সত্যি বললেই বন্দি! ভারতে জেলে পচছেন কত সাংবাদিক, শিউরে উঠতে হবে যে তথ্যে
Indian Journalists in Jail: ২০২১ সালে সারা পৃথিবীতে জেলবন্দি ছিলেন ৪৮৮ জন সাংবাদিক। এই সংখ্যাটা ২০২২ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৩৩ জনে।
সত্য উদঘাটনই নাকি সাংবাদিকতার গৌরব! বাস্তব কী বলছে? সারা পৃথিবীজুড়ে উগ্র দক্ষিণপন্থার বিস্তার ঘটছে। সমাজ ব্যবস্থা পৃথিবীর নানা দেশেই বিপন্ন। পুরনো ধ্যানধারণা কুসংস্কারের চেহারা নিয়েছে। শাসকপক্ষ মানুষের উপর জোর করে চাপিয়ে দিচ্ছে নানা অনৈতিক ফরমান। এসবের মাঝে সাংবাদিকরা পেশাগত দায়বদ্ধতা পালন করতে পারছেন আদৌ? শাসকের চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করে খবর করতে গিয়ে আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকেই। সাংবাদিকদের ধরে জেলে পুরছে রাষ্ট্র। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর জেলকুঠুরিতে বন্দি থাকতে হচ্ছে সত্য খোঁজার অপরাধে, তাও একরকম বিনা বিচারেই। পৃথিবীর যে দেশগুলিতে সাংবাদিকরা নিপীড়নের শিকার সেই দেশগুলির তালিকায় অন্যতম এই দেশও। ৬ জন জেলবন্দি এবং একজন গৃহবন্দি মিলিয়ে মোট সাতজন সাংবাদিকদের নামের তালিকা প্রকাশ করেছে দু'টি আন্তর্জাতিক সংস্থা। একটি সংস্থার নাম রিপোর্টার্স উইদাউট জার্নালিস্ট। আর একটি সংস্থার নাম কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্ট।
ভারতে যে সাংবাদিকরা জেলবন্দি তাঁদের বিরুদ্ধে সরকার মামলা দায়ের করেছে সন্ত্রাসী কাজকর্মের। এরপর যথারীতি জেলে পোরা হয়েছে। ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক গৌতম নওলাখার মতো বিশিষ্ট সমাজকর্মী জেলে থাকাকালীন ওষুধের ব্যবস্থা পর্যন্ত করা হয়নি। বহু টালবাহানার পরে বর্তমানে তিনি গৃহবন্দি। বাকি ছয় সাংবাদিক দেশের বিভিন্ন জেলে বন্দিজীবন কাটাচ্ছেন। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি সাংবাদিকদের জেলে পোরার ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছে। আন্তর্জাতিক মহলেও নিন্দিত ভারত সরকার। তাও কেন্দ্রীয় সরকারের কোনও হেলদোল নেই।
আরও পড়ুন- হিজড়েরা আসলে হিজড়েই নন! ভয়ানক মাফিয়াচক্রের যোগ তুলে ধরছে লোম খাড়া করা সত্য
এছাড়া যে ছ'জন ভারতীয় নাগরিক দেশের বিভিন্ন জেলগুলিতে বন্দিজীবন কাটাচ্ছেন তাঁদের নাম আসিফ সুলতান, সিদ্দিকী কাপ্পান, মানান ডার, সাজাদ গুল, ফাহাদ শাহ এবং রূপেশ কুমার সিং। কাশ্মীর পাবলিক সেফটি অ্যাক্ট এবং আন-লফুল অ্যাকটিভিস প্রিভেনশন অ্যাক্ট অনুযায়ী এঁদের জেলে পোরা হয়েছে। সারা দেশে যে সাতজন সাংবাদিক জেলবন্দি তাঁদের মধ্যে তিনজন সাংবাদিক এক বছরের বেশি সময় ধরে বন্দিজীবন কাটাচ্ছেন। কেউ কেউ আবার জেলবন্দি দু'বছরের বেশি সময় থেকে শুরু করে চার বছরের বেশি সময় পর্যন্ত।
যেমন, কাশ্মীর ন্যারেটর্সের সাংবাদিক আসিফ সুলতানা। ২০১৮ সালের ২৭ অগাস্ট থেকে জেলবন্দি। ইউএপিএ আইনে গ্রেফতার করা হয় আসিফকে। এরপর আদালত জামিন দিলেও তাঁকে ছাড়া হয়নি। ফের গ্রেফতার করা হয়েছে কাশ্মীর পাবলিক সেফটি অ্যাক্টে। মালায়ালম সাংবাদিক সিদ্দিকী কাপ্পান ২০২০ সালের ৫ অক্টেবর গ্রেফতারের পরে গত ২ বছর ২ মাস ধরে জেলবন্দি। সমাজকর্মী তথা ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক গৌতম নাভলাখাকে ২০২০ সালের ১৪ এপ্রিল পুলিশ গ্রেফতার করে। এরপর টানা ২ বছর ২ মাস জেলে ছিলেন। বর্তমানে গৃহবন্দি তিনি। মানান ডার সন্ত্রাসবাদী ষড়যন্ত্র মামলায় ১ বছর ২মাস গৃহবন্দি ছিলেন। ২০২১ সালের ১০ অক্টোবর গ্রেফতার হন তিনি। সন্ত্রাসী ষড়যন্ত্রমূলক জম্মু কাশ্মীর থেকে গ্রেফতার করা হয় তাঁকে।
