পুরভোটে খারাপ ফলের কারণ কী? বিজেপি কি পায়ের তলার মাটি হারাচ্ছে?

২০১১ সালে দলটার আসন সংখ্যা ছিল একেবারে শূন্য, সেখান থেকেই ২০২১-এ মসনদ দখলের স্বপ্ন দেখা, এক দশকে যেন একেবারে উল্কার গতিতে বঙ্গ রাজনীতিতে এক আলোকবর্ষ পথ অতিক্রম করেছিল ভারতীয় জনতা পার্টি। কিন্তু তারপরেই যেন ছন্দপতন। ২০২১ এর বিধানসভায় প্রধান বিরোধী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেলেও তাল কাটলো তার পর থেকেই। প্রথমে কলকাতা পৌরনিগম নির্বাচন, তারপর বিধান নগর সহ চার পুরসভার নির্বাচন। বিজেপি ফিরে গেল তার পুরনো জায়গাতেই। একদা তৃণমূল বিরোধীরা ভরসা করেও কেন ভরসা হারালেন বিজেপির ওপর? মেরুকরণের রাজনীতির অধিক ব্যবহার, নাকি নেতৃবর্গের অভাব, কোন কারণে নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে বিজেপি? 

২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বাংলা রাজনীতিতে বেশ অনেকটাই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছিল বিজেপি। সেই সময় বাকি দুই বিরোধী দল কংগ্রেস এবং বাম রীতিমতো নখদন্তহীন শার্দুলে পরিণত হয়েছিল। তাই, তৃণমূল বিরোধী জনতার একটা বড় অংশ ভরসা করতে শুরু করেছিল ভারতীয় জনতা পার্টিকে। বাম সমর্থনের চোরাস্রোত থাকলেও সেই সময় রীতিমত আন্ডারগ্রাউন্ড হয়ে গিয়েছিলেন বামের প্রত্যন্ত এলাকার বড় নেতারা। জনভিত্তি কমতে শুরু করেছিল গ্রামবাংলায়। তৃণমূলের বিরুদ্ধে যে ক'জন লড়াই জারি রেখেছিলেন, তারা রাজনৈতিক ঢাল পেতে অনেকেই বিজেপির শরণাপন্ন হন। পাশাপাশি, ২০১১ সালে যেখানে বিজেপির ভোট শতাংশ ছিল মাত্র ৪, এবং ২০১৪ সালে মাত্র ২১ শতাংশ, সেখানেই ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলের একদম ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করেছিল বিজেপি। ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির ভোট শতাংশ ছিল ৪০.৬৪ যা একটি রাজনৈতিক দলের পক্ষে বেশ বড় উন্নতি। এই ভোটের মধ্যে ১৩ শতাংশ ভোট এসেছিল বামের থেকে, আর ৭ শতাংশ ভোট এসেছিল কংগ্রেস থেকে। আর যদি হিন্দু ভোটের হিসাব ধরা হয় তাহলে সুইং আরো বড়। লোকনীতি সিডিএস এর ডেটা অনুযায়ী ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি হিন্দুদের মধ্যে ৫৭ শতাংশ ভোট দখলে সক্ষম হয়েছিল, যা গেরুয়া শিবিরের জন্য বিরাট বড় অক্সিজেনের কাজ করেছিল। 

