বাকস্বাধীনতা শুধুই মুখের কথা! ভারতে সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধ নিয়ে যে প্রশ্ন উঠে আসছে

ভারতে ২০২১ ও ২০০২ সালে একই কারণে খুন হয়েছেন মোট ৬ জন সাংবাদিক। গত এক দশকে ভারতে সাংবাদিক খুনের নিরিখে এক বছর সময়সীমায় ৬ জন সাংবাদিককে হত্যার ঘটনা নিয়ে উদ্বিগ্ন কমিটি ফর প্রোটেক্ট জার্নালিস্ট।

কথায় বলে, কলম তরবারির থেকে শক্তিশালী। আর ক্যামেরা কখনও মিথ্যে দেখায় না। কিন্তু সত্যের পথ যে কুসুমাস্তীর্ণ নয়, একথা হাড়েহাড়ে মালুম হচ্ছে সাংবাদিকদের। বিশ্বের নানা দেশে সাংবাদিকরা রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার। এঁদের একাংশ কলম কিংবা ক্যামেরাকে সত্যানুসন্ধানের কাজে ব্যবহার করে সত্য তথ্য উদঘাটিত করাতেই দমনপীড়নের শিকার। সাংবাদিক নিপীড়নের ক্ষেত্রে বিশ্বের অগ্রগণ্য দেশগুলির তালিকায় রয়েছে ভারতও।

এসম্পর্কে সম্প্রতি একাধিক সমীক্ষা রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। সর্বশেষ যে তথ্য প্রকাশিত হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, ভারতের বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলিতে সাংবাদিকদের কাজের স্বাধীনতাই কেবল ক্ষুণ্ণ হচ্ছে না, গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভের সেবক সাংবাদিকদের হত্যা পর্যন্ত করা হচ্ছে। এই রাজ্যগুলির মধ্যে তালিকার প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্থানাধিকারী রাজ্য বিজেপিশাসিত উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ এবং ত্রিপুরা। এছাড়া সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমের ওপর লাগাতার হামলার ঘটনা ঘটছে কেন্দ্রশাসিত এলাকা জম্মু-কাশ্মীরেও।

'ইন্ডিয়া প্রেস ফ্রিডম রিপোর্ট' উদ্ধৃত করে এই তথ্য জানিয়েছে 'রাইটস অ্যান্ড রিস্ক অ্যানালিসিস গ্রুপ'। রিপোর্ট অনুসারে, গত বছরে ভারতে খুন হয়েছেন ৬ জন সাংবাদিক। হামলার শিকার হয়েছেন ১০৮ জন সাংবাদিক। এছাড়া হুমকির মুখে পড়েছে ১৩টি সংবাদমাধ্যম।

আরও পড়ুন: একদিকে জঙ্গিদের হুমকি, অন্যদিকে প্রশাসন || কাশ্মীরে যেভাবে বাঁচেন সাংবাদিকরা

'রাইটস অ্যান্ড রিস্ক অ্যানালিসিস গ্রুপ'-এর তরফে এও জানানো হয়েছে, সাংবাদিক এবং সংবাদমাধ্যমের ওপর সবচেয়ে বেশি-সংখ্যক হামলার ঘটনা ঘটেছে জম্মু ও কাশ্মীরে। জম্মু ও কাশ্মীরে এই ধরনের ঘটনার সংখ্যা ২৫টি। এরপরই উত্তরপ্রদেশে ২৩টি, মধ্যপ্রদেশ ও ত্রিপুরায় সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমের ওপর যথাক্রমে ১৬টি এবং ১৫টি হামলার ঘটনা ঘটেছে। দেশের অন্য রাজ্যগুলি, যেমন দিল্লি, বিহার, অসম, হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র, গোয়া, মণিপুর, কর্নাটক, তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ, কেরল, ছত্তিশগড় এবং পশ্চিমবঙ্গেও সাংবাদিকরা ধারাবাহিক নিপীড়নের শিকার। সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমগুলির স্বাধীনতায় রাশ টানতে বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে ইডি এবং আয়কর দপ্তর সংবাদমাধ্যমগুলির একাংশের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে।

পার পাচ্ছেন না মহিলা সাংবাদিকরাও। মোট ৮ জন মহিলা সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে খবর লেখার দায়ে। এছাড়া মোট ১৭ জন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার অথবা আটক করা হয়েছে জম্মু-কাশ্মীর, দিল্লি, মহারাষ্ট্র, মণিপুর, ত্রিপুরা, অসম, ছত্তিশগড় এবং হরিয়ানা থেকে। 'ইন্ডিয়ান প্রেস ফ্রিডম' রিপোর্ট অনুসারে, সরকার-বিরোধী খবর প্রকাশের দায়ে ভারতে এফআইআর দায়ের করা হয়েছে মোট ৪৬ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে। এঁদের মধ্যে মোট ১৭ জনকে পুলিশ শারীরিকভাবে হেনস্থা করেছে বলে অভিযোগ।

পৃথিবীর অন্য কিছু দেশেও সাংবাদিকদের কাজের স্বাধীনতায় একইভাবে হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে। খবরাখবর সংগ্রহে বাধা দিচ্ছে রাষ্ট্র। অথবা সরকার-বিরোধী খবরাখবর প্রকাশের দায়ে সাংবাদিকদের ধরে জেলে পুরে দিনের পর দিন বিনা বিচারে আটক করে রাখা হয়েছে। 'কমিটি ফর প্রোটেক্ট জার্নালিস্ট'-এর সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুসারে, সারা পৃথিবীতে এই মুহূর্তে জেলবন্দি ২৯৩ জন সাংবাদিক। শুধুমাত্র ২০২১ সালেই বিশ্বব্যাপী খুন হয়েছেন ২৪ জন সাংবাদিক। সত্য উদঘাটনের মাসুল গুনতে গিয়েই সাংবাদিকদের জীবনহানি হয়েছে বলে জানিয়েছে 'কমিটি ফর প্রোটেক্ট জার্নালিস্ট'।

