মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য দিনদুপুরে বিমান অপহরণ! ইতিহাসে লেখা থাকবে এই স্পর্ধা...
এক ছিল ইয়ুজিন, পেশায় চোর ছিল সে। রাজপ্রাসাদ থেকে রাজকন্যার মুকুট চুরি করা থেকে শুরু করে শেষমেষ শয়তান গথেল ডাইনির হাত থেকে রাজকন্যা রাপুনজেলকে বাঁচিয়ে, তাকে ফিরিয়ে এনেছিল, তার আসল বাবা-মার রাজত্বে।ডিজনির দৌলতে চোর থেকে হিরো হয়ে ওঠার এই ‘Tangled’ রূপকথা আমাদের মুগ্ধ করে। কিন্তু এর চেয়েও রোমহর্ষক ঘটনা যদি বাস্তবেই ঘটে? বাক্সবন্দি বোমা আর একটি পিস্তল হাতে বিমানের ককপিটে পৌঁছে যাওয়া বাস্তবের আরেক ইয়ুজিনের কাহিনি, আমাদের শুধু মুগ্ধ করে তাই নয়, ইতিহাসকে দেখতে শেখায় নতুন ভাবে। পেশায় লেখক, দিব্যি কাটছিল দিন, এই সদাশয় মানুষটিই একদিন বোয়িং বিমান অপহরণের মতো দুঃসাহসিক কাজ করে বসলেন। দাবি? বাংলাদেশি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কুড়ি টন প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহের দাবিতে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এ ঘটনাও এক স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায়।
১৯৭১ সালের ৩রা ডিসেম্বর ফ্রান্সের অর্লি বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে থাকা পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারওয়েজের একটি বোয়িং ৭২০ বিমানের ককপিটে, দুপুর ১১.৫০ মিনিট নাগাদ উঠে পড়েন, ২৮ বছর বয়সি ফরাসি নাগরিক জ্যঁ ক্যুয়ে । পাইলটের দিকে হাতে থাকা নিজের নাইন এম এম পিস্তলটি তাক করে তাঁর দুই পৃষ্ঠার লিখিত দাবি হিসাবে জানান, তৎক্ষণাৎ পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীনতার লড়াইরত মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে ওষুধ ও ত্রাণসামগ্রী পাঠাতে হবে। কুড়ি টন প্রয়োজনীয় ওষুধ জোগাড়ে সময় লাগবে তো বটে! তার থেকেও বড় কথা, ফরাসি সরকার কর্তৃক এই দাবি মানতে হবে তো।
টানা সাত ঘণ্টার বেশি রানওয়েতেই বিমানটি দাঁড়িয়ে রইল। ছ’জন বিমানকর্মী আর সতেরো জন যাত্রী তখন বিমানের মধ্যে ভয়ে তটস্থ। দাবি না মানলেই বোমার সাহায্যে বিমানটি উড়িয়ে দেবেন বলে বারবার জানাচ্ছেন জ্যঁ ক্যুয়ে আর ফরাসি সংবাদমাধ্যমগুলিতে ‘সরাসরি সম্প্রচার’ হচ্ছে সেই খবর। প্রত্যক্ষদর্শী যাত্রীর বয়ান অনুযায়ী, তাঁর সঙ্গে থাকা ছোট একটি বাক্সকে কিছুতেই সেদিন কাছ-ছাড়া করেননি ইয়ুজিন। বোমার ভয়ে তটস্থ মুহূর্তগুলি কাটানোর বহু পরে জানা যায়, বাক্সটিতে কিছু বৈদ্যুতিক তার, দুটি শব্দকোষ ও একটি বাইবেল ছিল । পাগলা দাশুর সেই বিখ্যাত বাক্সের কথা মনে পড়ল কি, পাঠক?
