আদৌ ভারতে জন্ম নয় ইডলির! কীভাবে দক্ষিণ ভারতীয় খাবার হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠল এই পদ?

The origin of Idli : দক্ষিণ ভারতীয় খাবার হিসেবেই জানেন ইডলিকে, জন্ম রহস্য তো বলছে অন্য কথা! কীভাবে এ দেশে ছড়িয়ে পড়ল এই পদ?

হরদম কোলাহল, ব্যস্ত অফিস পাড়া, আর টিফিন টাইম, এই তিনটের সঙ্গেই মিলে যায় কিছু জনপ্রিয় খাবারের অনুষঙ্গ। ভরপেট মধ্যাহ্ন ভোজন সেরে আবার অফিসের কাজে ফেরা, আর এর মাঝেই ভিড় জমে রাস্তার ধারের ঘুমটি দোকানগুলোতে। ঝাঁ চকচকে রেস্তোরাঁর সঙ্গে অবশ্য মেলে না এই ছবিটা, এখানে একটা প্যাচপ্যাচে স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধ আছে, জমাটি আড্ডা আছে, প্রচণ্ড ব্যস্ততা আছে, আর তারই মাঝে সবথেকে বেশি করে জমিয়ে যেটা আছে সেটা হল পরিচিত কিছু খাবারের গন্ধ। একটা সময় পর্যন্ত কেবল বাঙালি খাবার অথবা কিছু শুকনো খাবার এই ছিল কলকাতার অফিস পাড়াগুলির তালিকায়। পরে অবশ্য সময় এবং চাহিদার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে বদলে যায় সেই রেওয়াজ। আর সেই বদলে যাওয়া সময়ের হাত ধরেই মাছে ভাতে বাঙালির খাদ্য তালিকায় ঢুকে পড়ে ইডলি, ধোসা, বড়া, সম্বর ইত্যাদি।

আজ থেকে বছর দশেক আগেও বাংলায় সেভাবে জনপ্রিয়তা পায়নি ইডলি। তবে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে কলকাতা তথা পার্শ্ববর্তী এলাকার জনপ্রিয় স্ট্রিট ফুডের মধ্যে পড়ে এটি। ব্যস্ত শহরের মোড়ে মোড়ে দেখা মেলে ইডলির দোকান। স্টিলের বড় একটা ক্যানের মধ্যে আগে থেকেই তৈরি করা থাকে ইডলি। শহরতলীর কিছু জায়গায় আবার সাইকেলে করে ফেরি করতেও দেখা যায় এই খাবারটি। যদি কখনও ঘাটশিলার দিকে বেড়াতে যান, দেখতে পাবেন ওখানে বাসিন্দা থেকে শুরু করে পর্যটক সকলেরই পছন্দের তালিকায় সবার আগে আসে এই ইডলি।

আরও পড়ুন -সঙ্গে তড়কা অথবা সামান্য আচার, ব্যাস! জানেন কীভাবে ভারতে জনপ্রিয় হয়ে উঠল তন্দুরি রুটি?

দেখতে সাদা রঙের এক প্রকার পিঠের মতো, ভাপিয়ে রান্না করা হয় এই পদ। আর পরিবেশন করা হয় দারুণ স্বাদের কারিপাতা, নারকেল এবং ছোলার ডালের চাটনি সহযোগে। খান কয়েক খেলেই পেটচুক্তি আহার। তার ওপর আবার এক্কেবারে ওয়েল ফ্রি! ফলে স্বাস্থ্যের দিকেও যথেষ্ট খেয়াল রাখে এই জনপ্রিয় পদটি। শুধু রাস্তার ধারের ছোটখাটো দোকানই নয়, পাশাপাশি আজকাল শহরের বিভিন্ন প্রান্তেই গজিয়ে উঠেছে বেশ কিছু নামজাদা রেস্তোরাঁ, যেখানে মেনুতে রয়েছে ইডলি। সময়ের সঙ্গে মানুষের মধ্যে ক্রমেই জনপ্রিয়তা বেড়েছে এই পদটির।

বাংলায় জনপ্রিয়তা পেলেও এই পদ যে বাংলার নয় সে কথা অবশ্য কম বেশি সকলেই জানেন। দক্ষিণ ভারতীয় খাবার হিসেবেই চেনেন একে, কিন্তু জানেন কি বাংলা তো নয় এমনকী ভারতের দক্ষিণ প্রান্তেও জন্ম নয় এই পদটির। বাস্তবে দক্ষিণ ভারতীয় খাবার হিসেবে পরিচিত ইডলি আসলে ভারতীয়ই নয়! কথাটা শুনে হয়তো অবাক হচ্ছেন ঠিকই, তবে এটাই সত্যি। এর পিছনে রয়েছে প্রাচীন এক ইতিহাস। আসুন জেনে নেওয়া যাক কবে কোথায় কীভাবে তৈরি হয়েছিল হালফিলের ইডলি, কীভাবেই বা ভারতে ঢুকে পড়ে এত জনপ্রিয়তা পেল এটি?