উত্থান

বাংলায় বিজেপির উত্থানের পিছনে সব থেকে বড় হাত ছিল মূলত রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের। এই হিন্দুত্ববাদী সংগঠনটি সরাসরি রাজনীতিতে অংশগ্রহণ না করলেও বহু বছর ধরে ধীরে ধীরে পশ্চিমবঙ্গে নিজেদের কাজ করে এসেছিল। তাই বাংলায় বিজেপির প্রবেশ ছিল শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা। বিজেপির সাবেক রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ একটা সময় জানিয়েছিলেন, "সংগঠনকে জোরালো করতে বাংলাকে পাঁচটি জোনে ভাগ করেছে আরএসএস। এরপরে লোকসভা কেন্দ্র ধরে সাংগঠনিক জেলা কমিটিগুলিকে ঢেলে সাজানো হয়েছে। এরপরের ভাগটি হলো মন্ডল কমিটি। আগে এক একটা মন্ডলকমিটি যেখানে ২১০-২৭০টি বুথের দেখভাল করত, সেখানেই এবারে এই সংখ্যাটা কমে দাঁড়িয়েছে ৬০-৯০। যাতে আরো ভালোভাবে বুথগুলির কাজ পর্যবেক্ষণ করা যায়, তার জন্য প্রতিদিন নতুন ব্যবস্থা গ্রহণ করছে আরএসএস। ৫-৭টি বুথ কমিটি নিয়ে গঠন করা হয়েছে শক্তিকেন্দ্র। এসব জায়গায় নিয়োজিত হয়েছেন আরএসএসের স্বয়ংসেবকরা। পশ্চিমবঙ্গে সাংগঠনিক ভিত তৈরি করতে আমরা সর্বতোভাবে চেষ্টা করছি।" 

কিন্তু, বাংলায় আরএসএস তো বেশ কয়েক বছর ধরে রয়েছে, তাহলে বিজেপির এতদিন সময় লাগল কেন? রাজনীতিকরা বলছেন, শাসকদলের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভের দিকটা আবারও উঠে আসছে। বিজেপির মেরুকরণের রাজনীতি বাংলায় কিছুটা কাজ করলেও, সবথেকে বেশি যেটা কাজ করেছে সেটা হল 'হিন্দু খতরে মে হে' নামের একটি ফোবিয়া, যা মমতা ব্যানার্জি হিজাব পরে ইফতার পার্টি, কিংবা ইমাম ভাতা বা মুসলিমদের সামগ্রিক উন্নয়নের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বার্তা দিয়েও ২০১৯ লোকসভার আগে আটকাতে পারেননি। তার সঙ্গেই ২০১৮ সালের পুরসভা ভোটের সময় ব্যাপক ভোট লুট এবং ছাপ্পার অভিযোগ, যা তৃণমূলকে একেবারে খাদের কিনারায় এনে দাঁড় করিয়েছিল। ফলে, ২০১৯ নির্বাচনের ফল ছিল প্রায় প্রত্যাশিতই। এক-তৃতীয়াংশ মুসলিম ভোট থাকা সত্ত্বেও বালুরঘাটের মতো জায়গায় তৃণমূলের নেত্রী অর্পিতা ঘোষকে ১৩ হাজার ভোটে পরাজিত করেছিলেন বিজেপির বর্তমান রাজ্য সম্পাদক সুকান্ত মজুমদার, যা তৃণমূলের জন্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল একটি অশনি সংকেত। 

সারদা-রোজভ্যালির টাকা লুটের অভিযোগ থেকে শুরু করে শিক্ষক নিয়োগের নামে লক্ষ লক্ষ টাকা হজম করা, এমনকি গরিবের রেশনের চাল নিয়ে দুর্নীতি, এমনকি বার্ধক্য ভাতার টাকা থেকে সরিয়ে রাখা কাটমানি এবং আমফানের ত্রাণ নিয়ে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ সবকিছুই তৃণমূলের ভাবমূর্তির অনেকখানি হানি করেছিল। তোলাবাজি এবং সিন্ডিকেট রাজের দাপটে একটা সময় তৃণমূলের প্রতি অনেকটাই আস্থা হারিয়েছিল মানুষ, যার সরাসরি প্রতিফলন দেখা যায় ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে। বাংলার মতো জায়গায় যেখানে বিজেপি'র প্রভাব তেমনভাবে ছিলই না সেখানেও ১৮টি আসনে জয়লাভ করে বাড়তি অক্সিজেন পেয়ে গিয়েছিল গেরুয়া দলটি। ২২ আসন নিয়ে অস্তিত্ব সংকটের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছিল তৃণমূল। 