আরও পড়ুন-আজ যিশু কলকাতার, আনাচেকানাচে ছড়িয়ে থাকা গির্জার সুলুকসন্ধান…
আসলে জ্যঁ ক্যুয়ে এক সময়ে বিয়াফ্রা ও ইয়েমেনে সৈনিক হিসাবে লড়াই করেছিলেন। যুদ্ধক্ষেত্রের দুঃসহ যন্ত্রণার দিনগুলি তাঁর স্মৃতি থেকে কখনই মুছে যায়নি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আক্রান্ত শত শত সৈনিক ও উদ্বাস্তুদের কথা জানতে পেরে স্বভাবতই স্থির থাকতে পারেননি তিনি। দুঃসাহস ও এক বুদ্ধিদীপ্ত কৌশলকে হাতিয়ার করে পৌঁছে যান ওরলি বিমানবন্দরে। নিরাপত্তার ঘেরাটোপকে কাঁচকলা দেখিয়ে উঠে পড়েন পাকিস্তান এয়ারলাইনসের বিমানটিতে। এই ঘটনার প্রাককথন হিসাবে বলা যায়, সেদিন পাকিস্তানের বায়ুসেনা আক্রমণ করেছিল ভারত বাংলাদেশ সীমান্তের ভারতীয় বায়ুসেনাদের, যার ফলশ্রুতিতে ভারত যুদ্ধ ঘোষণা করে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। আর রাজায় রাজায় যুদ্ধ মানেই শত শত উলুখাগড়ার প্রাণের উপর নেমে আসা কোপ। এই রণরক্তের পরিস্থিতিই ছিল জ্যঁ ক্যুয়ের এই ২০ টন ওষুধ ও ত্রাণসামগ্রীর দাবি।
জ্যঁ ক্যুয়ে সময়টিও বেছেছিলেন দুরন্ত। জার্মান চ্যান্সেলর উইলি ব্যান্ডট-এর সেদিনই ওরলি বিমানবন্দরে আসার কথা ছিল তৎকালীন ফরাসি প্রেসিডেন্ট পম্পেডুর সঙ্গে এক বৈঠকের জন্য। নিরাপত্তার সমস্ত কড়াকড়ি যখন চ্যান্সেলরের আগমনকে ঘিরে একদিকে জমা হয়েছিল, সেই সুযোগে বোয়িং ৭২০ বিমানটির বোর্ডিং এর জায়গা থেকে রানওয়েতে ঢোকার সময় জ্যঁ ক্যুয়ে বিমানটিতে উঠে পড়েছিলেন। বিমান অপহরণের ঘোষণা ও তাঁর দাবি জানানোর সঙ্গে সঙ্গে জার্মান চান্সেলরের সঙ্গে পম্পেইডুর বৈঠকটি বাতিল করে দেওয়া হয়। ফরাসি শীর্ষস্থানীয় নেতারা জ্যঁ ক্যুয়ের দাবিটি নিয়ে তৎক্ষণাৎ আলোচনায় বসেন। স্বভাবতই ফরাসি সরকার প্রাথমিকভাবে ইয়ুজিনের দাবি মানতে না চাইলে, ইয়ুজিন জানান তাঁর দাবির কোনও পরিবর্তন তো হবেই না, সেইসঙ্গে দাবি না মানা হলে অপহৃত যাত্রীদের প্রাণের আশঙ্কাও ষোলোআনা । অপহরণকারীর এহেন বদ্ধপরিকর মনোভাবের কাছে শেষ পর্যন্ত ফরাসি সরকার নতি স্বীকার করে। ফরাসি সরকার এক টন ওষুধ পাকিস্তান এয়ার লাইনসের সঙ্গে পাঠিয়ে বাকি ওষুধ ও ত্রাণসামগ্রী যত শীঘ্র সম্ভব বাংলাদেশে পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দেয়। বিকেল ৫টা ১৫ মিনিট নাগাদ ফরাসি রেড ক্রস ও একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘ওড্রে দ্য মল্টে’, এক টন ওষুধ বিমানে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নেয়।
আরও পড়ুন-জগন্নাথের বডিগার্ড: নিরামিষাশী বাহুবলী অনিল গোচিকারের পরিচয় জানুন…
