হাতিবাগানে কার হাতি ছিল, উল্টোডাঙা কেন উল্টো? কলকাতার এইসব অঞ্চলের নাম যেভাবে এসেছে

Hatibagan Ultodanga: কলকাতার এই পরিচিত জায়গাগুলোর নাম বহু মানুষের জানা থাকলেও সেগুলোর নামের সঙ্গে জড়িত অনেক গল্প আমাদের অজানা।

হাতিবাগানে হাতি কোথায়? লালদিঘির জল তো লাল নয়! উল্টোডাঙাতে উল্টোটা কী? শিয়ালদহে শিয়াল আছে? টালিগঞ্জে কি শুধু টালির চাল দেওয়া বাড়ি ছিল? জায়গার নামগুলো শুনলে সুকুমার রায়ের লেখা কবিতা মনে পড়ে:

হাঁস ছিল সজারু, ব্যাকরণ মানি না।
হয়ে গেল হাঁসজারু, কেমনে তা জানি না।

কলকাতার এই পরিচিত জায়গাগুলোর নাম বহু মানুষের জানা থাকলেও সেগুলোর নামের সঙ্গে জড়িত অনেক গল্প আমাদের অজানা।

উত্তর কলকাতার হাতিবাগানের নাম শুনলেই আমাদের মাথায় আসে নানারকম জিনিসের বিশাল এক বাজার, জিনিসপত্রের দরকষাকষি আর চৈত্র সেল। প্রচুর লোকের ভিড় এবং ব্যস্ততার মধ্যে 'হাতি' আর 'বাগান' দুটো শব্দই হারিয়ে যায়। হাতিবাগানের নাম শুনলে অনেকেই বলবেন, নিশ্চয়ই কারও হাতি ছিল, সেই থেকেই জায়গার নাম হাতিবাগান হয়েছে। একথা ঠিক যে, হাতি থাকত বলেই নামটা হাতিবাগান, কিন্তু কার হাতি?

উত্তরটা বড় বড় করে হাতিবাগানেই লেখা আছে, কিন্তু ব্যস্ততার কারণে সেটা আমাদের চোখে পড়ে না। নবাব সিরাজ-উদ-দৌল্লা যখন কলকাতা আক্রমণ করে ফোর্ট উইলিয়াম ধ্বংস করেন তখন এই এলাকার এক বাগানে তাঁর সঙ্গে আনা যুদ্ধের জন্য ব্যবহৃত হাতিগুলোকে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সেই এলাকাকেই আমরা হাতিবাগান বলে জানি।

আরও পড়ুন: জাহাজে লুকোনো রত্ন পেয়ে ভাগ্য ফিরেছিল গৌরী সেনের! বাংলা প্রবাদগুলিতে লুকিয়ে যে ইতিহাস

সিরাজ-উদ-দৌল্লা কলকাতায় শুধুমাত্র ফোর্ট উইলিয়াম আক্রমণ করেননি। উত্তর কলকাতার পুরনো এলাকা বাগবাজারে নবাবের সৈন্য এবং ইংরেজ বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ হয়। সেই সময়ে বাগবাজারকে অনেকে বারুদখানা বলত, কারণ ইংরেজরা সেখানে একটা কেল্লা এবং বারুদখানা বানিয়েছিল। সিরাজ সেটা ভেঙে ফেলতে নির্দেশ দেন এবং ইংরেজরা সেই নির্দেশ অমান্য করলে সিরাজের সেনাপতি মিরজাফর (যাঁকে আমরা পরে 'বিশ্বাসঘাতক' বলে জেনেছি) প্রচুর সৈন্য নিয়ে এসে কাশীপুরে তাঁবু ফেলেন। জনশ্রুতি আছে যে, এই যুদ্ধের সময় একদল বুনো মোষ আচমকা ইংরেজ সেনাদের আক্রমণ করে।

লালদিঘি অথবা লালবাজারের নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাঙালির এক উৎসব। গোবিন্দপুরের মুকুন্দরাম শেঠ এবং তার ছেলেরা এই দিঘি খনন করিয়েছিলেন। ইংরেজরা বাংলায় আসার আগে থেকেই প্রতি বছর এই দিঘির পারে মঞ্চ করে সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের কাছারিবাড়ির দোল উৎসব পালন করা হতো। দিঘির জলে আবির গুলে রঙের খেলা হতো। সেই আবিরের রঙে লাল হয়ে যাওয়া দিঘি লোকের মুখে মুখে হয়ে গেল লালদিঘি। দোল উপলক্ষ্যে বিক্রির জন্য দিঘির কাছে এক জায়গায় পাহাড়সমান আবির কুমকুম জমিয়ে রাখা হতো। সেই জায়গার নাম হয়ে যায় লালবাজার। দিঘির যেই প্রান্তে রাধারানির মঞ্চ তৈরি করা হতো, সেই এলাকার নাম হলো রাধাবাজার। সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের জমিদারিতে এক পরিচিত নাম ছিল কেশবরাম। তিনি কলকাতার দক্ষিণ চাকলার রাজস্ব আদায় করতেন। সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আদায়ের কারণে তিনি লাভের সব থেকে বড় ভাগ পেতেন। সেই সবথেকে বড় ভাগ বা হিসসা থেকেই এলাকার নাম হয়ে গেল বড়িশা।

