কথা ছিল 'আশ্রম' হয়ে ওঠার, ত্রাসে পরিণত হল তিহার! কুখ্যাত যে ইতিহাস আজও অজানা
Tihar Jail Delhi : ৬৮ একর জমির উপর বিস্তৃত এই জেলের প্রতিটা ইটে লুকিয়ে রয়েছে এক একটি কাহিনি
সঞ্জয় গান্ধী, লালু প্রসাদ যাদব, আফজল গুরু, চার্লস শোভরাজ, আন্না হাজারে এবং অনুব্রত মণ্ডলের মধ্যে মিল কোথায় জানেন? এঁরা প্রত্যেকেই কোনও না কোনও কারণে তিহার জেলে রাত কাটিয়েছেন বা কাটাচ্ছেন। ‘তিহার’ নামটাই যথেষ্ট যে কোনও অপরাধীর বুকে কাঁপুনি ধরিয়ে দেওয়ার জন্য। এশিয়ার সবচেয়ে বড় কারাগার এই তিহার। ৬৮ একর জমির উপর বিস্তৃত এই জেলের প্রতিটি ইটে লুকিয়ে রয়েছে এক একটি কাহিনি; রঙ্গা-বিল্লার কাহিনি, কাশ্মীরি নেতা মকবুল ভাটের কাহিনি, ‘সাহারাশ্রী’ সুব্রত রায়ের কাহিনি। রয়েছে নাম না জানা অনেক অপরাধী এবং সেই অপরাধের কাহিনি।
১৯৫৮ সালের দিল্লির জনকপুরীর কাছে, তিহার নামক এক গ্রামে তৈরি হয় এই কারাগারটি। অবশ্য তিহার কর্তৃপক্ষের ভাষায়, কারাগার বা জেল নয়, এটি সংশোধনাগার। ১৯৫৮ সালে এই জেলটি প্রথমে পঞ্জাব সরকার এবং তারপর ১৯৬৬ সালে দিল্লি সরকারের অধীনে যায়। ত্রিস্তরীয় সুরক্ষা ব্যবস্থা, প্রায় ৩০০টি সিসিটিভি ক্যামেরা এবং আড়াই হাজার পুলিশ সম্বলিত তিহার জেল, ভারত তথা এশিয়ার সবচেয়ে কড়া এবং প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত কারাগার। ১২০০ কয়েদি নিয়ে জেলটি শুরু হলেও উত্তরোত্তর কয়েদির সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকারি হিসেব অনুযায়ী তিহার জেলের ধারণক্ষমতা ১১ হাজার। তা সত্ত্বেও বর্তমানে এই জেলের ভেতর বন্দি রয়েছেন অন্তত ১৮ হাজার কয়েদি। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, কতটা ‘ওভার ক্রাউডেড’ এই জেল। ১৯৮৪ সালে তিহার জেলের আমূল সংস্কার করা হয়। নতুন সেল এবং ব্লক গড়া হয় এই সময়। এই একই সময় তিহার সংশোধনাগারের ভেতর তৈরি হয় ‘তিহার ফ্যাক্টরি’। তিহার ফ্যাক্টরিতে জেলের কয়েদিদের তৈরি করা বিভিন্ন জিনিস, যেমন- আসবাবপত্র, ঘর সাজানোর জিনিস, কেক-বিস্কুট ইত্যাদি বিক্রি করা হয়।
তিহার জেলের বিপুল সংস্কার হয় কিরণ বেদির সময়কালে। ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত তিহার জেলের ডিজি ছিলেন কিরণ বেদি। এই সময় তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন তিহারের হাল পরিবর্তন করতে। তিহারকে আক্ষরিক অর্থেই কারাগার থেকে সংশোধনাগার করে তুলতে চেয়েছিলেন কিরণ। ভয় দেখিয়ে বা হুমকি দিয়ে নয়, কয়েদিরা যাতে নিজস্ব অনুশোচনার মাধ্যমে পরিবর্তিত হতে পারে সেই দিকেই জোর দিয়েছিলেন কিরণ। এক সাক্ষাৎকারে তিহার প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে কিরণ বেদি বলেছিলেন,
