খেলার মাঠে কারও খোকা আর না হারায় দেখো

Mohun Bagan East Bengal 1980 Match : ১৯৮০। ১৬ অগাস্ট। ইডেন উদ্যানে সে দিন ডি-ব্লকে অতিরিক্ত দর্শক ভিড় করেন।

রেডিয়োয় কণ্ঠস্বর শোনা যায়। 'ইডেন উদ্যানে আয়োজিত, ইস্টবেঙ্গল ক্লাব বনাম মোহনবাগান অ্যাথলেটিক ক্লাবের প্রদর্শনী ফুটবল খেলার ধারাবিবরণী, রিলে করে শোনানো হচ্ছে। ধারাবিবরণী দিচ্ছেন'...

সমর্থকদের তুমুল উল্লাস। হর্ষধ্বনি।

'নমস্কার। ক্রিকেটের নন্দনকানন ইডেন উদ্যান থেকে কথা বলছি পুষ্পেন সরকার। আজ কলকাতা প্রথম ডিভিশন ফুটবল লিগের গুরুত্বর্পূণ খেলার ধারাবিবরণী দিতে আমরা এখানে এসেছি। আমার সঙ্গে আছেন আপনাদের পরিচিত ভাষ্যকার সুকুমার সমাজপতি। তিনিও শোনাবেন আজ এই গুরুত্বপূর্ণ খেলার ধারাবিবরণ। দু'দলের খেলোয়াড়রা ইতিমধ্যেই মাঠে নেমে পড়েছেন। আজকের খেলার মাঠ বা প্রাকৃতিক পরিবেশ সম্পর্কে আমরা পরে আসব। তার আগে আজকের খেলায় যাঁরা অংশ নিচ্ছেন তাঁদের নাম জানিয়ে রাখি। ইস্টবেঙ্গল দলে খেলছেন গোলরক্ষক তরুণ বোস। রাইট ব্যাক সুধীর কর্মকার'...

দক্ষিণ ২৪ পরগনার এক অজ পাড়া-গাঁ। তখনও বিদ্যুৎ পৌঁছয়নি। বিনোদন বলতে হাটবারের লায়লা-মজনুর পুতুলনাচ। আর রেডিয়ো। কী এক আশ্চর্য যন্ত্র যা দিয়ে মানুষের কথা শোনা যায়। চোখের সামনে দেখতে পাওয়া যায় ময়দানের খেলা। গৌতম সরকারের পায়ে বল। খেলা শুরু হচ্ছে। বাইরের জানলায় এক অলস দুপুর। এক কিশোরের বুক ভর্তি উৎকণ্ঠা, উত্তেজনায় হাতের তালু ঘামছে। কে জিতবে আজ?

'আজকে মাঠের অবস্থা খুব একটা আশাপ্রদ নয়। একটু আগে পর্যন্ত বৃষ্টি হয়েছে। ঘাসের নীচে জল জমে রয়েছে।' ধারাভাষ্যকার বলছেন। তার মানে কলকাতার দিকে আজ বৃষ্টি হয়েছে। বাবা-মা, ভাই-বোনেরা সবাই তো ওখানে। সেই পুজোর ছুটিতে দেখা হবে। রেডিয়োর ধারাবিবরণী, দুপুরে বাঁশঝাড়ে লুকিয়ে থাকা কুবোর একঘেয়ে ডাকে কিশোরের মন খারাপ হয়ে যায়। হুঁশ ফেরে খেলা শুরুর হুইশলে।

আরও পড়ুন- হলুদ বা লাল নয়, ইতিহাসে প্রথমবার সাদা কার্ড দেখল ফুটবল! যে ঘটনা শোরগোল ফেলে দিল বিশ্বে

'খেলা শুরু হয়ে গেল। মোহনবাগান কিক্-অফ করেছে। প্রসূনের পায়ে বল। প্রসূনের পায়ে বল। বল চলে এসেছে ইস্টবেঙ্গলের গোলের সামনে। উলগানাথন গোলের সামনে। এবং গোওওওওল।' রেডিয়োয় প্রচণ্ড কোলাহল। সমর্থকদের উল্লাস। সেই উল্লাস ছাপিয়ে ধারাভাষ্যকার বলছেন, 'গোল করেছে প্রথম মিনিটেই। আমার মনে হচ্ছে আকবর। আকবর হেড করেছেন। প্রসূনের থেকে বল পেয়ে উলগা সঙ্গে সঙ্গে বলটা সেন্টার করেছিলেন। কিছুটা ইন-সুইংয়ের মতো। অরক্ষিত ছিলেন আকবর। আকবর কিছুটা দৌড়ে এসেছে পেনাল্টি বক্সের ভিতর ঢুকে পড়ে হেড করেছেন। তরুণের করবার কিছু ছিল না। ফলে গোল।' মন খারাপ হয়ে যায়। কিশোর ভাবে কে জিতবে আজ? মোহনবাগান না ইস্টবেঙ্গেল? সে কোন দলের সাপোর্টার?