এর পরের ঘটনাক্রম চাইলে যে কোনও হলিউডি অ্যাকশন সিকোয়েন্সকেও মুহূর্তে ফিকে করে দিতে পারে! এক টন ওষুধ তখন বিমানে বোঝাই করা চলছে। রেড ক্রসের তরফে আসা দ্বিতীয় গাড়িটি থেকে দু'জন রেডক্রসের কর্মী, একজন মেকানিক ও গাড়ির চালক উঠে পড়লেন বিমানে। ওষুধ বোঝাইয়ের কাজে হাত চালানোর জন্য যত বেশি জনকে পাওয়া যায় আর কী! জ্যঁ ক্যুয়েকে অনুরোধ করা হল আটজন যাত্রী ও একটি শিশুকে মুক্তি দেওয়ার জন্য। বিমানে ওষুধ বোঝাই হতে দেখে জ্যঁ ক্যুয়ে মেনে নিলেন সেই দাবি। জ্যঁকে পেনিসিলিন দেখানোর অজুহাতে তাঁর কাছে গিয়ে তাঁকে বন্দি করলেন রেডক্রসেরই সেই চার কর্মী। দ্বিতীয় গাড়িতে আসা রেড ক্রসের কর্মীদের পোশাকেই বিমানে ঢুকেছিলেন ওই চারজন পুলিশ। এক প্রস্থ গুলি চললেও সেই গুলিতে কেউ আহত হননি। ক্যুয়ে ধরা পড়লেন। দেখা গেল ক্যুয়ে-এর হাতের বাক্সে বোমার পরিবর্তে বাইবেল রাখা। তাঁর আসল মনোভাবের পরিচয় পেয়ে রেডক্রস ও ফরাসি সরকার তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছিল। কুড়ি টন ওষুধ শেষমেষ পৌঁছেছিল বাংলাদেশি মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে। জ্যঁ ক্যুয়ের বিমান অপহরণ সফল হয়নি বটে,তবে তাঁর ইচ্ছেপূরণের অপরূপকথাখানি ঠিক তাঁর ‘হ্যাপি এন্ডিং’ খুঁজে নিয়েছিল।
অপহৃত যাত্রীদের বয়ান থেকে পরবর্তীকালে জানা যায়, ক্যুয়ে একটিবারের জন্যও তাঁর পিস্তলটি যাত্রীদের দিকে তাক করা দূর অস্ত, কারো সঙ্গে খারাপ ব্যবহারও করেননি। আর বাক্সে রাখা বৈদ্যুতিক তার আর বাইবেল ছিল বোমার জুজু-মাত্র। এই ঘটনা ইয়ুরোপিয়ান ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলিতে তুমুল আলোড়ন তোলে। পরবর্তীতে ফরাসি সরকার নীতিগতভাবেও বাংলাদেশকে সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নেয়। বিচারের সময় জ্যঁ ক্যুয়ে জানান আন্দ্রে মলরক্সের মানবতাবাদী লেখা পড়েই এমন দুঃসাহসী কাজে এগিয়েছিলেন তিনি। প্রাক্তন ফরাসী মন্ত্রী ও মানবতাবাদী কর্মী আন্দ্রে মলরক্স জ্যঁ ক্যুয়ের পক্ষে সওয়ালও করেছিলেন। বিচারে পাঁচ বছরের কারাবাসের শাস্তি পেলেও ১৯৭৩ সালে তিনি মুক্তি পান। পরবর্তীকালে জ্যঁ ক্যুয়ে বিশ্বব্যপী মানবতাবাদী নানা কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
বাংলাদেশ যে ইয়ুজিনের কথা ভোলেনি তাঁর প্রমাণ পাওয়া যায় ঢাকা ট্রিবিউন বা প্রথম আলোর আর্কাইভ দেখলেই। বাংলাদেশে ২০২১-এর ডিসেম্বরে ফাখরুল অরেফিন খান পরিচালিত জ্যঁ ক্যুয়েকে নিয়ে একটি চলচ্চিত্রও প্রকাশ পেতে চলেছে। ভয়কে হাতিয়ার করে যে প্রয়োজনে মানবতার কাজেও এগিয়ে আসা যায় তা বাংলাদেশের বিপদের দিনে দেখিয়ে দিয়েছিলেন জ্যঁ ইয়ুজিন পল ক্যুয়ে। আর আমরা তো জানিই ‘ডরকে আগে জিত হ্যায়’ আর ‘হার কর জিতনেওয়ালে কো…’
তথসূত্রঃ
- নিউইয়র্ক টাইমস আর্কাইভ
- ডেলিস্টার
- ডিফেন্সআপডেট-ব্লগস্পট