“তিহার সংস্কারে আমি একটি মডেলের উপর বিশেষ জোর দিয়েছিলাম, 3C মডেল। আমার মতে সব সংশোধনাগারেই এই মডেল প্রচলন করা উচিত। 3C অর্থাৎ - Collective, Corrective এবং Community।”
কিরণ বেদি যথার্থভাবেই একসূত্রে বাঁধতে পেরেছিলেন তিহারকে। তিহার জেলার ভেতর ধীরে ধীরে যোগ, মেডিটেশন প্রভৃতির চলন শুরু করা হয়। মূল লক্ষ্য ছিল যাতে কয়েদিরা নিজেদের অতীতের অন্ধকার দিনের কথা ভুলে আগামীর উজ্জ্বল সময়কে আপন করে নেয়। একই সঙ্গে তিহারের অত্যন্ত বড় সমস্যা ছিল ড্রাগ। কিরণ বেদির আমলে এই সমস্যা প্রায় নির্মূল হয়ে যায়। কোনও কয়েদি যেন বঞ্চনা বা হেনস্থার শিকার না হয় সেই দিকেও খেয়াল রেখেছিলেন কিরণ। তিনি জেলের বয়োজ্যেষ্ঠ বন্দিদের সঙ্গে কথা বলে জেলের মধ্যেই এক প্রকার পঞ্চায়েতি রাজ প্রতিষ্ঠা করেন। ‘তিহার কেন্দ্রীয় সংশোধনাগার’-কে প্রকৃতভাবেই ‘তিহার আশ্রম’-এ পরিণত করেছিলেন কিরণ বেদি।
আরও পড়ুন - ‘দাদা’দের ভাগ্যে বডি ম্যাসাজ, ‘দাগী’ হলে নারকীয় অত্যাচার! তিহারের জেলকুঠুরি যেমন…
এত উন্নয়ন, এত আশার আলো- এগুলি তিহারের একটি দিক মাত্র। মুদ্রার দু'টি পিঠের মতোই, তিহারেরও দু'টি ভিন্ন দিক আছে। সেই অন্য পিঠটি অত্যন্ত অন্ধকার, কুৎসিত এবং ভয়ঙ্কর। ১৯৯৫ সালে তিহার থেকে বদলি হয়ে অন্যত্র চলে যান কিরণ বেদি। তাঁর তৈরি নিয়ম কয়েকদিন চললেও, ফের নিজের আগের অবস্থায় ফিরে যায় তিহার। প্রভাবশালী অপরাধীদের দৌলতে জেলের ভিতরেই গজিয়ে উঠতে শুরু করে বিভিন্ন ‘গ্যাং’। বিগত কয়েক বছরে বারবার খবরের শিরোনামে এসেছে তিহার- কখনও নির্ভয়া কাণ্ডে অভিযুক্ত আসামির দেহ উদ্ধার হচ্ছে, তো কখনও আবার ব্লেড চালিয়ে কারও গলার নলি কেটে দেওয়া হচ্ছে। ফের মাদকদ্রব্যের বাড়বাড়ন্ত দেখা যায় তিহারে। কয়েক বছর আগে, দুই কয়েদির মৃত্যু হয় অত্যধিক মাদকদ্রব্য সেবনের কারণে। এত কড়া নিরাপত্তার মধ্যে কীভাবে ড্রাগ ভেতরে গেল তার সদুত্তর দিতে পারেনি জেল কর্তৃপক্ষ। বিগত কয়েক বছর ধরে তিহারে নির্বিঘ্নে চলছে ক্ষমতা দখলের যুদ্ধ। অর্থ এবং পেশিশক্তির উপর ভিত্তি করে তিহারের ভেতরেই বেড়ে উঠেছে অপরাধের সাম্রাজ্য। প্রভাবশালী অপরাধীরা তুলনামূলকভাবে সাধারণ কয়েদিদের উপর জোর-জুলুম চালায়। সাধারণ কয়েদিদের বাড়ির লোকেদের হুমকি দিয়ে টাকা তোলে প্রভাবশালী অপরাধীরা। টাকা দিতে না পারলে, জেল থেকে প্রাণ নিয়ে বেরনো প্রায় অসম্ভব।