কোহিনুরের দ্বিগুণ বড় হিরে ছিল তাঁর দখলে! আম্বানি-আদানির বৈভব ম্লান করে দেবে এই ইতিহাস

তিনি যে শুধু অর্থবান বলেই পরিচিত ছিলেন, তা কিন্তু নয়। বহু জনকল্যাণমূলক কাজেও তিনি ছিলেন সর্বাগ্রে। তাঁর শাসনকালেই হায়দরাবাদে বিদ্যুৎ-ব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি হয়।

ভারতের 'রিচেস্ট ম্যান' বলতেই আমরা বুঝি টাটা, আম্বানি, বিড়লা। এঁদের নাম, সম্পত্তির পরিমাণ, কার ক’টা বাড়ি, গাড়ি, বিভিন্ন জিনিস- আমরা অল্পবিস্তর জেনেই গিয়েছি। এও শোনা যায়, মুকেশ আম্বানির স্ত্রী নিতা আম্বানির এক বোতল জলের দাম নাকি পঞ্চাশ লক্ষ টাকা, তবে তা সত্য না গুজব তা বলা মুশকিল। কিন্তু ভারতের ধনী ব্যক্তির কথা বলতে গেলে ইতিহাস অন্য কথা বলে। ইতিহাসের পাতা খুলে যদি ব্রিটিশ রাজ  বা তারও আগে যাওয়া যায়, তাহলে জানা যাবে, ভারতে বিশ্বের মধ্যে সবথেকে বেশি ধনসম্পদের ভান্ডার ছিল। রাজারাজড়াদের ছিল বাড়াবাড়ি রকমের অর্থ। এমন অনেক রাজা আর তাদের রাজ্য ছিল, যেখানে ইংরেজরা তাদের আঁচড় অবধি দিতে পারেনি। ভারতের বিপুল ধনসম্পদের হদিশ রামায়ণ-মহাভারতেও পাওয়া যায়।

অনেক ঐতিহাসিক ভারতের প্রাক-ঔপনিবেশিক অর্থনীতিকে সমৃদ্ধিপূর্ণ স্বর্ণযুগ বলে বর্ণনা করেন। সেই সময় ভারতের সম্পদের জন্য অনেক বহিরাগত ভারতে এসেছে এবং সেই রত্নভান্ডার লুটও করেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ভারতে এমন কিছু ধনী ব্যক্তি ছিলেন, যাদের সাথে যুদ্ধ, ট্র্যাজেডি এবং বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনিও জড়িত। অনুমান করা হয় যে, নিজামদের শাসনকালে ভারতের ধনসম্পদের পরিমাণ বিলিয়ন থেকে ট্রিলিয়নের দোরগোড়ায় ছিল। আর যাকে বিশ্বের সবথেকে ধনী ব্যক্তি বলা হয়, তিনি আর কেউ নন হায়দরাবাদের শেষ নিজাম মীর ওসমান আলি খান।

কে এই মীর ওসমান আলি খান?

মীর ওসমান আলি খানের জন্ম ১৮৮৬ সালের ৬ এপ্রিল। তাঁর বাবা মারা যাওয়ার পর তিনি ১৯১১ সালের ২৫ আগস্ট হায়দরাবাদের সিংহাসনে বসেন। তখন তাঁর বয়স ২৫। ১৯৪৮ সালে হায়দরাবাদ ভারতের অংশ হিসেবে যুক্ত হয়। তাঁর আগে পর্যন্ত তিনি দু'-দফায় হায়দরাবাদ শাসন করেছেন। 'টাইম' ম্যাগাজিন ১৯৩৭ সালে মীর ওসমান আলি খানকে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি হিসেবে উল্লেখ করেছিল। আবার ২০০৮ সালের 'ফোর্বস' ম্যাগাজিন প্রচ্ছদে এই নিজামকে বিশ্বের সর্বকালের সেরা ধনীদের মধ্যে পঞ্চম স্থান দিয়েছে। তার মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ২১০.৮ বিলিয়ন ডলার। 'ফরচুন' পত্রিকা চারের দশকে তাঁর সম্পত্তির মূল্য ধরে দুই বিলিয়ন ইউএস ডলার। বর্তমানে যার মূল্য দাঁড়াত কম করে ধরলেও প্রায় চার বিলিয়ন ইউএস ডলার। টাকার মূল্যে প্রায় ২৯,৭৪৫ কোটি টাকা। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি তো ছিলেনই, ১৯৩০ থেকে ১৯৫০ অবধি তাঁকে দক্ষিণ এশিয়ার ধনীতম ব্যক্তি হিসেবে ধরা হতো, ১৯৬৭ সালে তাঁর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত। সেই হিসেবে ওই সময়ের যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির ১ শতাংশের সমান সম্পদের মালিক ছিলেন নিজাম।

