রাতের আকাশে সেই রহস্যময় আলো! কেন তড়িঘড়ি এত বড় পরীক্ষা করল ভারত?
Agni-V Intercontinental Ballistic Missile: ৫,৪০০ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত আঘাত হানতে সক্ষম এই মিসাইল। আর এই মিসাইলের ক্ষমতা স্থলের মধ্যেই পড়ছে চিনের রাজধানী বেজিং।
শহর কলকাতা যখন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের আমেজে ডুবে, সেই সময় অর্থাৎ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এক অদ্ভুত আলো দেখা যায় কলকাতা থেকে শুরু করে রাজ্যের বিভিন্ন জেলার আকাশে। সন্ধে ৫ টা ৫০ মিনিট থেকে শুরু করে সন্ধে ৬টা পর্যন্ত এই আলো দেখা গিয়েছিল। আর এই নিয়ে রীতিমতো শোরগোল পড়ে যায় বিভিন্ন মহলে। এরপরে অনেকেই বিভিন্ন ধরনের ধারণা করে বসেন। অনেকে ভিনগ্রহের কোন জীবের পৃথিবীতে পা রাখার তত্ত্ব সাজিয়ে ফেলেছিলেন। তবে আসলে এই আলো এসেছিল ভারতের নতুন পরমাণু অস্ত্র বহনে সক্ষম একটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণ থেকে। এই মিসাইলটির আসল নাম অগ্নি ৫ এবং ওড়িশার আব্দুল কালাম আজাদ আইল্যান্ড থেকে এই ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল। এর ফলে রাতের অন্ধকার আকাশে দেখা গিয়েছিল এই বিশেষ আলো।
পরমাণু অস্ত্র বহনে সক্ষম এই অগ্নি ৫ মিসাইলকে নিয়ে এই মুহূর্তে বেশ আশাবাদী ভারত সরকার। এই মিসাইলের পাল্লা ৫,৪০০ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে। দেশের নিরাপত্তা মন্ত্রক জানিয়েছে, রাতের আকাশে পরীক্ষামূলকভাবে উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল অগ্নি ৫ ব্যালিস্টিক মিসাইলের। কিন্তু কেন হঠাৎ এই মিসাইলের পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণ করতে হলো ভারত সরকারকে? এর উত্তর যদিও লুকিয়ে ভারত চিন সম্পর্কের মধ্যে।
এই মুহূর্তে অরুণাচল প্রদেশের তাওয়াং অঞ্চলে ভারত চিন সংঘর্ষের কারণে এলাকাটি বেশ উত্তপ্ত। সংঘর্ষের কয়েক দিনের মধ্যেই এই পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণ নিয়ে শুরু হয়েছে দুই দেশের মধ্যেই কৌতূহল। আন্তঃমহাদেশীয় এই ব্যালেস্টিক মিসাইলের ক্ষমতা বিশাল। ৫,৪০০ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত আঘাত হানতে সক্ষম এই মিসাইল। আর এই মিসাইলের ক্ষমতা স্থলের মধ্যেই পড়ছে চিনের রাজধানী বেজিং। তাই নতুন উত্তেজনার মাঝে পরমাণু অস্ত্র বহনে সক্ষম ব্যালেস্টিক মিসাইলের পরীক্ষায় কোথাও কি চিনকে বার্তা দিতে চাইছে ভারত? ইতিমধ্যেই রাজনৈতিক মহলে এই প্রশ্ন ঘোরাফেরা করতে শুরু করেছে।
২০১৩ সাল থেকে এই নিয়ে নয় বার অগ্নি ৫ মিসাইলে পরীক্ষা করেছে ভারত। চিনের সঙ্গে অরুণাচল প্রদেশের সংঘাতের আবহে এই ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা অবশ্যই ভারতের শক্তি প্রদর্শন বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। সরকার সূত্রে এখনও পর্যন্ত শুধুমাত্র ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার তত্ত্ব সামনে নিয়ে আসা হলেও, এই পরীক্ষার কারণ যে একেবারেই সহজ সেটা কিন্তু বলা যায় না।
