বাবার মৃত্যু থেকে অধিনায়কত্ব বিতর্ক, সব পেরিয়ে যেভাবে প্রত্যাবর্তন বিরাটের

Virat Kohli: ২০১২ সালে জঘন্য একটা আইপিএল মরশুম কাটার পর বোধোদয় ঘটে কোহলির। বুঝতে পারেন, এবারে অধঃপতনের দিকে যাত্রা শুরু করেছেন তিনি।

এ যেন সম্পূর্ণ পরাবাস্তব একটা জগত। তখন বিরাট কোহলির চোখ যেন জ্বলজ্বল করছে সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে- যেখানে তাঁকে সবথেকে বেশি মানায়। ম্যাচের সেরার শিরোপা নেওয়া তাঁর কাছে নতুন কিছু নয়। তবে, রবিবার যেন তিনিও আবেগে ভাসলেন ১৪০ কোটি ভারতীয় সমর্থকদের সঙ্গে। কিছু একটা বলতে গিয়ে বারবার থেমে গেলেন। নিজেকে সামলে নিয়ে এরপর বললেন, “এটা পরাবাস্তব এক পরিবেশ। আমি জানিনা এ কীভাবে ঘটেছে, আমি আমার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি।”

তবে শুধু বিরাট নয়, গতকালের বিরাট কোহলির সেই ইনিংস দেখে পৃথিবীর প্রতি প্রান্তের প্রতিটি ক্রিকেট ভক্তই ভাষা হারিয়েছেন বলা চলে। প্রশ্ন হল, এশিয়া কাপে আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে সেই প্রয়োজনহীন সেঞ্চুরিই কি বদলে দিল বিরাট কোহলিকে? এর আগে একটা সময় পর্যন্ত তাঁকে দল থেকে বাদ দেওয়ার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল ভারতীয় ম্যানেজমেন্ট। সেই জায়গা থেকে ঘুরে দাঁড়ালেন বিরাট। সেঞ্চুরি করে জানালেন, তিনি এখনও ফুরিয়ে যাননি। ‘বিরাট ইজ নট ফিনিশড ইয়েট’।

তারপরেও যদিও বিরাট কোহলির সমালোচকের অভাব ছিল না। নানা প্রান্ত থেকে ভেসে আসছিল কটাক্ষ। ‌ তুলনামূলক সহজ প্রতিপক্ষের সঙ্গে সেঞ্চুরির আবার গৌরব কী! এই সমস্ত মন্তব্য ঘুরছিল বিরাট কোহলির আশেপাশে। হ্যাঁ, বিরাট সেই হারানো গৌরবেরই সন্ধান করছিলেন বিশ্বকাপের আগে। এশিয়া কাপ আকারে ছোট হলেও, বিরাটের পক্ষে এটাই ছিল ঘুরে দাঁড়ানোর আসর। একটু একটু করে যেন হারানো দিনের ধারা ধীরে ধীরে ফিরে পাচ্ছিলেন কিছুটা। দরকার ছিল শুধু একটা বড় মঞ্চের। সেই মঞ্চের নাম বিশ্বকাপ, ছোট ফরম্যাটের সব থেকে বড় আসর। আর সামনে প্রতিপক্ষ চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তান।

ম্যাচ শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত হয়তো কেউ ভাবতেই পারেননি, এই প্রতিদ্বন্দ্বীতার আগুনেই রবিবার পাখি হয়ে উঠবেন বিরাট, বুকে কোনও ভয়ডর না রেখেই। ভারত পাকিস্তান ম্যাচে অতিমানবীয় স্মৃতি নতুন কিছু নয়। এর আগেও বহু ব্যাটসম্যান এরকম অসাধ্যসাধন করেছেন। মিরপুরে শাহিদ আফ্রিদি ঝড় তুলেছেন, শাহজাহর ময়দানে শেষ বলে ছয় মেরে ম্যাচ জিতিয়েছেন জাভেদ মিয়াঁদাদ। সেরকমই এক বীরত্বের খাতায় এবার হার্দিক পাণ্ডিয়াকে নিয়ে নিজের নাম লেখালেন বিরাট কোহলি। ভারতের এই দুই ব্যাটসম্যানের ১১৩ রানের জুটি যেকোনও উইকেটে টি-টোয়েন্টিতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের সেরা জুটি এখনও পর্যন্ত।

আরও পড়ুন- একেই বলে বিরাট উত্থান! কোণঠাসা বিজ্ঞাপনের ‘মহারাজা’?