২০২১ বিধানসভা

২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের পর এই বিষয়টি খানিকটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, তৃণমূল কংগ্রেস বেশ খানিকটা ব্যাকফুটে। অন্যদিকে, বিজেপি তখন পুরোদমে বাংলায় প্রবেশের চেষ্টা করছে। শুভেন্দু অধিকারী, রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে মুকুল রায়, এর মধ্যেই একের পর এক প্রভাবশালী তৃণমূল নেতা বিজেপিতে নাম লিখিয়েছেন। বাংলার সিনেমা জগতের ক্ষেত্রেও এই তালিকাটা নেহাত কম নয়। রুদ্রনীল ঘোষ, বনি, এমনকি ধারাবাহিক জগতের অতি পরিচিত মুখ কৌশিক রায়, সকলেই নাম লিখিয়েছেন বিজেপিতে। শুভেন্দুর সঙ্গে তো রীতিমতো প্রায়দিনই ওঠাবসা পর্যন্ত শুরু করলেন বিজেপির শীর্ষস্থানীয় নেতারা। মনেই হচ্ছিল এবারে বাংলার দিকে নজর দেবেন মোদী-অমিত শাহরা। হলোও ঠিক সেরকমটাই। বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে একাধিক বিজেপি নেতা এসে ঘুরে গেলেন বাংলায়। একের পর এক সভা করে বাংলার জনগণকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করলেন। 'দিদি ও দিদি' ধ্বনিতে মঞ্চ মাতালেন মোদি। অন্যদিকে, প্রত্যন্ত গ্রামবাসীদের বাড়িতে মধ্যাহ্নভোজনের আসর বসিয়ে, তাদের দুঃখ দুর্দশার কথা শুনে নির্বাচনী ময়দানে নিজেদেরকে প্রাসঙ্গিক প্রমাণ করার চেষ্টাও করলেন অমিত শাহ, দিলীপ ঘোষ, অরবিন্দ মেননরা।

একইসঙ্গে, মেরুকরণের রাজনীতিও চললো পুরোদমে। প্রচারে এলেন বিজেপির হিন্দু হৃদয় সম্রাট যোগী আদিত্যনাথ। যোগী কে নিয়ে মেরুকরণের রাজনীতির ঘুঁটি সাজানোর চেষ্টা করেছিল বিজেপি। বঙ্গ বিজেপির নেতারাও প্রায়শই সম্পর্ক রাখছিলেন বিজেপি জাতীয় নেতাদের সঙ্গে। বিশেষত, বর্তমান বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী নির্বাচনের মাস কয়েক আগে থেকেই জাতীয় নেতাদের খাস লোক হয়ে উঠেছিলেন। দিল্লি যাওয়া, মোদি, অমিত শাহের সঙ্গে মতবিনিময়, রাজনৈতিক কৌশল তৈরি সবই চলছিল দারুন গতিতে। মনে হচ্ছিল, এবারের নির্বাচনে বিজেপির হাওয়া রয়েছে। আর সেই বিজেপি হাওয়ায় তৃণমূলের নিচুlnej বহু নেতা যোগ দিয়েছিলেন বিজেপিতে। কিন্তু সমস্ত চেষ্টাই ব্যর্থ হয়ে যায় ২ মে। 