আরও পড়ুন- বাংলার আকাশে অজানা আলো! অবশেষে সামনে এল আসল রহস্য
চিনকে অগ্নি সতর্কতা
দূরপাল্লার শক্তিশালী এই ব্যলাস্টিক মিসাইল যদি সরাসরি ভারত থেকে উৎক্ষেপণ করা হয় তাহলে সোজা চিনের উত্তর ভূখণ্ড পর্যন্ত আঘাত করতে পারে। এই মিসাইলটির পক্ষে সরাসরি বেজিংকে নিশানা করা অত্যন্ত সহজ। ৫৪০০ কিলোমিটার দূরে থাকা লক্ষ্যবস্তুকে মুহূর্তের মধ্যে ধ্বংস করার ক্ষমতা রয়েছে এই ব্যালাস্টিক মিসাইলের। ১ টন অর্থাৎ এক হাজার কিলোগ্রামের বেশি নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড বহন করতে পারে এই মিসাইল। ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন ওরফে ডিআরডিও এই মিসাইলটি তৈরি করেছে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রক সূত্রের খবর তিনটি সেনাবাহিনীতেই এই বিশেষ মিসাইল ব্যবহার করা হবে।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রক সূত্রের খবর, অন্তর্মহাদেশীয় এই ব্যালাস্টিক মিসাইল বা ICMB-এর মাধ্যমে এশিয়ার যে কোনও জায়গাকে নিশানা করতে পারবে ভারতীয় সেনা। আরও ব্যাখ্যা করে বলতে গেলে, শুধুমাত্র চিনের দূরতম স্থান এই মিসাইলের রেঞ্জে চলে আসবে খুব সহজেই, এমনটাই নয়। শুধু এশিয়া নয়, ইউরোপের কিছু অংশে আঘাত হানতেও সক্ষম এই বিশেষ ক্ষেপণাস্ত্র। ভারতের হাতে যত ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে, তার মধ্যে সবথেকে বেশি রেঞ্জ অগ্নি ৫ মিসাইলের। এই মিসাইলে ব্যবহার করা হয়েছে একটি ত্রিস্তরীয় শক্তি ব্যবস্থা। প্রযুক্তির পরিভাষায় এর নাম থ্রি স্টেজ সলিড রকেট পাওয়ার। এই ক্ষেপণাস্ত্র দেড় টন পর্যন্ত নিউক্লিয়ার পরমাণু অস্ত্র বহনে সক্ষম।
কতটা চাপে লাল সেনা?
অগ্নি ৫ মিসাইলের পরীক্ষা কার্যত চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে চিনকে। সংবাদ সংস্থা সূত্রে খবর, বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ এপিজে আব্দুল কালাম আইল্যান্ড থেকে অগ্নি ৫ ক্ষেপণাস্ত্র সফলভাবে পরীক্ষা করা হয়েছে। ইতিমধ্যেই এই খবর ছড়িয়ে পড়েছে চিনে। ন্যূনতম প্রতিরোধে নীতি মেনেই অগ্নি ৫ মিসাইলের পরীক্ষা করা হয়েছিল। সামরিক বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, এই ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা রক্তচাপ বাড়িয়েছে বেজিংয়ের। চলতি মাসের শুরুতেই ভারত মহাসাগরে গুপ্তচর জাহাজ Yuan-Wang-5 পাঠিয়েছিল চিন। অনুমান করা হয়, ভারতের অগ্নি ৫ পরীক্ষার Notam জারি করার পর এই নজরদারি করতে চিন ওই গুপ্তচর জাহাজ পাঠিয়েছিল।