আর এই ইনিংসে মূল সঞ্চালকের ভূমিকা পালন করলেন বিরাট কোহলি। ৫২ বলে করলেন ৮২ রান। নিছক পরিসংখ্যান দিয়ে এই ইনিংসকে বোঝানো যাবে না। ঠিক বিরাট কোহলিসুলভ ইনিংস এটা ছিল না। যখন শুরু করেছিলেন, সেই সময় একের পর এক পড়ছে উইকেট। কে এল রাহুল, রোহিত শর্মা, সূর্যকুমার যাদব এবং অক্ষর প্যাটেলকে হারিয়ে সেই সময় ভারত দাঁড়িয়ে রয়েছে মাত্র ৩৫ রানে। হারিয়ে ফেলেছে চারটি উইকেট। ২২ গজে দাঁড়িয়ে বিরাট কোহলি এবং হার্দিক পাণ্ডিয়া।

শুরুটা করেছিলেন বেশ ধীরে-সুস্থে। দেখে, শুনে। একদিকে যেমন রান রেট বাড়ছিল, তেমনই চাপ বাড়াচ্ছিল পাকিস্তানের বোলিং। মেলবোর্নের বুকে তখন ভারত নয় বরং পাকিস্তানের পতাকাই উড়ছিল। কিন্তু ক্রিকেট বিধাতা যেন একেবারে অন্যভাবে ভেবে রেখেছিলেন এই ম্যাচের ভবিষ্যৎ। কে ভেবেছিল, এমন একটা হাই ভোল্টেজ ম্যাচের নায়ক হয়ে উঠবেন সেই বিরাট কোহলি! ১১ তম ওভার শেষ হবার পরেও বিরাটের ব্যাটে রান ২৩ বলে মাত্র ১৫। ভারতীয়রা তখন জেতার আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন। ম্যাচ প্রেডিকশনেও তখন ৮৫ শতাংশ মানুষ পাকিস্তানের পক্ষে। হার্দিক ছিলেন, বলের মাঝে বারবার বিরাটকে বলছিলেন, “আমরা পারব, শুধু খেলতে হবে শেষ পর্যন্ত।”

হার্দিকের সেই কথাগুলোই যেন একেবারে মিলে গেল অক্ষরে অক্ষরে। পারলেন বিরাট, পারল ভারত। খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকার পরেও পাকিস্তানের মুখ থেকে জয় ছিনিয়ে এনেছে ভারতীয় দল। শেষ তিন ওভারে রান হয়েছে ৪৮, যা এখনও পর্যন্ত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ইতিহাসে রেকর্ড। আর এই রেকর্ডের কারিগর আর কেউ নন, স্বয়ং বিরাট কোহলি। অথচ, যে ক্রিকেটার পুরো একটা প্রজন্মকে উইলো কাঠের মায়াবী ছোঁয়ায় মাতিয়ে রাখলেন, তাঁর বেড়ে ওঠা ছিল আট দশটা সাধারণ মধ্যবিত্ত কিশোরের মতোই। জীবনে বহু ঝড় ঝাপটা এসেছে, যা সামলে তিনি হয়েছেন আজকের মহীরুহু। দিল্লির সেই ছোট গলির ক্রিকেটার থেকে আজকের বিশ্বসেরা হওয়ার যাত্রা ছিল কণ্টকাকীর্ণ।

মাত্র ১২ বছর বয়সে বিরাট কোহলি একবার স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে স্কুটারে চেপে বাবার সঙ্গে যাচ্ছিলেন ঘুড়ি কিনতে। যাওয়ার রাস্তাতেই তাঁর বাবা খেয়াল করেন, ছেলেকে হেলমেট দিতে ভুলে গেছেন তিনি। কিন্তু ততক্ষণে আর ফিরে যাওয়ার সময় নেই, অনেকটাই এগিয়ে এসেছেন বাড়ি থেকে। সিনিয়র কোহলি তাই ভাগ্যে যা আছে ভেবেই যাত্রা পথের দিকে এগিয়ে গেলেন। ঘুড়ি কেনা হলো ঠিকঠাক ভাবেই। তবে বিপত্তি হল ফেরার সময়। প্রথম থেকেই বিরাট কোহলির প্রিয় ফল ছিল তরমুজ। তাই দু’জনে তরমুজ কিনতে একটা দোকানের সামনে দাঁড়ালেন। সেখানে হঠাৎ পুলিশ দেখে তাড়াহুড়ো করে স্কুটারে চেপে বসলেন বিরাটের বাবা। কিন্তু কিছুদূর যাওয়ার পর বুঝতে পারলেন মারাত্মক ভুল হয়ে গেছে, ছেলেকে ফেলে রেখেই চলে এসেছেন তিনি। পরে ফেরত এলেও ততক্ষণে বিরাট কোহলি নিজেই বাড়ি চলে এসেছেন। এই ঘটনার পরে দু’দিন পর্যন্ত তিনি বাবার সঙ্গে কথা বলেননি।

বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যানদের একজন হলেও কোহলি কখনই তাঁর শিকড়কে ভুলে যাননি। ভুলে যাননি কোথা থেকে উঠে এসেছেন তিনি। তাঁর বড় ভাইয়ের ব্যবসার অর্থ জোগাতে, তাঁরা নিজেদের বাড়ি ভাড়া দিয়ে অন্য বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। যদিও তাঁর বড় ভাইয়ের ব্যবসা সাফল্যের মুখ কখনই দেখেনি। ততদিনে অবশ্য কোহলিও দিল্লির ক্রিকেট পাড়ায় খুব একটা পরিচিত নন, চেষ্টা করছেন পায়ের নিচে শক্ত জমি পাওয়ার।

তবে সেদিন ছেলেকে ভুলে রেখে চলে এলেও, বিরাট কোহলির জীবনের অনুকরণীয় আদর্শ ছিলেন তাঁর বাবা। তিনি কারও সাহায্য ছাড়া একা একাই জীবন সংগ্রামে এগিয়েছিলেন। স্ট্রোক এবং করোনারি হার্ট অ্যাটাকে যখন তাঁর বাবা মারা যান, বিরাট কোহলি একেবারে ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়েছিলেন। তবে অসম্ভব মানসিক দৃঢ়তা তাঁর বাবার কাছ থেকেই শিখেছিলেন। তাই হয়তো বাবার মৃত্যু সংবাদ জেনেও ক্রিকেট ব্যাট হাতে নেমেছিলেন মাঠে। খেলেছিলেন দুর্দান্ত এক ইনিংস।

আরও পড়ুন- বড় ক্রিকেটারে নয়, বিরাট ব্র্যান্ডে মোহিত নিউ ইন্ডিয়ার জনগণমন

কোহলি বলেছিলেন, “আমি সেই সময় কাঁদতে পারছিলাম না, পুরোটা কেমন যেন শূন্য হয়ে গিয়েছিল। এক পর্যায়ে বুঝলাম বেদনার বুদবুদ ধীরে ধীরে আমার ভেতরে দানা বাঁধছে। যখন সবাই আমার দিকে এগিয়ে এল, আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি।”

বাবার মৃত্যু কোহলির জীবনকে পুরোপুরি ঘুরিয়ে দিয়েছিল। ‌পুরনো দিনের স্মৃতিচারণ করে কোহলি একবার বলেছিলেন, “বাবা ২০০৬ সালের দিকে অনলাইনে শেয়ার মার্কেটের ব্যবসা করতেন। হঠাৎ একদিন তাঁর অ্যাকাউন্ট ক্র্যাশ করে যায় এবং লেনদেন বন্ধ হয়ে যায়। তাঁর আগে তিনি যত লেনদেন করেছিলেন এবং টাকা জমা করেছিলেন সব চলে যায় এক লহমায়। এটা মানসিকভাবে তাঁর ওপর বিশাল প্রভাব ফেলে এবং যার ফলে তাঁর স্ট্রোক হয়।”

সেদিনের খেলা শেষ করে কোহলি যখন তাঁর বাবার মৃতদেহ দাহ করতে শ্মশানে যান, সেখানে উপস্থিত ছিলেন তাঁর পরিবারের আত্মীয়-স্বজন এবং শুভাকাঙ্ক্ষী সকলেই। সেখানেই কোহলি তাঁর ভাইকে বলেন, খেলাধুলা এবং স্বপ্নের মাঝে যেন কেউ বাধা হয়ে না দাঁড়ায়। কোহলি বলেন, “আমার জীবনে এর থেকে বড় ইম্প্যাক্টফুল ঘটনা আজ অব্দি ঘটেনি। আমার মনে পড়ে গেল, খেলা শেষ করে যখন আমি শ্মশানে আসি, সৎকার এবং ধর্মীয় কাজ সম্পন্ন করতে, আমি ভাইকে বলি আমি ভারতের হয়ে ক্রিকেট খেলতে যাচ্ছি এবং আমার এই স্বপ্ন পূরণ থেকে আমাকে কেউ আটকাতে পারবেনা। ‌ এটা আমার বাবারও স্বপ্ন ছিল।”