উল্টোডাঙা বললে আমরা বুঝি রেলস্টেশন আর সারাদিনের ব্যস্ততা। সবকিছুই সোজা, এমন এক জায়গার নাম উল্টোডাঙা কেন, তা বিভিন্ন জনশ্রুতিতে বিভিন্ন ভাবে পাওয়া যায়। কেউ বলেন, খাল এবং নদীপথে যাতায়াতের জন্য ব্যবহৃত নৌকো এই এলাকায় খালের পাশেই মেরামত করা হতো। সেই নৌকো বা ডিঙি ডাঙায় তুলে উল্টো করে রেখে মেরামত করা হতো বলেই জায়গাটার নাম উল্টোডাঙা। লোকমুখে এটাও শোনা যায় যে, খালের উল্টোদিকের ডাঙা অথবা এলাকা বোঝাতে জায়গাটার নাম উল্টোডাঙা দেওয়া হয়। উল্টোডাঙার মতোই শিয়ালদহ এবং দমদমের নামের সঙ্গেও জড়িয়ে রয়েছে অনেক জনশ্রুতি। লোকমুখে শোনা যায় যে, আজকের শিয়ালদহ এলাকায় এক সময়ে এক হ্রদ আর ঝোপ-জঙ্গল ছিল। হ্রদের পাশে সেই জঙ্গলে থাকা শিয়ালের দল সন্ধ্যা হলেই ডাকাডাকি শুরু করত। শিয়ালের দল এবং হ্রদ থেকে প্রথমে জায়গাটার নাম হয় শিয়ালহ্রদ। কালক্রমে সেই নাম বদলে হয়ে যায় শিয়ালদহ। দমদমের নামের সঙ্গে আবার অস্ত্রের যোগাযোগ রয়েছে। জনশ্রুতি রয়েছে যে, খুব কাছেই প্যারেড গ্রাউন্ড থেকে কামান দাগা হতো। দম করে সেই গোলা দাগার আওয়াজ থেকেই এই এলাকার নাম প্রথমে হয় দমদমা, পরে কালক্রমে দমদম।

আরও পড়ুন- বাগবাজারের পুজোয় ৫০০ টাকা চাঁদা দেন নেতাজি, লাঠিখেলার যে ইতিহাস অনেকেরই অজানা

১৭৭৫-৭৬ সাল নাগাদ মেজর উইলিয়াম টলি যাতায়াতের সুবিধার জন্যে আদি গঙ্গা প্রশস্ত করার কাজ শুরু করিয়েছিলেন। ১৭৭৭ সাল নাগাদ এই কাজ শেষ হয় এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি টলিকে এই জলপথ ব্যবহারকারীদের থেকে যাতায়াতের জন্য শুল্ক আদায় করার অনুমতি দেয়। এই জলপথের পাশে থাকা এক বাজারের নাম সময়ের সঙ্গে সঙ্গে লোকমুখে টালিগঞ্জ বলে পরিচিত হয়।

কলকাতার বহু জায়গা সেই সময় সেখানে বসবাসকারী বেশিরভাগ মানুষের পেশা থেকে নিজেদের নাম পেয়েছে। মূর্তি তৈরি করা কুমোরদের এলাকা কুমারটুলি। জাহাজের মাল বহন করা খালাসিদের এলাকা খালাসিটোলা। কলুদের এলাকা কলুটোলা এবং ধোপাদের এলাকা থেকেই আহিরীটোলা নাম হয়েছে। গঙ্গা স্নান করে ফেরা পুণ্যার্থীদের সঙ্গে থাকা জিনিস লুঠ করার জন্য চোররা যে বাগানে লুকিয়ে থাকত, তার নাম হয়েছে চোরবাগান।

কলকাতার বিভিন্ন এলাকার নাম শুনলে সাধারণ মানুষের মনে কখনও কৌতুহল জাগে আবার কখনও হাসি পায়, কিন্তু তাদের সঙ্গে জড়িত গল্প সবার মনে আজও বিস্ময় জাগায়। কলকাতার এক একটা জায়গা আজ মানুষের ব্যস্ততার মধ্যেও নিজেদের গল্প শোনানোর জন্য অপেক্ষা করে।

More Articles