প্রসঙ্গত, চিনের কাছে কিন্তু অগ্নি ৫-এর থেকেও বেশি রেঞ্জের পরমাণু অস্ত্র বহনে সক্ষম মিসাইল রয়েছে। এই মিসাইলের পোশাকি নাম DONGFENG-41। এই মিসাইলের রেঞ্জ ১২ হাজার থেকে ১৫ হাজার কিলোমিটার। ভবিষ্যতে চিনের ওই মিসাইলের সমরেঞ্জের ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করা হবে বলে ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছে ডিআরডিও। উল্লেখ্য, ২০১২ সালে প্রথমবার অগ্নি ৫ মিসাইলের পরীক্ষা করেছিল ভারত। গত বছরের অক্টোবরেও এই মিসাইল পরীক্ষা করা হয়েছিল।
আরও পড়ুন- আজই প্রথম নয়, এর আগেও রহস্যময় আলো দেখেছে কলকাতার আকাশ
টার্গেটে এবার ৭ হাজার কিলোমিটার
চিনের রক্তচাপ বাড়িয়ে আরও বিধ্বংসী হয়ে উঠছে অগ্নি ৫ মিসাইল। সম্প্রতি এই ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা সাত হাজার কিলোমিটারের বেশি করতে পারা যাবে বলে দাবি করেছে ভারতের ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন। সরকার চাইলে সাত হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত পাল্লা তৈরি করতে পারে ডিআরডিও। যদি এটা করা যায় তাহলে ৭ হাজার কিলোমিটার দূরের টার্গেট ধ্বংসে সক্ষম হবে অগ্নি ৫ মিসাইল। সংবাদ সংস্থা সূত্রে খবর, অগ্নি ৫ মিসাইলে থাকা ইস্পাত প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে এবং এর ফলে অগ্নি ফাইভ মিসাইল এর ওজন ২০ শতাংশের বেশি কমানো সম্ভব হয়েছে।
ভারত - চিন তিক্ততা
১৯৬২ সালে ভারত এবং চিনের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম হয়েছিল অরুণাচল প্রদেশের মাটিকে কেন্দ্র করে। এই অংশটিকে বেজিং মাঝেমধ্যেই দাবি করে থাকে তিব্বতের অংশ হিসেবে। মাঝের কয়েক দশক সেভাবে কোনও বড় সমস্যা তৈরি না হলেও, বছর কয়েক আগে থেকে আবারও শিরোনামে উঠে এসেছে অরুণাচল প্রদেশ। ২০২০ সালে গালওয়ান প্রদেশে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছিল দুই দেশের সেনা। লোহার রড থেকে শুরু করে পেরেক পোঁতা লাঠি নিয়ে ভারতীয় সেনার উপর আক্রমণ শানিয়েছিল চিন সেনা। দেশের সীমান্ত অক্ষত রাখার পথে প্রাণ হারিয়েছিলেন একাধিক সেনা।
এর মাঝে ডোক লা'তেও ভারত এবং চিন সেনার মধ্যে তৈরি হয়েছিল দ্বন্দ্বের আবহ। কিছুদিন আগে অরুণাচল প্রদেশের তাওয়াংয়েও সংঘর্ষে জড়িয়ে ছিল দুই দেশের সেনা। সীমান্ত রেখা টপকে চিন সেনা ভারতে প্রবেশ করতে চাইলে প্রতিরোধ তৈরি করে ভারতীয় সেনা। এর আগে ২০২১ সালের অক্টোবর মাসেও একই এলাকায় সংঘর্ষ হয়েছিল চিন এবং ভারতের মধ্যে। সেই সময় সীমান্ত রেখা টপকে ভারতে প্রবেশ করেছিলেন চিন সেনারা। তবে সেবার এত মারাত্মক আকার নেয়নি সংঘর্ষ। তবে এবারের সংঘর্ষের মাত্রা ও তীব্রতা অনেকটাই বেশি। তাই এই পরিস্থিতিতে ভারতীয় সেনার এই অগ্নি ৫ মিসাইল পরীক্ষার বিষয়টিকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলেই দেখছে আন্তর্জাতিক মহল।