নীলদর্পণের সঙ্গে জড়িয়ে কলকাতার রাস্তা! জেমস লং সরণির নামকরণ হয়েছিল কার নামে?
James Long Sarani History: কলকাতা শহরের একটি রাস্তা, যার নাম জেমস লং সরণি তার সঙ্গে নীলদর্পণের এই যোগাযোগ হয়তো বহু মানুষেরই অজানা।
নীলদর্পণ নাটক কে রচনা করেছিলেন? দীনবন্ধু মিত্র। স্কুলের পরীক্ষার খাতায় শুধু এইটুকু লিখলেই উত্তরের জন্য রাখা পুরো একটা নম্বর ছাঁকা মেলে, মিলেওছে। তাই বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রীরই নীলদর্পণ বিষয়ক জ্ঞান এখানেই এসে থমকে গেছে। এর বেশি তথ্য পরীক্ষার খাতায় প্রয়োজন পড়ে না। বড় জোর ইচ্ছে হলে এইটুকু জেনে রাখা যেতে পারে যে ১৮৬০ সালে দীনবন্ধু মিত্র দ্বারা রচিত নীলদর্পণ প্রথম প্রকাশিত হয়। নীল চাষিদের উপর ইংরেজদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে এই নাটকটি সাড়া ফেলেছিল বিভিন্ন মহলেই, সাধারণ মানুষের ক্ষোভের আঁচকে ইন্ধন জুগিয়েছিল এই নাটক। প্রশ্ন হলো, নীলদর্পণ মানে শুধুই কি দীনবন্ধু মিত্র এবং নীল চাষিরা? তাহলে আর কে? দীনবন্ধু মিত্র চাষিদের দুর্দশার কথা লিখেছেন ঠিকই তবে নীলদর্পণের সঙ্গে আরও অনেক অনেক চরিত্র জড়িয়ে আছেন, যারা অলক্ষ্যেই রয়ে গেলেন। এই কলকাতা শহরেই রয়েছে এমন এক রাস্তা যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে নীলদর্পণের এক খণ্ড ইতিহাস। কলকাতার সেই বিশেষ পরিচিত রাস্তার নাম আসলে এক ইংরেজের নাম অনুসারে দেওয়া হলেও সেই মানুষটি নীলদর্পণের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তীব্রভাবে।
১৮৬০ সালে প্রকাশিত হয় দীনবন্ধু মিত্র রচিত বাংলা নাটক নীলদর্পণ। গ্রাম বাংলায় চাষিদের উপর ইংরেজ নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে এই নাটক সেই সময় তুমুল বিতর্ক তোলে। চাষিদের দিয়ে জোর করে নীল চাষ করিয়ে তাদের ন্যূনতম মূল্যে নীল বেচতে বাধ্য করা থেকে শুরু করে তাদের উপর শারীরিক, মানসিক এবং আর্থিক নিপীড়নের কাহিনিই এই নাটকে উঠে এসেছিল। বাংলা তথা ভারতবর্ষের মানুষ এবং ইংরেজদের চোখে আঙুল দিয়ে নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের কাহিনি দেখানোই এই নাটকের উদ্দেশ্য ছিল। সেই সময় বাংলায় এক আইরিশ মিশনারি ছিলেন যিনি চার্চ মিশনারি সোসাইটি স্কুলের পরিচালনা করতেন। এই পাদ্রীর দেশিয় সাহিত্যের প্রতি বিশেষ আগ্রহ ছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন, দেশিয় সাহিত্যের মাধ্যমে এই দেশের মানুষের মন বোঝা যায়। ১৮৪০ সালে ভারতে আসা এই পাদ্রীর নাম ছিল রেভারেন্ড জেমস লং। দীনবন্ধু মিত্র নিজের নীলদর্পণ নাটকটি ইংরেজিতে প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে পাদ্রী লংয়ের কাছে পাঠিয়েছিলেন। পাদ্রী লং দেশিয় সাহিত্যের প্রতি আগ্রহী হলেও তিনি নীলদর্পণ নাটকের ইংরেজি অনুবাদের সম্পাদনা করেছিলেন। বহু বিশিষ্ট মানুষের অনুরোধে মাইকেল মধুসূদন দত্ত নীলদর্পণের ইংরেজি অনুবাদটি করেন ।
আরও পড়ুন- দক্ষিণ কলকাতার ব্যস্ততম রাস্তা! হরিশ মুখার্জি রোডের নেপথ্যের মানুষকে চিনলই না বাঙালি