কাশ্মীর ওয়ালার সাংবাদিক সাজাদ গুল প্রতিবাদ সমাবেশের একটি টুইট করার অপরাধে চলতি বছরের জানুয়ারি মাস থেকে জেলবন্দি। প্রতিবাদ সমাবেশের একটি ভিডিও টুইট করার দায়ে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। কাশ্মীর পাবলিক সেফটি আইনে তাঁকে জেলে পোরা হয়েছে। এছাড়া ভুয়ো খবর ছড়ানোর অভিযোগ এনে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ফাহাদ শাহকে গ্রেফতার করা হয়েছে। রূপেশ কুমার সিং ঝাড়খণ্ডের বাসিন্দা, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক। ২০২২ সালে তাঁকে ইউএপিএফ আইনে গ্রেফতার করা হয়েছে।
কেবল ভারতই নয়, দুনিয়ার অন্য কিছু দেশেও সাংবাদিকতা এখন বিপজ্জনক পেশা। খুব সম্প্রতি এই সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে রিপোর্টার্স উইদাউদ বডার্স। এই সংস্থার সদর দফতর ফ্রান্সে। এই সংস্থা সম্প্রতি যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে তাতে বলা হয়েছে, ২০২১ সালে সারা পৃথিবীতে জেলবন্দি ছিলেন ৪৮৮ জন সাংবাদিক। এই সংখ্যাটা ২০২২ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৩৩ জনে। সারা দুনিয়ায় যে সাংবাদিকরা জেল কুঠুরিতে পচে মরছেন এর ভিতর অৰ্ধেক সংখ্যক জেলবন্দি সাংবাদিক চিন, মায়ানমার, ইরান, ভিয়েতনাম ও বেলারুশের বাসিন্দা। চিনে ১১০ জন সাংবাদিক জেলবন্দি। এছাড়া মায়ানমারে ৬২ জন, ইরানে ৪৭ জন, ভিয়েতনামে ৩৯ জন এবং বেলারুশে ৩১ জন সাংবাদিক জেল কুঠুরিতে পচছেন।
আরও পড়ুন- নোবেল শান্তিপুরস্কার জয় করলেন দুই সাংবাদিক
ভারতের মতো এই দেশগুলিতেও জেলবন্দি সাংবাদিকরা কবে ছাড়া পাবেন তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। প্রসঙ্গত, রিপোটার্স উইদাউট বডার্স সাংবাদিকদের উপর চলা নির্যাতন সম্পর্কে রিপোর্ট প্রকাশ করছে ১৯৯৫ সাল থেকেই। রিপোটার্স উইদাউট বডার্স আরও জানাচ্ছে, গত বছরের তুলনায় চলতি বছরে জেলবন্দি মহিলা সাংবাদিকের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। ২০২১ সালে জেলবন্দি করা হয়েছে ৬০ জন মহিলা সাংবাদিককে। ২০২২ সালে সেই সংখ্যাটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৮ জনে।
তবে কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস নামে যে মার্কিন সংস্থা ২০২২ সালের ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত জেলবন্দি সাংবাদিকদের সম্পর্কে যে খতিয়ান পেশ করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে, এখন গোটা দুনিয়ায় জেলবন্দি সাংবাদিকের সংখ্যা ৩৬৩ জন। কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্ট জানিয়েছে, ইরানে সরকারি হিজাববিধি অমান্য করার দায়ে ২২ বছরের কুর্দিশ তরুণী মাহশা আমিনির পুলিশি হেফাজতে মৃত্যুর পরে সেদেশে তীব্র নাগরিক আন্দোলনের খবরাখবর করতে গিয়ে গ্রেফতার হচ্ছেন সাংবাদিকরা। এঁদের মধ্যে আবার একটা বড় অংশই মহিলা। ইরান জুড়ে নাগরিক আন্দোলন শুরুর পরে গ্রেফতার হয়েছেন মোট ৪৯ জন সাংবাদিক। ধৃত সাংবাদিকের মধ্যে ২২ জনই মহিলা।
গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভের উপর সারা দুনিয়াজুড়ে যে আক্রমণ নামিয়ে আনা হচ্ছে, তাতে আদতে ঘোর বিপদে গোটা মানবজাতিই। শাসকের পিঠচাপড়ানির উল্টোপিঠে দাঁড়িয়ে যে সাংবাদিকরাই সত্য প্রকাশের কাজে নামেন, পৃথিবীর নানা দেশের স্বৈরাচারী সরকার, এমনকী ভারতও তাঁদের নেক নজরে দেখে না, দেখেনি। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে সাংবাদিক খুনের ঘটনাও। গত ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করার পরে খুন হয়েছেন বেশ কিছু সাংবাদিক।ইউক্রেনে যুদ্ধের খবরাখবর করতে গিয়ে মারা গিয়েছেন এ পর্যন্ত মোট ৮ জন সাংবাদিক। একটা খাদের ধারে দাঁড়িয়ে আছে বিপন্ন সত্য, দাঁড়িয়ে আছেন সাংবাদিকরাও।