স্বামীজির কথাতেই নয়া পরিকল্পনা জামশেদজীর, কীভাবে ভারতের মাটিতে ভিত শক্ত হল ‘টাটা’র?

Tata Group : মাত্র একুশ হাজার টাকা সম্বল করেই শুরু হয়েছিল পথ চলা, কতটা চেনেন টাটা সাম্রাজ্যের কারিগর জামশেদজীকে?
সাল ১৮৯৩। জাপানের টোকিও সমুদ্র উপকূলের ইয়োকোহামা থেকে আমেরিকার ভ্যাঙ্কুবারের দিকে রওনা দিয়েছে যাত্রীবাহী এক জাহাজ, ‘এমপ্রেস অফ ইন্ডিয়া’। যাত্রীবাহী সেই জাহাজেই প্রথম আলাপ দুই বিখ্যাত ভারতীয়র। তার মধ্যে একজন বাঙালি, অন্যজন পার্সি। অল্প সময়ের মধ্যেই জমে উঠল বন্ধুত্ব। বাঙালি ভদ্রলোকটির পরিচয় অবশ্য নতুন করে দেওয়ার কিছুই নেই। যাত্রার উদ্দেশ্য বললেই বোঝা যায় উনি আসলে কে। শিকাগোতে মহা ধর্ম সন্মেলনে যোগ দিতে চলেছেন তিনি। হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন, উনি আর কেউ নন, স্বামী বিবেকানন্দ। কিন্তু অন্যজন? কে তিনি? সেই পার্সি ভদ্রলোকটি ছিলেন বোম্বাইয়ের নামজাদা এক ব্যবসায়ী। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে অবশ্য সেই নামটির বিস্তৃতিও বিশ্বজোড়া। তৎকালীন সময়ে জাপান থেকে তিনি দেশলাই রপ্তানি করতেন ভারতে। আর কেউ নন, তিনি হলেন ভারতীয় শিল্প তথা বাণিজ্য জগতের অন্যতম প্রাণপুরুষ, জামসেদজী টাটা।
 
১৮৩৯ সালের ৩ মার্চ গুজরাটের নাভসারিতে জন্ম হয়েছিল জামশেদজি টাটার। তিনিই ছিলেন এদেশের প্রথম গাড়ি কেনা ব্যক্তি। বলা হয়, জামশেদজি টাটাই প্রথম ভারতকে ব্যবসা করতে শিখিয়েছিলেন। মাত্র তেরো বছর বয়সে তিনি গুজরাট থেকে পরিবারের সঙ্গে চলে আসেন মুম্বাইতে। সেখানেই ভর্তি হন এলফিনস্টোন কলেজে।  পড়াশোনাতেও তুখোড় ছিলেন জামশেদজী। সর্বোচ্চ নম্বর নিয়ে কলেজ পাশ করেন। এরপরেই বাবার সঙ্গে যোগ দেন ব্যবসায়। ব্রিটিশ লেখক পিটার ক্যাসির 'স্টোরি অফ টাটা' বই থেকে জানা যায়, শুরুতে আফিমের ব্যবসা করত টাটা পরিবার। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে অবৈধ হলেও তখন বৈধ ছিল এ ব্যবসা। যদিও আফিমের কারবারে বিশেষ ঝোঁক কোনওদিনই ছিল না জামশেদজীর। শোনা যায়, তিনিই এই পরিবারকে আফিমের ব্যবসা থেকে বের করে আনেন।
 
আরও পড়ুন - মাত্র দুজন বসতে পারে চারচাকা গাড়িতে, কতটা আলাদা ন্যানোর থেকেও ছোট টাটার এই নয়া মডেল?
 
২৯ বছর বয়স পর্যন্ত বাবার সঙ্গেই ব্যবসা করতে থাকেন তিনি। এরপর মাত্র একুশ হাজার টাকা সম্বল করে নিজের ব্যবসা খোলার কথা ভাবেন। প্রথমদিকে একের পর এক ব্যবসায় ভরাডুবি, টালমাটাল পরিস্থিতি, কিছুই দমাতে পারেনি তাঁকে। আবার নতুন উদ্যমে শুরু করেন নতুন কোনও ব্যবসা। একবার তেলের মিল কিনে তাকে কটনের মিলে বদলে ব্যবসা করেন, আবার সেটাতে লাভের মুখ না দেখলে নতুন করে খোলেন তুলোর মিল। কিন্তু হাল ছাড়েননি কিছুতেই। এরপর আস্তে আস্তে জমি পাকা হতে থাকে। চারটি বড় প্রকল্প হাতে নেন একে একে। স্টিল কোম্পানি, একটি বিশ্বমানের হোটেল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং একটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। এগুলির হাত ধরেই ক্রমে ঘুরে দাঁড়াতে থাকে টাটা সংস্থা। পাশাপাশি জাপান থেকে এদেশে দেশলাই রপ্তানির কাজ তো ছিলই।
 
আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ‘টাটা’, কেবল একটা নাম বা কোনও পদবি নয়, এটা একটি ব্র্যান্ড। শুধু ভারত বলে নয়, বর্তমানে এর বিস্তার ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের অন্যান্য দেশেও। নুন, মশলা থেকে শুরু করে গাড়ি, বাড়ি সবেতেই অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে রয়েছে টাটা কোম্পানির নাম। যদিও আজকের এই ‘ব্র্যান্ড’ হয়ে ওঠার সফরটা মোটেই সহজ কিছু ছিল না, সাফল্যও আসেনি সহজে। অনেকেই হয়তো জানেন না, ভারতের মাটিতে টাটা কোম্পানির দেশীয় ব্যবসার গোড়াপত্তনের নেপথ্যে রয়েছে স্বামীজির সঙ্গে ওইদিনের ওই জাহাজ যাত্রা। 
 