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, এত নিরাপত্তার মধ্যেও নিরাপদ নন কেন কয়েদিরা? বলার অপেক্ষা রাখে না, এই অপরাধীদের বাড়বাড়ন্তের পিছনে জেল কর্তৃপক্ষের প্রচ্ছন্ন মদত রয়েছে। তিহারে নিচু তলার অনেক কর্মচারীই দুর্নীতিগ্রস্ত, এই বিষয়টির সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে অপরাধীরা। এদের মাধ্যমেই কয়েদিদের হাতে পৌঁছে যায় ছুরি, ব্লেড, মোবাইল ফোন, সিম কার্ড, ড্রাগ প্রভৃতি। জেল কর্তৃপক্ষের দুর্নীতি এবং উদাসীনতার পাশাপাশি রয়েছে রাজনৈতিক চাপও। তিহারের প্রাক্তন এক মহিলা কয়েদি জানিয়েছিলেন -
“আমি তিন বছরের জন্য তিহার জেলে বন্দি ছিলাম। ড্রাগস পাচারের অপরাধে আমার তিন বছরের শাস্তি হয়। আমি তখন সদ্য কুড়িতে পা দিয়েছি। ওখানে গিয়ে বুঝলাম কেন তিহারকে নরক বলা হয়। আমার মতো অল্পবয়সি একজন মেয়ের পক্ষে তিহারে টিকে থাকা খুব মুশকিল ছিল। বয়সে সবচেয়ে ছোট হওয়ায় আমায় দিয়ে প্রতিদিন বাথরুম পরিষ্কার করানো হতো এবং সবার শেষে স্নান করতে যেতে দেওয়া হতো। জলের সমস্যা তিহারে নতুন কিছু নয়। ফলত অধিকাংশ দিনই আমায় স্নান না করেই থাকতে হতো। আমাদের সঙ্গেই আরেকটি মেয়ে এসেছিল। কোনও কারণে তার এক বছরের শাস্তি হয়। অত্যন্ত ধনী ঘরের মেয়ে ছিল সে, যথারীতি পরিবারের তরফে বেশ কিছু ডোনেশন দেওয়া হয় তিহারে। ফলত সহজেই সে ভিআইপি ট্রিটমেন্ট পায়। প্রাইভেট সেল, এসি, ফাইভ স্টার হোটেলের খাবার- সব বরাদ্দ ছিল তার জন্য।”
তিহারের অন্যতম সমস্যা হচ্ছে এই 'ভিআইপি' সংস্কৃতি। কোনও বড় ব্যবসায়ী বা নেতা সরকারের নেক নজরে থাকলে হামেশাই ভিআইপি যত্নআত্তি পান তিহারে। অতীতে এই একই অভিযোগ উঠেছে লালু প্রসাদ যাদব, অমর সিং, কানিমোঝির বিরুদ্ধেও। কয়েকদিন আগেও ভাইরাল একটি সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে দিল্লির প্রাক্তন মন্ত্রী সত্যেন্দ্র জৈন রাজার হালে সময় কাটাচ্ছেন তিহারে। বারবার আপের তরফে অভিযোগ করা হয়েছিল, কারাগারে পর্যাপ্ত খাবার পাচ্ছেন না সত্যেন্দ্র। অথচ সিসিটিভি ফুটেজ সম্পূর্ণ ভিন্ন ছবি দেখায়। টাটকা ফল, ফলের রস, আরামদায়ক বিছানা, উপাদেয় খাদ্য, টিভি- সবই মজুত রয়েছে ‘ভিআইপি’ সেলে। আবার আরেকটি সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গিয়েছে এক ব্যক্তি তাঁর দেহ মালিশ করছেন। দেশের আইন সবার জন্য এক, অন্তত সংবিধান তো সেরকমই বলে। তাহলে শাস্তির ক্ষেত্রে এই ভেদাভেদ কেন? জেলের ভেতর কয়েদির সঙ্গে কেমন আচরণ করা হবে তা কি কয়েদির সামাজিক, অর্থনৈতিক কিংবা রাজনৈতিক অবস্থান দেখেই ঠিক করা হয়? যদি তা হয়, তাহলে বলতেই হচ্ছে ‘তিহার আশ্রম’ এখন বস্তুতই পরিণত হয়েছে ‘ত্রাসের তিহার’-এ।
তথ্যঋণ : https://www.quora.com/What-is-it-like-to-have-lived-in-Tihar-Jail
Black Warrant: Confessions of a Tihar Jailer; book by Sunetra Choudhury and Sunil Gupta