আরও জানা গিয়েছে, ভারতে ২০২১ ও ২০০২ সালে একই কারণে খুন হয়েছেন মোট ৬ জন সাংবাদিক। গত এক দশকে ভারতে সাংবাদিক খুনের নিরিখে এক বছর সময়সীমায় ৬ জন সাংবাদিককে হত্যার ঘটনা নিয়ে উদ্বিগ্ন কমিটি ফর প্রোটেক্ট জার্নালিস্ট।

'কমিটি ফর প্রোটেক্ট জার্নালিস্ট'-এর রিপোর্ট অনুসারে, সারা পৃথিবীর এক ডজনেরও বেশি দেশে সাংবাদিক ও সরকার-বিরোধী সংবাদমাধ্যমগুলি লাগাতার হামলার মুখে পড়েছে। স্বাধীনভাবে খবরাখবর ছাপা কিংবা সম্প্রচারের দায়ে এই পরিস্থিতি। এই দেশগুলির মধ্যে ভারত দ্বাদশ স্থানাধিকারী। এছাড়া তালিকার শীর্ষে থাকা অন্য দেশগুলির মধ্যে রয়েছে সোমালিয়া, সিরিয়া, ইরাক, দক্ষিণ সুদান, আফগানিস্তান, মেক্সিকো, ফিলিপিন্স, ব্রাজিল, পাকিস্তান, রাশিয়া এবং বাংলাদেশ। সাংবাদিক হত্যার নিরিখে এই দেশগুলি সারা দুনিয়ার নিরিখে এগিয়ে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সাংবাদিক খুনের মামলাগুলির কিনারাও হয়নি। গত ১৪ বছরে ভারতে ২০ জন সাংবাদিক খুনের মামলাগুলির কিনারা এখনও কেন হলো না, স্বভাবতই এ-বিষয়েও প্রশ্ন উঠছে।

'কমিটি ফর প্রোটেক্ট জার্নালিস্ট' ২০০৮ সাল থেকে সাংবাদিক হত্যা কিংবা সাংবাদিকদের জেলে পোরা অথবা অন্যায়ভাবে আটক করা সম্পর্কিত ইনডেক্স প্রকাশ করছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমের ওপর হামলা উত্তরোত্তর বাড়ছে।

ভারতে গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভের ওপর হামলার প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে 'কমিটি ফর প্রোটেকশন রাইটস'-এর প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর স্টিভেন বাটলার বলেছেন, "ভারতে সাংবাদিক নিগ্রহের ব্যাপারটা দিনে দিনে যেন জলভাত হয়ে উঠছে। ভারতীয় গণতন্ত্রের পক্ষে ব্যাপারটা উদ্বেগজনক।"

প্রতিবাদ জানিয়েছে রাষ্ট্রসংঘ। খুব সম্প্রতি রাষ্ট্রসংঘর মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস সাংবাদিক নিগ্রহের বিরোধিতায় বিবৃতি দিয়েছেন। গুতেরেস বলেছেন, "প্রতিবেদন লেখা কিংবা তথ্যাদি ট‍্যুইট করার দায়ে কোনও সাংবাদিককে জেলে পোরা সম্পূর্ণভাবেই অনভিপ্রেত।"

২০১৮ সালে একটি ট‍্যুইট পোস্ট করার দায়ে সম্প্রতি দিল্লি পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে বিশিষ্ট অল্ট নিউজের সাংবাদিক মহম্মদ জুবেরকে। ট‍্যুইট মারফত সাম্প্রদায়িক ভাবাবেগে আঘাত করার অভিযোগে মহম্মদ জুবেরকে গ্রেপ্তারির ঘটনার প্রতিবাদ জানানো হয়েছে নানা মহল থেকে। এরপর বিষয়টি নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানালেন খোদ রাষ্ট্রসংঘ-র মহাসচিব। সমাজকর্মী তিস্তা শেতলাবাদ এবং সাংবাদিক জুবেরকে পরপর গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

রাষ্ট্রসংঘর তরফে শুধুমাত্র ভারতই নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশেও সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমের ওপর হামলার ঘটনাগুলির নিন্দা করে বিবৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, "পৃথিবীর সর্বত্রই মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকা উচিত। মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ সব ক্ষেত্রেই অতি নিন্দনীয় ব্যাপার।"

'কমনওয়েলথ হিউম্যান রাইটস ইনিসিয়েটিভ' ইতিমধ্যে ভারত সরকারের কাছে আর্জি জানিয়েছে, যে সমস্ত সাংবাদিক বর্তমানে ভারতের নানা সংশোধনাগারে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় বন্দি, তাঁদের ওপর চাপানো মামলাগুলি প্রত্যাহার করা হোক। রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা প্রত্যাহার করে করা হোক জেলবন্দি ফোটোগ্রাফারদের ওপর থেকেও।

এ-পর্যন্ত এই আবেদনে কোনও কাজ হয়নি। উপরন্তু ব্রিটিশ শাসকরা পরাধীন ভারতের স্বাধীনতাকামী সংবাদমাধ্যমের ওপর যে ধরনে দমনপীড়ন চালাত, দেশ স্বাধীনের ৭৫ বছর পরেও সেই ট্র্যাডিশন অব্যাহত থাকাটা দুর্ভাগ্যজনক বলে মনে করছে আন্তর্জাতিক মহল।

 

 

More Articles