায় একটি পাথরের মন্দির অন্তত এক হাজার বছর ধরে এই শিবলিঙ্গকে গর্ভে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

আরও পড়ুন- বৃষ্টিতে, মৃত্যুতে ভেসে যাচ্ছে হিমাচল! ভারতের পাহাড় কি ধ্বংসের মুখে?

ধর্মই এই অঞ্চলের যাপনের অংশ, জীবিকার অংশ। কিন্তু বিগত কয়েক দশকে জলবায়ু পরিবর্তন এই 'পবিত্র' স্থানগুলিকে আশঙ্কার মুখে ফেলেছে। সারা বিশ্বজুড়ে উষ্ণায়নের ফলে কেদারনাথের উপরে ২০,০০০ ফুট উচ্চতায় থাকা হিমবাহগুলি গলছে ভয়াবহ হারে। বিশ্বব্যাপীই গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের ফলে হিমবাহ গলছে একথা সত্য, কিন্তু ভারতীয় হিমালয়ের মতো উঁচু পাহাড়ি এলাকায় উপ-ক্রান্তীয় হিমবাহগুলি কম অক্ষাংশের কারণে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। অনেক জলবায়ু বিজ্ঞানীই বিশ্বাস করেন, জলবায়ু পরিবর্তন হিমালয়কে বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় বেশি প্রভাবিত করছে। এই হিমবাহ গলতে গলতে পাহাড়ি হ্রদগুলিতে প্রচুর পরিমাণে জল বাড়াচ্ছে। জলের চাপ বৃদ্ধি ও হিমবাহের চাপ লাঘবের ফলে ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। হিমবাহ গলা জল ব্যাপক বাড়াতে হ্রদে বন্যার ঝুঁকি বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তন এখন এই অঞ্চলের নতুন এক ভয়ের জন্ম দিয়েছে যা ভক্তি নয় বাড়াচ্ছে অভিশাপের আরেক ভীতি। পাহাড়ের ধর্মীয় ধারণা এবং চর্চা বদলাচ্ছে।

উষ্ণায়নের ফলে এই উচ্চ পার্বত্য অঞ্চলে বাড়তে থাকা আরেকটি গুরুতর বিপদ হচ্ছে অতিবৃষ্টি। তুষার পাহাড়ের গায়ে লেগে থাকে এবং বৃষ্টিতে ধীরে ধীরে গলে যায়। বৃষ্টিতে গলা এই বরফ পাহাড়ের ঢালে বেয়ে নেমে আসে যার ফলে ভূমিক্ষয়, ভূমিধস এবং বন্যা দেখা দেয়। ২০১৩ সালে কেদারনাথের সেই মারাত্মক বিপর্যয় বুঝিয়ে দিয়েছিল অস্বাভাবিক বেশি বৃষ্টি এবং হিমবাহ গলা জলে হ্রদে বন্যা মারাত্মক হতে পারে।

হিমালয় গবেষকরা বলেছেন, ২০১৩ সালের জুন মানে কেদারনাথের কাছে ২৪ ঘণ্টায় এক ফুটেরও বেশি বৃষ্টি হয়েছে! এমন উচ্চতায় এই পরিমাণ বৃষ্টি আগে কখনও হয়নি। কেদারনাথের উপরে সমস্ত হ্রদই জলে ভরে গিয়েছিল। মন্দাকিনী নদী পাড় ভেঙে এগিয়ে আসে ফলে ভূমিধস এবং বিধ্বংসী বন্যা হয়। কেদারনাথের উপরে চোরাবাড়ি হিমবাহ গলা হ্রদকে আটকে রেখেছিল যে বাঁধ তা হঠাৎ ভেঙে পড়ে। ১৫ মিনিটের মধ্যে, হ্রদের সব জল তিন তলা বাড়িকে ডুবিয়ে ধেয়ে যায়।