বিজেপিকে পরাজিত করে তৃতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় আসেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পিকে এবং মমতার যুগলবন্দীতে ধরাশায়ী হয়ে যায় বিজেপি। ২০০ আসনের স্বপ্ন দেখা বিজেপিকে থামতে হয় মাত্র ৭৭ আসনেই। শুভেন্দু অধিকারী বিরোধী দলনেতা হলেও, বিজেপির মেরুকরণের রাজনীতি পুরোপুরিভাবেই হয়ে যায় ফ্লপ। যে জায়গায় বিজেপির ক্ষমতা ছিল ভালোই সেখানেও আসন দখল করেন মমতা। বিশেষত উত্তরবঙ্গে, যেখানে ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে দারুণ ফলাফল করেছিল বিজেপি, সেখানেও বহু আসন তাদের খোয়াতে হয় মমতার কাছে। এই নির্বাচনের ফলাফলের পরেই বাংলায় বিজেপির অবস্থান কিছুটা স্পষ্ট হয়ে যায়। বিধানসভা নির্বাচনে পরাজয়ের পরেই ফাটল ধরতে শুরু করে বিজেপিতে, যে ফাটল আরো চওড়া হয় তৎকাল বিজেপি বনাম আদি বিজেপির দ্বৈরথে।

তৎকাল বনাম আদি বিজেপির দ্বৈরথ

২১ বিধানসভা নির্বাচনের পর বিজেপির সাংগঠনিক শক্তি পশ্চিমবঙ্গে অনেকটা বৃদ্ধি পেলেও সমস্যা সৃষ্টি হয় নব্য বিজেপি এবং আদি বিজেপির মধ্যে। বিধানসভা নির্বাচনের আগে বিজেপির হাওয়া ছিল প্রবল। তাই সেই হাওয়ায় অনেক তৃণমূলে নেতাই নৌকা বদল করে বিজেপির সঙ্গে চলে এসেছিলেন। বিজেপিতে আসার পরে তাদের গুরুত্বই যেন বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে বেশি হয়ে ওঠে। মোদী কিংবা অমিত শাহ এর সবথেকে কাছের লোক হয়ে ওঠেন শুভেন্দু অধিকারী। অন্যদিকে, বঙ্গ বিজেপি থেকে অনেকটাই সরিয়ে দেওয়া হয় দিলীপ ঘোষকে। রাহুল সিনহার পরিবর্তে মুকুল রায় কিংবা রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়র প্রচারের জন্য বেশি সময় দিতে দেখা যায় বিজেপিকে। বিজেপির নতুন নেতারা বিধানসভা নির্বাচনে গো-হারা হারলেও শুভেন্দু অধিকারীকেই সেই বিরোধী দলের নেতা নির্বাচিত করে বিজেপি। 

এই ঘটনায় অসন্তোষ সৃষ্টি হয় বিজেপির আদি নেতাদের মনে। বিজেপির নব্য নেতারা পরিচিত হতে শুরু করেন তৎকাল বিজেপি নামে। বিজেপির পুরনো নেতারা শিবপ্রকাশ, কিংবা কৈলাস বিজয়বর্গীয় এর মতো নেতাদের বিরুদ্ধেও ক্ষোভ উগরে দেন। বিজেপির নিচু স্তরের নেতাদের মধ্যেও শুরু হয় অসন্তোষ। সুকান্ত মজুমদারকে রাজ্য সভাপতি করা হলেও তার ভূমিকা অনেকটাই গৌণ। বঙ্গ বিজেপির মুখ এখনো সেই শুভেন্দু অধিকারী। জয়প্রকাশ মজুমদার এর মত পুরনো নেতাদেরকেও বরখাস্ত করে বিজেপি। সঙ্গেই সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হওয়া মেরুকরণের রাজনীতি, সবকিছুই ধীরে ধীরে ফাটল ধরাতে শুরু করে বিজেপির আদি এবং নব্যকমিটির মধ্যে। তৎকাল বিজেপি এবং আদি বিজেপির সমস্যা আরো চরমে ওঠে যখন পুরসভা নির্বাচনেও পরাজয়ের সম্মুখীন হতে হয় বিজেপিকে। ২০২১ থেকে ২০২২, পৌরসভা নির্বাচনের একের পর এক পরাজয়ের সম্মুখীন হতে হয় বিজেপিকে। আসানসোলের মত পুরবোর্ড, যেখানে আগে থেকেই বিজেপির প্রভাব ছিল বেশ ভালই, সেখানেও পরাজিত হতে হয় বিজেপিকে। বিষয়টা বিজেপির জন্য অস্বস্তিকর হলেও বিজেপি যে আবার নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে, সেটা আর নতুন করে বলার প্রয়োজন হয় না।