নীলদর্পণের মতো নাটক লেখা এবং প্রকাশ করার জন্য সেই সময়ে শুধু কলমের কেরামতিই যথেষ্ট ছিল না। অসীম সাহস এবং ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা থাকা মানুষেরও দরকার ছিল। ভারতে তখন ইংরেজদের শাসন। তাই তাদেরই বিরুদ্ধাচারণ করে নাটক লিখে তাদেরই অত্যাচারের কথা মানুষকে জানালে ইংরেজদের রোষানলে পড়তে হবেই। দীনবন্ধু মিত্র এবং মাইকেল মধুসূদন দত্ত তখন দু'জনেই ইংরেজ সরকারের অধীনস্থ কর্মচারী। তাদের শাস্তির ভাগ আরও বেশি হতে পারে। এই আশঙ্কার মেঘ কাটাতে এগিয়ে এসেছিলেন পাদ্রী লং। লং মনে করেছিলেন, চাষিদের সংগ্রাম দীর্ঘদিন উপেক্ষিত হয়ে রয়েছে এবং নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের কাহিনি ইংরেজ শাসকদের জানা উচিৎ যাতে তারা এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। নীলদর্পণের প্রতি সেই সময়ের বাংলার সেক্রেটারি উইলিয়াম কারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন পাদ্রী লং। উইলিয়াম কার নীলদর্পণের বিষয়ে বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর জেনারেল গ্র্যান্টকে অবগত করলে গ্র্যান্ট নীলদর্পনের ইংরেজী অনুবাদ চেয়ে পাঠান। ১৮৬১ সালে নীলদর্পণ নাটকের ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। সেই সংস্করণে মাইকেল অথবা দীনবন্ধুর বদলে পাদ্রী লংয়ের নাম প্রকাশ করা হয়। নীলদর্পণের সেই সংস্করণের ৫০০ কপি বই ছেপে প্রকাশ করা হয়।
উল্লেখযোগ্য হলো, এই একই সময়ে নীল কমিশন চলছিল। নীলদর্পণ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে নীলকর সাহেব এবং ল্যান্ড ওনার অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা এই ভেবে আঁতকে উঠলেন যে এই নাটকটি বিচারকে প্রভাবিত করতে পারে। তাদের তরফ থেকে বাংলার সরকারের কাছে জানতে চাওয়া হলো যে সরকার নিজেই কেন ইংরেজদের মানহানি করা এই নাটক প্রকাশের অনুমতি দিয়েছে? নীলকর সাহেবদের মুখপাত্র হয়ে উঠলেন ইংলিশম্যান কাগজের স্বত্বাধিকারী উইলিয়াম ব্রেট। কার এবং গ্র্যান্টের পদের কারণে তাদের উপর খাঁড়া ঝুলল না। ব্রেট রেভারেন্ড লংয়ের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করলেন। জেমস লংকে জিজ্ঞাসাবাদ করে নীলদর্পণের সঙ্গে যুক্ত অন্যান্যদের নাম জানতে চাওয়া হলে তিনি জানালেন, নীলদর্পণের পিছনে শুধুমাত্র তারই হাত রয়েছে। দীনবন্ধু মিত্র এবং মাইকেল মধুসূদন দত্ত রক্ষা পেলেও জেমস লংয়ের শাস্তি হলো। আদালতের তরফে তাঁকে এক মাসের কারাদণ্ড এবং এক হাজার টাকা জরিমানার আদেশ দেওয়া হলো। ততদিনে জেমস লং বাংলার বহু মানুষের সহমর্মিতা পেয়েছেন। তাই তাকে শাস্তি দেওয়া হোক তা বাংলার মানুষ চায়নি। ভারতীয় হলে অবশ্য তার শাস্তি অনেকটাই বৃদ্ধি পেত। তাও লংয়ের মুক্তিই চেয়েছিল ভারতীয়রা।
আরও পড়ুন- হাতিবাগানে কার হাতি ছিল, উল্টোডাঙা কেন উল্টো? কলকাতার এইসব অঞ্চলের নাম যেভাবে এসেছে
তবে নীলদর্পণ প্রকাশ, নীলকর সাহেবদের অত্যাচার এবং রেভারেন্ড জেমস লংয়ের শাস্তি ঘোষণার মধ্যে দিয়ে এই ঘটনার সমাপ্তি হলো না। শাস্তি ঘোষণার পরেই এক ছোট অনুচ্ছেদ জুড়ে গেল গল্পের সঙ্গে। নীলদর্পণের সঙ্গে জড়িয়ে গেল আরও এক বাঙালি প্রতিভার নাম। আদালতে রায় ঘোষণার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আদালতে উপস্থিত মানুষদের মধ্যে থেকে এক তরুণ এগিয়ে এসে রেভারেন্ড জেমস লংয়ের জরিমানার এক হাজার টাকা জমা দিয়ে দিলেন। লংয়ের শাস্তি শুনে এগিয়ে এসেছিলেন কালীপ্রসন্ন সিংহ, অন্য ধাতুতে গড়া এক মানুষ। নীলদর্পণের কর্মকাণ্ডে রেখে গেলেন তার অবদান। বলাই বাহুল্য, সেই আমলে হাজার টাকার মূল্য আজকের হিসাবে দেখলে বহু ধনী মানুষও পকেটে হাত ঢুকিয়ে বসে পড়বেন।
কলকাতা শহরের একটি রাস্তা, যার নাম জেমস লং সরণি তার সঙ্গে নীলদর্পণের এই যোগাযোগ হয়তো বহু মানুষেরই অজানা। রাস্তার নাম বদলের ধাক্কায় হয়তো একদিন জেমস লং সরণির নামও বদলে ফেলা হবে। ইতিহাস বিমুখ বাঙালি হয়তো ভুলেও যাবে। তবুও ইতিহাসের হলদে ছোপ ধরা পাতায় থেকে যাবে জেমস লংয়ের নাম।
তথ্য ঋণ : ব্রিটিশ লাইব্রেরি ব্লগ, সেই সময়