আরও পড়ুন: ইংল্যান্ডের রানি পরতে ভয় পান, কেন আজও বিতর্কিত তৈমুর রুবি?

১৯১১ সালে মীর ওসমান আলি যখন মসনদে বসতে শুরু করেন, তখন তাঁদের রাজকোষ প্রায় শূন্য বলা চলে। এর পিছনে অবশ্য ওসমান আলি খানের পিতা, অর্থাৎ, পূর্বতন নিজামের উশৃঙ্খল জীবনযাপনই দায়ী ছিল। তাই রাজকোষের এমন করুণ অবস্থার সৃষ্টি হয়। ওসমান আলি ক্ষমতা দখলের পর তিনি ধীরে ধীরে রাজকোষের উন্নতি ঘটাতে থাকেন। দিনে দিনে ফুলেফেঁপে উঠতে থাকে রাজকোষ। ৩৭ বছরের রাজত্বকালে ব্যক্তিগত সম্পদের পরিমাণও বৃদ্ধি পেতে থাকে।

এরপর প্রশ্ন আসে, কীভাবে এত ধনী হয়ে উঠেছিলেন হায়দরাবাদের শেষ নিজাম। এর কারণ নিয়ে অবশ্য মতান্তর আছে। তৎকালীন সময়ে হায়দরাবাদ ছিল বিশ্বের একমাত্র হীরা সরবরাহকারী এলাকা। এছাড়াও হায়দরাবাদের মোট আয়তন ছিল ৮৬,০০০ বর্গ মাইল (২,২৩,০০০ কি.মি.)। এই বিশাল রাজ্যের পুরোটা জুড়েই ছিল মীর ওসমান আলি খানের শাসন। এই রাজ্যটি ভারতের স্বাধীনতার আগে ব্রিটিশ-শাসিত রাজ্যগুলির মধ্যে ছিল বৃহত্তম।

তাঁকে ডাকা হতো হায়দরাবাদের নিজাম মহামান্য অধিপতি হিসেবে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, তাঁর ব্যক্তিগত রত্নাগারে সোনাদানা ছিল ৪০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি। এছাড়াও নিজামের রত্নাগারে ছিল একটি বড় হিরে, যেটির নাম- জ্যাকব ডায়মন্ড। যার ওজন আজকের দিনে ১৮৪.৭৫ ক্যারেট। শোনা যায়, তিনি এই জ্যাকব হিরে তাঁর অফিসে পেপারওয়েট হিসেবে ব্যবহার করতেন। তাঁর কাছে যত পরিমাণ মুক্তো ছিল, তাতে একটি অলিম্পিক সাইজের সুইমিংপুল ভর্তি হয়ে যেত। রানি এলিজাবেথের বিয়েতেও তিনি অঢেল অলংকার উপহার দিয়েছিলেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল একটি নেকলেস, যেটি ‘হায়দরাবাদের নিজামের নেকলেস’ নামে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পায়। পৃথিবীর সবচেয়ে দামি রোলস রয়েস তাঁর গ্যারেজে শোভা পেত।