পৌরসভা নির্বাচনে বিজেপি

পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির ক্ষমতা যে ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে সেটা আবারও নতুন করে প্রমাণ করে দেয় কলকাতা, বিধান নগর, শিলিগুড়ি, আসানসোল এবং চন্দননগরের পুরভোট। পাঁচটি পুর-বোর্ডের মধ্যে কোথাও দাঁত পর্যন্ত ফোটাতে পারল না বিজেপি। সব জায়গাতেই বিরাট পরাজয়ের সম্মুখীন হতে হলো বিধানসভা নির্বাচনে বিরোধী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা বিজেপিকে। আসানসোলের মত জায়গায় যেখানে বিজেপি'র প্রভাব ছিল বেশ ভালই, সেখানেও জিততে পারলেন না বিজেপি নেতারা। এমনকি, শিলিগুড়িতেও বিধানসভা নির্বাচনে যে শংকর ঘোষ জয়লাভ করেছিলেন, তিনিও হেরে গেলেন পৌরসভা নির্বাচনে। 

তবে শুধু তৃণমূলের কাছে নয়, কলকাতা, বিধাননগর এবং চন্দননগরে বামফ্রন্টের কাছেও পরাজিত হতে হল বিজেপিকে। জয়প্রকাশ মজুমদার থেকে শুরু করে অন্যান্য আদি নেতারাও বর্তমান রাজ্য বিজেপি নেতৃত্বকে খোঁচা দিতে ছাড়লেন না। হাইকোর্টে মামলা, এবং রাজ্যপালের কাছে অভিযোগ করা ছাড়াও 'আন্দোলনের রূপরেখা' তৈরি করতে হবে বলে খোঁচা দিলেন জয়প্রকাশ। তিনি কোনো রাখঢাক না রেখেই বলছেন, নিজের ব্যবহারের কম্পিউটারের স্ক্রিনে এখনো তিনি নরেন্দ্র মোদির ছবি রাখেন, সঙ্গে দিলীপ ঘোষের ছবিও রাখেন। কিন্তু আজকের নব্য বিজেপিকে নিয়ে তার সমস্যা রয়েছে। তিনি বলছেন, বর্তমানে বাংলায় 'আসল' বিজেপির থেকে তৎকাল বিজেপি বেশি ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছে। নাম না করে তিনি সরাসরি অর্জুন সিংকেও কটাক্ষ করতে ছাড়লেন না। এছাড়াও এই তৎকাল বিজেপিকে তৃণমূলের সরাসরি বি-টিম বলেও উল্লেখ জয়প্রকাশ এর। 

তিনি বলছেন, ২০১৮ থেকে ২২ থেকে ৩০ বছরের ছেলে মেয়েদের নিয়ে বিস্তারক কমিটি তৈরি করে যেভাবে পরবর্তী লোকসভায় বিজেপি একটা জোয়ার সৃষ্টি করেছিল, সেইটা আজকে কোথাও হারিয়ে গেছে। সেই সময়ে বিস্তারকদের শুধুমাত্র খাওয়া এবং যাতায়াতের ভাড়া দিতে হতো। কিন্তু তার আফসোস, এখনকার বিস্তারক দলকে অনেক বেশি তোষামোদ করতে হয়। লোকসভায় তৃণমূলকে হারানোর পর বিধানসভায় আরো বেশি আসল পাওয়ার কথা ছিল বিজেপির, সে তো হলোই না বরং সাধারণ মানুষের যে জোয়ার বিজেপির জন্য এসেছিল, তাতে কোথাও একটা ভাটা পড়ল। বিধানসভা নির্বাচনের এক মাস আগে বিজেপির অমিতাভ চক্রবর্তী দায়িত্ব নিয়েছিলেন। জয়প্রকাশ উল্লেখ করেন, অমিতাভ দায়িত্ব নেওয়ার পরেই, পুরনো কর্মীদের তাড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি। ওই বিস্তারকদের তাড়িয়ে দেওয়ার সময় তারা বলেছিলেন, বুথ এলাকায় এবং পঞ্চায়েত এলাকায় তাদেরকে দায়িত্ব দিয়ে কাজ করানো হয়। তাই তাদেরকে তাড়িয়ে দিলে বিজেপির আখেরে সমস্যা হবে।