৩০ ফুটের এক আয়তাকার পাথর পাহাড়ের নিচে গড়িয়ে পড়ে এবং প্রাচীন মন্দিরের ঠিক আগে আটকে যায়, প্রবল জলের তোড়কে বিভক্ত করে এবং মন্দিরটিকে বাঁচায়। কেদারনাথ শহরের অন্য সব বাড়িই এখন ভেঙে ফেলা হয়েছে। সরকারি পরিসংখ্যান বলে, ওই ঘটনায় ৬,০০০ জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। যদিও উদ্ধার অভিযানের মানুষরা বলেছেন, সংখ্যাটি ঢের বেশি। নিহতদের অধিকাংশই ছিলেন তীর্থযাত্রী। কেদারনাথে ২০১৩ সালের বিপর্যয়ের পর থেকে চরধাম অঞ্চলে হড়পা বানে ৮০০ জনেরও বেশি মানুষ মারা গেছেন। ২০২২ সালেই মারাত্মক ভূমিধস এবং বন্যার কারণে কেদারনাথ তীর্থযাত্রা স্থগিত করা হয়। অতিরিক্ত বাড়িঘর, জনাকীর্ণ রাস্তা এবং দূষণকারী যানবাহন দুর্বল জমিতে আরও চাপ বাড়িয়েছে, মানুষ বাড়িয়েছে প্লাস্টিক।

আরও পড়ুন- ভয়াবহ বন্যায় অস্তিত্বের সঙ্কটে তাজমহল, ৪৫ বছরে প্রথম সৌধ ছুঁল যমুনার জল

সুতরাং যে ভক্তি নিয়ে ভক্তরা এসেছিলেন শিবের চরণে, তারা প্রসাদ হিসেবে পেলেন মৃত্যু। গণমৃত্যুতে 'পাপ' কম না বেশি তাতে কিছু এসে যায় না। সবার পরিণতিই এক হয়। হয়েওছে। আর এই ধ্বংসাত্মক বন্যাই মানুষের ধর্মীয় আস্থা বদলে দিয়েছে। এই অঞ্চলের মানুষরা বুঝছেন, ঘটনা পরম্পরা দ্রুত বদলাচ্ছে। মানুষ বুঝছেন, আশীর্বাদ চাইতে এলেও এখন মানুষ অভিশাপই পাবেন। কারণ মানুষের আচরণে দেবতারা ক্ষুব্ধ। সেই কারণেই কেদারনাথ বিপর্যয় এবং প্রতিবারের এই নানাবিধ মেঘভাঙা বন্যা, মৃত্যু। দেবভূমির দেবতারা এখন রেগে আছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে হিমালয় অঞ্চলে হিন্দুধর্মে বিশ্বাসীদের মধ্যে তাৎপর্যপূর্ণ ধর্মতাত্ত্বিক পরিবর্তন দেখা দিচ্ছে। দেবতারা আশীর্বাদ দেয় থেকে বদলে এখন দেবতারা শাস্তি দেয় ধারণাটিই পোক্ত। মানুষই দূষণ ঘটাচ্ছে যে কারণে, জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে। দেবভূমিকে দেবতাদের অযোগ্য করে তুলেছে মানুষই। তাই আর ক্ষমা নয়, দেবতারা শাস্তি দিতে শুরু করেছেন, বলছেন স্থানীয়রাই।

স্থানীয় বিশ্বাসী মানুষরা আবার আদিতে ফিরছেন। বলছেন, দেবতারাই প্রকৃতি। তাই মানুষ যখন প্রকৃতিকে অসম্মান করছে, আদতে তারা দেবতাদেরই অসম্মান করে। এ কারণেই ধ্বংসলীলা বাড়ছে। এককালে বৃষ্টি, বজ্রপাত, আগুনে ভয় পেয়েই তো শুরু হয়েছিল আরাধনা। সেই ভয় কমেছে মানুষের। ক্ষমতায় দেবতাদের (পড়ুন প্রকৃতিকে) হারানোর নানা পন্থাও মানুষের হস্তগত। ভয় এবং 'পাপ'-এর ধারণা বদলে গিয়েছে। তবে বিশ্বাসে মেলায় অনেকেরই। কীভাবে দেবতাদের (প্রকৃতিকে) সন্তুষ্ট করা যায় এবং অবস্থা বদলানো যায় এই প্রশ্নে বিশ্বাসীরা বলছেন, আবারও জমি এবং প্রকৃতিকে সম্মান করতে হবে। প্রকৃতির সঙ্গে ভালো আচরণই এক এবং একমাত্র সমাধান। এই পাহাড়ি এলাকার বিশ্বাসী মানুষদের কাছে দেবতা এবং ভূমি একই। কেদারনাথের বন্যা আসলে দুরন্ত শিশুকে আলতো থাপ্পড় মেরে সতর্ক করার মতো, বলছেন তাঁরাই। এখনও সতর্ক না হলে সবটাই শেষ হবে।

More Articles