বলা হয়, মীর ওসমান আলির কাছে থাকা জ্যাকব হিরেটি কোহিনুর হিরের দ্বিগুণ বড় এবং বিশ্বের সবথেকে বড় হিরের মধ্যে এই জ্যাকব হিরে ৭ম স্থানে আছে। ইতিহাস বলে, এই হিরে ১৮৯১ সালে ষষ্ঠ নিজাম মীর মেহবুব আলি পাশা এক ইহুদি ব্যবসায়ী এ. কে. জ্যাকবের কাছ থেকে কিনে নেন। তাঁর নামানুসারেই এই হিরের নাম। তবে এই হিরে সম্পর্কে কিছু অভিশপ্ত কাহিনিও নাকি শোনা যায়। লোকের অনুমান, যখন ষষ্ঠ নিজাম এই হিরেটি হাতে পান, তখন তাঁর মনে হয়েছিল, এই হিরে অভিশপ্ত। তাই তিনি একে এক কালো নোংরা কাপড়ে মুড়ে নিজের টেবিলের দেরাজে রেখে দেন। পরবর্তীকালে এই হিরে এক পুরনো জুতো থেকে উদ্ধার হয়। তবে লোকবিশ্বাস এটাও যে, ষষ্ঠ নিজামের এই হিরে নিয়ে অভিশপ্তের কাহিনি সত্যি ছিল কারণ ১৯৭২ সালে হওয়া এক আইনি লড়াইতে এই হিরে লড়াইয়ের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। যে লড়াই ৩০ বছর চলেছিল এবং মেহবুব আলি খানের প্রপৌত্র মুকাররম জাহর পতনেও অবদান রেখেছিল।

নিজাম বাহাদুর ভারতের জন্য এমন কিছু করেছেন, যা করার ক্ষমতা টাটা, বিড়লা, আম্বানিরও নেই। কী সেই ঘটনা? ১৯৬৫ সালে ভারতকে চোখ রাঙাচ্ছে চিন, সঙ্গে পাকিস্তানও যুক্ত। এমতাবস্থায় কী করা যায়, তা ভাবতে ভাবতে হায়দরাবাদের নিজামের কাছে এলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী। এসে সব ঘটনা খুলে বললেন, নিজাম সব শুনে মিটিমিটি হাসতে হাসতে সেক্রেটারিকে ডেকে একটি কাগজে উর্দুতে কী একটা লিখে দিলেন। ওই লেখা দেখে তো সেক্রেটারির অজ্ঞান হওয়ার যোগাড়। সামলে নিয়ে বললেন, হায়দ্রাবাদের নিজাম ভারতের সেনা তহবিলে সামান্য কিছু দান করলেন। মোটে পাঁচ টন সোনা। এটাও নাকি সামান্য! চমকে গেল বিশ্ব। সেখানেই শেষ নয়, দিলেন নগদ ৭৫ লক্ষ টাকা। ১৯৬৫ সালে ভারতের তহবিলে দেওয়া নিজামের ৫ টন সোনা ও ৭৫ লক্ষ টাকা দান হিসেবে দেওয়া সবথেকে বড় অর্থরাশি। 

তিনি যে শুধু অর্থবান বলেই পরিচিত ছিলেন, তা কিন্তু নয়। বহু জনকল্যাণমূলক কাজেও তিনি ছিলেন সর্বাগ্রে। তাঁর শাসনকালেই হায়দরাবাদে বিদ্যুৎ-ব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি হয়। রেলপথ, সড়কপথ ও বিমানপথেরও আমূল পরিবর্তন হয়। এছাড়াও অজস্র বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, ব্যাঙ্ক, এয়ারপোর্ট নির্মিত হয় তাঁর শাসনকালে। বন্যা প্রতিরোধের জন্য জলাধারও নির্মাণ করেন তিনি। তাঁর এসব কাজের জন্যে তাঁকে ‘আধুনিক হায়দরাবাদের স্থপতি’ হিসেবেও সম্মান করা হতো। তাঁর তৈরি করা ওসমানিয়া ইউনিভার্সিটি আজ ভারতের অন্যতম বৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয়।