অভ্যন্তরীণ সমস্যা ও ভবিষ্যৎ

অমিতাভ চক্রবর্তী দায়িত্ব নেওয়ার পরেই পুরনো বিস্তারের তাড়িয়ে দেওয়ার ওই সিদ্ধান্ত বিজেপির জন্য শেষ পর্যন্ত ডেকে এনেছিল সমস্যা। একেবারে নিচু স্তর থেকে ভেঙে পড়তে শুরু করেছিল বিজেপি। সঙ্গেই, বঙ্গ বিজেপিতে মুখের অভাব বিজেপির জন্য আরো বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। তৃণমূল কংগ্রেসে এই মুহূর্তে এখনো অনেক নেতা এমন রয়েছেন যারা নিজের এলাকায় যথেষ্ট ক্ষমতাশালী এবং তারা নিজেরাই একটি পুরবোর্ড দখল করার ক্ষমতা রাখেন। কিন্তু, বিজেপিতে এরকম নেতৃত্বের অভাব এই প্রথম নয়। নীচুস্তর থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পাশাপাশি, বিস্তারক কমিটির অপসারণ বিজেপিকে প্রায় নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে এগিয়ে নিয়ে যায়। কয়েকজন হিন্দিভাষী নেতা এবং অমিতাভ চক্রবর্তী মিলে বুথ স্তর থেকে বিজেপিকে পরিচালনা শুরু করেন যার ফল মেলে বিধানসভা নির্বাচনেই। পরবর্তী নির্বাচনেও এই একই ভুল করে বিজেপি।

পৌরসভা নির্বাচনে যেখানে সব থেকে আগে প্রয়োজন জনভিত্তি এবং জনপ্রিয়তা, সেখানেও প্রচারে ব্যবহৃত হতে দেখা যায় নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহের মুখ। জয়প্রকাশ বলছেন, তিনি একজন বিজেপি থেকে বরখাস্ত হওয়া নেতা। রীতেশেরও একই অবস্থা। সুকান্ত মজুমদার সম্পূর্ণ অসহায়। শুভেন্দু অধিকারীকেও পড়তে হচ্ছে প্রশ্নের মুখে। ২০১৬ সালে মোদি অন্তপ্রাণ যে বিজেপি নেতার বুকে জলন্ত সিগারেট দিয়ে টিএমসি লেখার অভিযোগ উঠেছিল শাসকদলের বিরুদ্ধে, সেই আদি বিজেপি নেতা বিষ্ণু চৌধুরীও মঙ্গলবার পুরভোটের আবহে যোগ দিলেন তৃণমূলে। ধর্ম এবং আদর্শসর্বস্ব রাজনীতি করা বিজেপি এখন মানুষের থেকে কার্যত কয়েক ক্রোশ দূরে। এখন ট্যুইটার, হাইকোর্ট এবং রাজভবন নিয়েই বিজেপির মাতামাতি বেশি। সাধারণ কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ প্রায় নেই বললেই চলে। আগামী দিনে যদি এরকমই চলতে থাকে, তাহলে আবারও ২০১১-র মতো অচলায়তনেই পরিণত হবে ভারতীয় জনতা পার্টির পশ্চিমবঙ্গের শাখা সংগঠনটি।

More Articles