কর্ণাটকের একজন বিখ্যাত খাদ্য বিশারদ, পুষ্টিবিদ এবং খাদ্য ইতিহাসবিদ কে. টি আচার্যের মতে, ইডলির উৎপত্তি বর্তমান ইন্দোনেশিয়ায়। সময়টা ওই ৭০০ থেকে ১২০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে। ওই অঞ্চলে এই পদটি ‘কেডলি’ বা ‘কেদারি’ নামে পরিচিত ছিল। পাশাপাশি এও জানা যায়, এই সময়ে ইন্দোনেশিয়া শাসন করেছিলেন বেশ কিছু হিন্দু রাজা। তাঁরাই ছুটির দিনে তাঁদের আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করতে বা নিজের জন্য পাত্রী খুঁজতে ভারতে আসতেন, আর সেই সময়ে তাঁদের সঙ্গে করে নিয়ে আসতেন ও দেশের রাজকীয় শেফদেরও। আর সেই শেফদের হতেই প্রথম ভারতে এসেছিল এই কেদারি বা কেডলি নামক পদটি। সুতরাং, ইন্দোনেশিয়ান রাজপরিবারের রান্নাঘর থেকে সেখানকার দেশীয় রাঁধুনিরা এটি ভারতে নিয়ে আসেন, এমনটাই বিশ্বাস করেন খাদ্য ইতিহাসবিদরা। পরে সময়ের সঙ্গে অভিযোজিত হয়ে ‘কেডলি’ পদটি এ দেশে পরিচিতি লাভ করে ‘ইডলি’ নামে।

ভিন্ন আরেকটি মত অনুসারে, ৯২০ খ্রিষ্টাব্দেই কন্নড় গ্রন্থে 'ইড্ডালিজ' এই শব্দটি ব্যবহৃত করা হয়েছে। তাই এই শব্দটি ইঙ্গিত দেয় যে, সে যুগেও এই পদের প্রচলন ছিল। এমনকী ১১৩০ খ্রিস্টাব্দের সংস্কৃত মনসোল্লা-তে ‘ইদ্দারিকা’ নামের উরদ ডালের তৈরি একটি পদের উল্লেখ ছিল।

এছাড়াও ইডলির উৎস সন্ধানে উঠে আসে আরও একটি তথ্য। যাতে বলা হয়, ঐতিহাসিকভাবে এই পদ আরবদের সাথেও যুক্ত। ‘এনসাইক্লোপিডিয়া অফ ফুড হিস্ট্রি’ এবং ‘সিড টু সিভিলাইজেশন - দ্য স্টোরি অফ ফুড’ নামে বই দুটিতে বলা হয়েছে যে, ভারতে বসতি স্থাপনকারী আরবরা স্থানীয় খাবার হালাল না হওয়ার ভয়ে ভাতকে বৃত্তাকার আকৃতি দিয়ে নারকেলের চাটনি দিয়ে খেতেন। এই সিদ্ধ চালের বলগুলি ছিল আকৃতিতে কিছুটা চ্যাপ্টা অর্থাৎ আজকের ইডলির মতো।

আরও পড়ুন - পিরামিডের যুগেও ছিল তন্দুরের চল, দেখতে কেমন ছিল প্রাচীন ভারতীয় চুলাগুলি?

আরব অথবা ইন্দোনেশিয়া, যেখান থেকেই আসুক না কেন খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আদ্যোপান্ত ভারতীয় খাবার হয়ে উঠেছে এই ইডলি। উৎসস্থল ব্যতিরেকে বিচার করলে দক্ষিণ ভারতীয় খাবারের একটি অংশ হিসেবে যথার্থ স্থান দেওয়া যায় একে। ইডলির উল্লেখ রয়েছে বিভিন্ন প্রাচীন ভারতীয় গ্রন্থে, যার মধ্যে রয়েছে ৭ম শতাব্দীতে রচিত কন্নড় -এর “ভাদ্দারধনে” উল্লেখ্যযোগ্য, এই গ্রন্থটিতে ইডলি অর্থাৎ ‘ইদ্দালিজ’ -এর প্রস্তুতির বর্ণনা দেওয়া রয়েছে। এছাড়া দশম শতকের তামিল পাঠ্য “পেরিয়া পুরানাম”-এও এই খাবারটির উল্লেখ করা হয়েছিল, যা শৈব সাধুদের একটি দল ৬৩ জন নয়নারদের জীবন কাহিনী বর্ণনা করে। এছাড়া আরও একটি ভিন্ন মত অনুযায়ী, গজনি মহম্মদ দশম শতাব্দীতে সোমনাথ মন্দির আক্রমণ করার পর, সৌরাষ্ট্রীয় বণিকরা দক্ষিণ ভারতে চলে আসেন। তাঁরাই সঙ্গে করে নিয়ে আসেন জনপ্রিয় ইডলির রেসিপি। ‘ইডলি’ নামটি করেন তাঁরাই।

তবে উৎপত্তি যাই হোক না কেন, নিঃসন্দেহে বর্তমানে এটি সবচেয়ে জনপ্রিয় ভারতীয় খাবারের মধ্যে একটি। দক্ষিণ ভারত থেকে ক্রমেই সেটি ছড়িয়ে পড়ে ভারতের অন্যত্র। বর্তমানে ডায়েট ফুড হিসেবেও নাম আসে ইডলির। শুধু তাই নয়, চিরাচরিত ডাল চালের ব্যবহার বদলে ভিন্ন ফিউশন এসেছে এই রান্নায়। সময় এগিয়েছে, বদলেছে খাবার তৈরির প্রক্রিয়াও, কেবল বদলায়নি এই স্বাদের মাহাত্ম্য।

More Articles