অল্প সময়ের মধ্যেই সেদিন জমে উঠেছিল গল্প। তৎকালীন পরাধীন ভারতবর্ষের ব্যবসা-বানিজ্য, ধর্ম, রাজনীতি থেকে দেশের ভবিষ্যৎ অর্থনীতি, কী না ছিল সেই আড্ডায়! জাহাজের ডেক থেকে সেই আড্ডা গড়িয়েছিল জাপানের ইয়োকোহামা শহরের হোটেল পর্যন্ত। একই হোটেলে ছিলেন দুজন। সেখানেই কাজের ফাঁকে যতটুকু সময় পেয়েছেন নিজেদের আগামী কাজ নিয়ে আলোচনা করেছেন। জানা যায়, স্বামীজিই প্রথম জামশেদজী টাটাকে ভারতের মাটিতে ব্যবসা করার পরামর্শ দেন। আধুনিক প্রাশ্চাত্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে কীভাবে ভারতে নিজের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যায় এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনাও করেন তাঁরা। 
 
স্বামীজি অবশ্য দেশের পরিস্থিতির কথা ভেবেছিলেন সর্বাগ্রে। একদিকে যেমন এই পরিকল্পনায় লাভবান হবেন জামশেদজী, অন্যদিকে এই নতুন প্রতিষ্ঠানের হাত ধরে ভারতের অর্থনীতির ভিত যে শক্ত হবে এমনটা তিনি আগেই বুঝেছিলেন। পাশাপাশি কর্মসংস্থান ঘটবে দেশের বহু মানুষের। মুহূর্তের বন্ধুত্ব বলে কিংবা অন্য কোনও কারণে প্রাথমিকভাবে সেই কথায় বিশেষ আমল দেননি জামশেদজী। যদিও পাঁচ বছর পর সেই সিদ্ধান্তকেই শিরোধার্য করার কথা ভাবতে বাধ্য হন তিনি। সটান চিঠি লেখেন স্বামীজিকে।
 
আরও পড়ুন - ঋণে ডুবে থাকা টাটা গোষ্ঠীকে বাঁচিয়েছিল এটি! ভারতের অজানা ইতিহাসের শরিক জুবিলি ডায়মন্ড
 
দাবি একটাই, স্বামীজিকেই হতে হবে তাঁর বহু পরিকল্পিত ‘টাটা রিসার্চ ইনস্টিটিউট’-এর প্রধান। স্বামীজির পরামর্শই যে এই কাজের মূল পাথেয়, এমনটাও উল্লেখ করেন চিঠিতে। যদিও স্বামীজি তখন ব্যস্ত রামকৃষ্ণ মঠ প্রতিষ্ঠার কাজে। ফলে নিজে দেখা করতে না পারলেও পাঠিয়ে দিলেন তাঁর যোগ্য শিষ্যা ভগিনী নিবেদিতাকে। এরপর তাঁকে সঙ্গে নিয়েই প্রকল্পটির বিস্তারিত পরিকল্পনা করতে থাকেন জামশেদজী টাটা। তিনি নিশ্চিত ছিলেন, বিজ্ঞান ও শিল্পের গবেষণার মাধ্যমেই দেশের সার্বিক উন্নতি ঘটানো সম্ভব। পাশাপাশি এর জেরে অগ্রসর হবে ভারতীয় অর্থনীতিও। যদিও পথ মোটেই খুব সহজ ছিল না, বাধাও এসেছে প্রচুর। তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড কার্জন প্রথমেই বাধা দেন পরিকল্পনায়। কিছুতেই ভারতীয় সংস্থাকে মাথা তুলে দাঁড়াতে দিতে চাননি তিনি। পরবর্তীতে ১৮৮৯ সালে মহীশূরের দেওয়ান শেষাদ্র্রি আইয়ারের সহায়তায় বেঙ্গালুরুর কেন্দ্রস্থলে প্রায় ৩৭২ একর ফাঁকা জমি পান জামসেদজী।
 
এতদিনের পরিকল্পনা, জমি সব জুটল ঠিকই তবে সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন পর্যন্ত অপেক্ষা করা হল না দুই প্রবাদপ্রতীমের কারোরই। ১৯০২ সালের ৪ জুলাই স্বামী বিবেকানন্দ মারা যাওয়ার দু’বছরের মাথায় মারা জন জামসেদজী টাটাও। কিন্তু তাঁদের দুজনের বুনে যাওয়া সেই স্বপ্ন ডালপালা মেলেছে সময়ের সঙ্গে। আজ টাটা কোম্পানির নাম সর্বত্র। মূলত বস্ত্র বয়ন শিল্পের মাধ্যমে জামশেদজীর উত্থান ঘটলেও শুধু ব্যবসায়ী নয়, তিনি ছিলেন একজন সমাজসেবীও। তাঁর সেই সমাজসেবামূলক কাজকে বছর দুই আগে অর্থাৎ ২০২১ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী স্বীকৃতি দিয়েছে ‘এডেলগাইভ হুরুন’ নামের এক বৈশ্বিক সংস্থা। দীর্ঘ এক শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ সমাজসেবীদের তালিকায় শীর্ষস্থানে থাকা জামশেদজীই হলেন একমাত্র ভারতীয়। বিল গেটস, ওয়ারেন বাফেটকে পিছনে ফেলে সমাজসেবী হিসেবে বিশ্বের দরবারে স্বীকৃতি আদায় করে নেন জামশেদজী টাটা। সুতরাং, বিশ্বাসের যে শক্ত ভিত এদেশে তৈরি করতে চেয়েছিলেন জামশেদজী, তা যে সময়ের সঙ্গে নিশ্চিত হয়েছে তা হলপ করে বলা যায় আজও।

More Articles