ক্রিকেট-দুনিয়ায় আজও বিতর্কিত 'মানকরিং' আউট! কোন ইতিহাস রয়েছে আড়ালে
Mankading Debate: আজও কেন এই ধরনের আউট নিয়ে বিতর্ক দানা বাঁধে? মানকরিং পদ্ধতি ব্যবহার না হলে কি কোনও বাড়তি সুবিধা রয়েছে?
২০১৯ সালের আইপিএল প্রতিযোগিতার একটি ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছিল রাজস্থান রয়্যালস এবং কিংস ইলেভেন পাঞ্জাব। ব্যাট করছিলেন সঞ্জু স্যামসন। বল করছিলেন রবিচন্দ্রন অশ্বিন। নন স্ট্রাইকার হিসেবে দাঁড়িয়ে ছিলেন জস বাটলার। রান আপ নিয়ে এসে বল করার আগে বল না-করে নন স্ট্রাইকার এন্ডের বেল ফেলে দিলেন অশ্বিন। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে বাটলার ক্রিজে ফেরার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু পারেননি। খেলোয়াড় থেকে অসংখ্য দর্শক বুঝতে পারলেন, কী হয়েছে। বাটলার এবং স্যামসন কিছুক্ষণ আম্পায়ারদের সঙ্গে আলোচনা করলেন। তারপর বাটলার মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। বাটলার মানকরিং পদ্ধতিতে আউট হয়েছিলেন। খেলা শেষ হওয়ার আগে থেকেই বিতর্কের দানা বাঁধতে শুরু করেছিল। খেলা শেষ হওয়ার পরেই খেলার ফলাফলের থেকে এই আউটের পদ্ধতি নিয়ে বেশি আলোচনা শুরু হলো। মানকরিংয়ের পক্ষে এবং বিপক্ষে বহু মানুষ নিজেদের যুক্তি দিতে শুরু করল।
২০২২ সালে ক্রিকেটের নিয়ামক সংস্থা আইসিসি-র তরফে ক্রিকেটের কিছু নিয়মের পরিবর্তন করা হয়েছে। এই নিয়মগুলোর মধ্যে কয়েকটি আইপিএল, এশিয়া কাপ এবং অন্যান্য প্রতিযোগিতায় পালন করা হলেও সব নিয়ম একসঙ্গে এখনও অবধি আইসিসি-র কোনও প্রতিযোগিতায় পালন করা হয়নি। এছাড়া কিছু নিয়ম প্রথমবার এই বছরের টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট বিশ্বকাপে মেনে চলা হবে। ২০২২ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বের খেলা শুরু হয়ে গিয়েছে এবং সেখানে এই পরিবর্তিত নিয়মের কিছুটা দেখা যাচ্ছে। তার মধ্যে ক্যাচ আউট হওয়ার পরে পরবর্তী ব্যাটারের স্ট্রাইক নেওয়া অন্যতম।
২০২১ সালের শেষ অবধি যদি কোনও ব্যাটার উইকেটরক্ষক অথবা বোলারের হাতে ক্যাচ আউট না হতো এবং যে-কোনও ফিল্ডার ক্যাচ নেওয়ার আগেই যদি স্ট্রাইকার এবং নন স্ট্রাইকার পিচের মধ্যে দৌড়ে দু'জন দু'জনকে পার করে ফেলত, তাহলে পরবর্তী বল ক্রিজে আসা নতুন ব্যাটারকে খেলতে হতো না। যদিও নতুন নিয়মে যে কোনও উপায়ে কোনও ব্যাটার ক্যাচ আউট হলে তার পরিবর্তে ক্রিজে আসা নতুন ব্যাটারকে স্ট্রাইকারের জায়গায় খেলতে হবে। এই কারণেই ভারত-পাকিস্তানের খেলায় শেষ ওভারে হার্দিক পান্ড্যিয়া আউট হওয়ার পরে বিরাট কোহলির পরিবর্তে দীনেশ কার্তিক পরের বল খেলেছিলেন।
আরও পড়ুন: বাবার মৃত্যু থেকে অধিনায়কত্ব বিতর্ক, সব পেরিয়ে যেভাবে প্রত্যাবর্তন বিরাটের
নতুন নিয়মে স্লো ওভার রেটের ক্ষেত্রে ম্যাচ ফি ছাড়া নতুন জরিমানা হবে। যদিও এই নিয়ম এশিয়া কাপের খেলায় দেখা গিয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ওভার শেষ করতে না পারলে ফিল্ডিং টিমকে নির্ধারিত ওভারের পরের খেলা সব ওভারে একজন অতিরিক্ত খেলোয়াড় ৩০ মিটারের মধ্যে রাখতে হবে। যদিও সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নিয়ম পরিবর্তন হলো যে, মানকরিং পদ্ধতিতে আউট রান আউট বলে বিবেচিত হবে। মানকরিং পদ্ধতিতে আউট সম্পর্কে বহু মানুষ অবগত হলেও এই ধরনের আউটের নামের কারণ বহু মানুষ জানেন না। তার থেকেও উল্লেখযোগ্য হলো যে, এই পদ্ধতির আউট প্রথম থেকেই ক্রিকেটের নিয়মের মধ্যে থাকলেও আজও কেন এই ধরনের আউট নিয়ে বিতর্ক দানা বাঁধে? মানকরিং পদ্ধতি ব্যবহার না হলে কি কোনও বাড়তি সুবিধা রয়েছে?
মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাব অনুযায়ী ক্রিকেট বল করার আগে অবধি যতক্ষণ কোনও বোলারের হাতে বল রয়েছে, ততক্ষণ নন স্ট্রাইকার ব্যাটার নিজের ক্রিজ ছেড়ে বেরোতে পারে না। যদি কোনও নন স্ট্রাইকার ব্যাটার বোলারের হাত থেকে বল বেরনোর আগে ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে যান, তাহলে বোলারের তাঁকে আউট করার অধিকার রয়েছে। ব্যাটারের এই ধরঞের আচরণকে এই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে পর্যন্ত ক্রিকেট খেলার নিয়মের ৪১.১৬ অনুযায়ী অন্যায় ব্যবহার হিসেবে গণ্য করা হতো।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মানকরিংয়ের প্রথম ঘটনা ঘটে ১৯৪৭ সালে। সিডনিতে ভারত এবং অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে একটি টেস্ট ম্যাচ খেলা হচ্ছিল। সেই ম্যাচে ভারতীয় ক্রিকেটার ভিনু মানকর অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটার বিল ব্রাউনকে এই পদ্ধতিতে আউট করেছিলেন। ম্যাচ চলাকালীন এবং ম্যাচের পরে এই ঘটনার সমালোচনা হয়। অস্ট্রেলিয়া এবং অন্যান্য দেশের খবরের কাগজে মানকরিং পদ্ধতিতে আউটকে ক্রিকেটের স্পোর্টসম্যানশিপের বিরুদ্ধে বলে অভিযোগ করা হয়। সেই ঘটনার কারণেই ভিনু মানকরের নাম এই আউটের সঙ্গে জুড়ে যায়। মজার কথা হলো এই যে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথমবার দেখা গেলেও ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে এই ঘটনার আগেও মানকরিং পদ্ধতিতে আউটের প্রমাণ রয়েছে। ইতিহাসে প্রথমবার ইংল্যান্ডের কাউন্টি ক্রিকেটে ১৮৩৫ সালে থমাস বেকার এই পদ্ধতিতে জর্জ বেজেনকে আউট করেছিলেন। এই ঘটনার পরে, ১৯৪৭ সালের মধ্যে এক ডজনের বেশি বার এই পদ্ধতিতে বিভিন্ন ব্যাটারকে বিভিন্ন বোলার আউট করেন। এই ক্রিকেটারদের মধ্যে শুধু ইংরেজ এবং ভারতীয় নয়, অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটাররাও ছিলেন। যদিও এই সমস্ত ক্রিকেটারদের কারও নাম এই পদ্ধতির আউটের সঙ্গে ভিনু মানকরের মতো জুড়ে যায়নি। ভিনু মানকরের আউট করার পদ্ধতিকে স্বয়ং ডন ব্র্যাডম্যান সমর্থন করেছিলেন। সুনীল গাভাসকর এই ধরনের আউটকে 'ব্রাউনড' বলেছিলেন, কিন্তু ততদিনে মানকরিং নাম মানুষের মনে ছেপে গিয়েছে।
মানকরিং-সংক্রান্ত বিতর্ক আজও চলে আসছে। বর্তমানে ক্রিকেটকে বোলারদের থেকে ব্যাটারের খেলা বেশি বলা হচ্ছে। সেই খেলায় শুধু নৈতিকতার খাতিরে নিয়ম ভেঙে বোলারের আরও অসুবিধে সৃষ্টি করার কারণ মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাব খুঁজে পায়নি। যেখানে কয়েক মিলি সেকেন্ডের ব্যবধানে রান আউট নির্ধারিত হচ্ছে, সেখানে একজন ব্যাটার-বোলারের হাত থেকে বল বেরনোর আগে কিছুটা এগিয়ে থাকলে তাতে যে আদতে ব্যাটারের কিছুটা অনৈতিক সুবিধে হচ্ছে, সেকথা বলে বোঝাতে হয় না। মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাব সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে এই বিশ্বকাপ থেকে মানকরিংকে ৪১.১৬ অর্থাৎ অন্যায় আচরণের বদলে রান আউটের তালিকায় নিয়ে আসা হবে। সম্ভবত এই বিশ্বকাপের সঙ্গে মানকরিং-সংক্রান্ত যাবতীয় বিতর্ক বন্ধ হতে চলেছে।