আসাফ জাহ রাজবংশের সপ্তম এবং শেষ শাসক, মীর ওসমান আলি খান ১৯৬৭ সালে মারা যান, এবং সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বিশাল সম্পত্তি নিয়ে তাঁর ১৪৯ বংশধরের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। যখন এই বিরোধ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তখন ভারত সরকার পদক্ষেপ করতে বাধ্য হয়। তবে, নিজামের গয়না সংগ্রহের বেশিরভাগ অংশ ইতিমধ্যেই লুট হয়ে গিয়েছিল ধরা হয়। বলা হয়েছে যে, বৃদ্ধ নিজাম তাঁর গয়না সংগ্রহের কোনও অডিট করতে দেননি এবং তিনি এটাও নিশ্চিত করেছেন যে, তাঁর সংগ্রহে থাকা গয়নার ধুলো কখনও পরিষ্কার করা হয়নি, যাতে তাঁর গুপ্তধনের আলো কখনও কারও চোখে না পড়ে।

বর্তমানে, ভারত সরকার কিছু গয়না উদ্ধার করে, যার মূল্য ৫০০০ কোটি টাকা। এগুলি সমস্ত সোনার তৈরি, হিরে, উজ্জ্বল সবুজ পুঁতি এবং ক্যাবোচন রুবি দিয়ে সেট করা। ‘বচকানা সরপঞ্চ’ নামে একটি নেকলেস রয়েছে, যা যুবরাজ মেহবুব আলির জন্য তৈরি করা হয়েছিল, যখন তিনি সিংহাসনে আরোহণ করেন। এই গয়নাটিতে গোলকুন্ডা হীরার সৌন্দর্য অন্যান্য গয়নার সৌন্দর্যকেও ছাপিয়ে গেছে। সোনা দিয়ে তৈরি এই সেটে প্রতিটি পাশে ৫টি ছোট হিরে রয়েছে, এর শীর্ষে একটি সূক্ষ্ম পাখি রয়েছে, যার পালক এবং চোখ ছোট রুবি দিয়ে তৈরি। মজার বিষয় হল, এই পাখিটির ঠোঁটে একটি তাবিজ বা লাকি চার্মের মতো জিনিস রয়েছে। ফ্রান্সের হাউস অফ অস্কার ম্যাসি পিয়েরেস নিজামের জন্য একটি হিরের বেল্টও তৈরি করেছিলেন।

অনুমান করা হয় যে, তাঁর এই বিশাল সম্পদ লুকিয়ে রয়েছে কোঠি প্রাসাদে। নিজাম তাঁর এই প্রাসাদে জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন। সেই কোঠি প্রাসাদের কোনও এক গুপ্তকুঠুরিতেই সেই লুকোনো সম্পদ রয়েছে বলে অনেকের বিশ্বাস। তাঁর সম্পদগুলোর মধ্যে রয়েছে ১৭৩টি জমকালো রুবি, হিরে, প্রবাল, মুক্তো, নীলকান্তমণি দিয়ে তৈরি বিখ্যাত নিজাম জুয়েলারি, স্বর্ণ ও রূপা-যুক্ত বিভিন্ন দামি পাথর। আজও অনেকেই খুঁজে বেড়াচ্ছেন নিজামের সেই লুকোনো সম্পদ। মীর ওসমান আলি খান, শুধুমাত্র যে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ধনী ছিলেন, তা নয়। তিনি ছিলেন সমাজ-সংস্কারক, ন্যায়বিচারক ও একজন দক্ষ শাসকও। নানা ষড়যন্ত্রে বিপর্যস্ত হয়েও ক্ষমতা ছাড়ার আগে পর্যন্ত তাঁর শাসনকালে স্বস্তি পেয়েছিল হায়দরাবাদের স্থানীয় অধিবাসীরা। সেই হিসেবে এখনও তিনি জীবিত, তাঁর নানা কীর্তির মধ্য দিয়ে।

 

 

 

 

 

 

 

More Articles