সেদিন থেকেই হয়তো বিরাট কোহলি পণ করে নিয়েছিলেন, তিনি হয়ে উঠবেন ভারতের সেরা ব্যাটসম্যান। এরপর থেকেই যেন পুরো পাল্টে গিয়েছিল বিরাট কোহলির ব্যাটিং। একের পর এক ম্যাচে সেঞ্চুরি, ২০১১ বিশ্বকাপে দারুণ কয়েকটা ইনিংস খেলে ভারতীয় যুব সমাজের আইকন হয়ে উঠেছিলেন বিরাট। তবে খাদ্যাভ্যাসে অনিয়ম, পার্টিতে মজে যাওয়া এবং সমাজের উচ্চ শ্রেণির মানুষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে বিরাট বুঝতে পারলেন, ধীরে ধীরে তিনি সরে যাচ্ছেন নিজের স্বপ্ন পূরণের পথ থেকে। ২০১২ সালে জঘন্য একটা আইপিএল মরশুম কাটার পর বোধোদয় ঘটে কোহলির। বুঝতে পারেন, এবারে অধঃপতনের দিকে যাত্রা শুরু করেছেন তিনি। সেই দিন থেকেই আবারও নিজেকে পরিবর্তন করেন বিরাট। খাবারে পরিবর্তন আনেন, বাড়িয়ে দেন নেটে পরিশ্রম।

সচিন তেন্ডুলকারের প্রসঙ্গ আসলেই যেন খুদে ভক্ত হয়ে উঠেন বিরাট। ক্রিকেট থেকে অবসর নেওয়ার সময় সচিনকে এক বিশেষ উপহার দিয়েছিলেন কোহলি। তিনি বলেছিলেন, “আমার জীবনে সচিন কেমন প্রভাব ফেলেছিলেন সেটা বোঝানোর জন্য আমার জীবনের সবথেকে মূল্যবান জিনিস আমি তাঁকে উপহার দিয়েছিলাম। এটা ছিল একটা সুতো, যেটা আমার বাবা আমাকে দিয়েছিলেন সব সময় সঙ্গে রাখতে। আমি সব সময় সুতোটা আমার ব্যাগে রাখতাম। আমার বিশ্বাস এর থেকে দামি কিছু আমি কখনই তাঁকে দিতে পারতাম না।”

সেদিনের সেই খুদে ভক্তই আজ হয়ে উঠেছেন মহীরুহ। অধিনায়কত্ব থেকে বাদ পড়া, ২০১৯ থেকে টানা খারাপ ফর্ম, সবকিছুই এসেছে বিরাট কোহলির জীবনে। ফি-ম্যাচে সেঞ্চুরি করা বিরাট কোহলিও টানা তিন বছর বসে থেকেছেন একটা সেঞ্চুরির জন্য। সমালোচনা হয়েছে প্রচুর। রয়েল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোরের লাগাতার খারাপ পারফরম্যান্সের জন্যও কম কথা শুনতে হয়নি তাঁকে। তবে সবকিছুকে পেরিয়ে এসে আবারও শীর্ষে বিরাট কোহলি।

ভারত পাকিস্তান ম্যাচে ভারতের জয়ের পুরোটাই সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র কোহলির কারণে। ‌এই ইনিংসের রানের জায়গায় ১০০ না লেখা থাকলেও, সেঞ্চুরি থেকে অনেক বেশি দামি এই ইনিংস। টি-টোয়েন্টিতে বিরাটের হয়তো এটাই সেরা ইনিংস। হয়তো বিরাট নিজেও মোহালির সেই ৮২ রানের থেকে এগিয়ে রাখলেন মেলবোর্নের ৮২-কে। যত পুরনো হচ্ছেন, ততই যেন তিনি নেশা বাড়িয়ে চলেছেন ভারতবাসীর।

উত্থান, পতন, নাটক, অতিনাটকীয়তা- সবকিছুই ছিল ভারত পাকিস্তানের এই মহারণে। আর সেই মহারণে শেষ হাসি তিনিই হাসলেন, যাকে এই কাজে সব থেকে বেশি মানায়। তিনি নিজে যতই মুখে বলুন না কেন, “আই হ্যাভ লস্ট মাই ওয়ার্ডস!” আসলে তিনি নন, ভাষা হারিয়েছে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা বিরাট-সমালোচকরা।

More Articles