ক্লাস ফাইভের সাধারণ জ্ঞানের পরীক্ষায় প্রশ্ন এল। নীচের কোন নামটা পেলের? কিশোরের মুখস্থ। সে তো পেলের ফ্যান। পেলে। কলকাতায় এসে মোহনবাগানের সঙ্গে খেলেছে। সাপোর্টাররা গান বেঁধেছেন। 'মা গো ভাবনা কেন, বলের রাজা কলকাতাতে আসছে পেলে, তোমার ভয় নেই মা আমরাও ফুটবল খেলতে জানি।' শিবাজী ব্যানার্জি বলে একজন গোলকিপার আছেন। তিনি পেলের ফ্রি-কিক সেভ করে দিয়েছেন। কিশোর সেদিন থেকে শিবাজীর ফ্যান। কিশোর গৌতম সরকারের ফ্যান। রোভার্সের রয়ের ফ্যান।

দাউ দাউ করে জ্বলছে মশাল। স্মৃতির ভিতর আবছা সাঁতার কাটছে সেই আগুন। হাতে হাতে মশাল নিয়ে দৌড়চ্ছে মানুষ। চিৎকার করেছে। উল্লাস করছে। আর এক দল মনখারাপ করে দাঁড়িয়ে আছে। যাঁদের মনখারাপ তাঁদের মধ্যে কিশোরের এক পাড়াতুতো দাদা। বলল তুই কোন দিকে যাবি? ওদের দিকে? না আমাদের? কী মনে করে কিশোর থেকে গেল মনখারাপের দিকে। কিছু না বুঝেই।

সোনালি শিবির ক্লাবের কাছে উদ্বাস্তুদের বসতি। তোলা উনুনের সংসার। খুপরি-ঘরে এক গাদা ভাইবোন। ঘরে ঘরে অভাব। বেঙ্গল কেমিক্যালের সামান্য চাকরি। আর বুকের ভিতর বাঙালের জেদ। একরোখা মনোভাব। পুরনো সাদা-কালো অ্যালবামে সেই কলোনির ছবি। পিছনে ট্রেনলাইন। মালগাড়ির যাচ্ছে। ধোঁয়া উঠছে। আর ফ্রেমের সামনে এক কিশোরী দুই বিনুনি মাথায়। বড় বড় টানা চোখ। কিশোরের মা। মায়ের কিশোরীবেলা।

কিশোর তবে কোন দিকে যাবে। মোহনবাগান নাকি ইস্টবেঙ্গল?

রেডিয়োয় ধারাবিবরণী শোনা সেই কিশোর একদিন শহরে এসে পড়ে। ট্রামলাইনের বিদ্যুচ্চমক। কুষ্ঠরোগীর ঝুমঝমি। হাসপাতাল বারান্দায় উদ্বিগ্ন মানুষের ভিড়। মৃতদেহের জন্য ফুল দিয়ে সাজানো খাট। মানছি না, মানব না, মিছিল। শহিদ মিনারে মাদারির খেল। এসব দেখে সে একটু একটু যেন বড় হয়ে ওঠে। হয়ে ওঠে ইস্টবেঙ্গল। খুনের রং লাল-হলুদ।

মাচা, লোটা। তখনও ময়দানে এসব শব্দের খই ফোটেনি। যেটা ছিল, তা হলো দলবদল নিয়ে একটা প্রবল মস্তানি। মারামারি। বন্দুকবাজি। এমনকী অপহরণ। ক্লাবের পোষা গুন্ডারা নামী খেলোয়াড়কে তুলে নিয়ে গিয়ে গোপন ডেরায় বন্দি করে রাখত। সইয়ের দিন তাঁকে দেখা যেত। ময়দানে এরকম চালু গল্প আছে সুরজিৎ সেনগুপ্তকে নিয়ে। ইস্টবেঙ্গলে যাওয়া আটকাতে একবার নাকি এক মোহনবাগান কর্তা অপহরণ তাঁকে লুকিয়ে রাখেন ডায়মন্ড হারবারের বাগানবাড়িতে। নিখোঁজ সুরজিতের নামে থানায় ডায়েরি করা হয়।

দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর খেলায় সংঘাত। তার অভিঘাত। শুধু ময়দানের গ্যালারি নয়। গ্যালারি থেকে তাঁবু পার করে, শ্যামবাজারের মোহনবাগান লেন ছাড়িয়ে, লাল-রোয়াকের তর্ক উজিয়ে, কখনও ঢুকে পড়েছে বৈঠকখানা ঘরে। এমনকী শোয়ার ঘরের বিছানা পর্যন্ত। অনেক সুস্থ-স্বাভাবিক সম্পর্কের মধ্যে কাঁটা হয়ে ঢুকে পড়েছে বাঙাল এবং ঘটি সংস্কৃতির বাছ-বিচার। মাঠের ফাউল এক রকম। তার শাস্তি আছে। কিন্তু মাঠের বাইরের ফাউল। কড়া ট্যাকল। তা দেখার রেফারি কে?

কিশোরের মামার বাড়িতে একটা গান বাজে। মান্না দে'র। 'খেলা ফুটবল খেলা, খোকা গেল দেখতে সেই সকালবেলা।' একদিন খেলার শেষে কিশোর দেখে, ঠাকুরের সামনে নিবিষ্ট মনে ধ্যানরত ঠাকুরমা। তাঁর ছেলে সেদিন মাঠে গিয়েছে খেলা দেখতে। খেলা শেষে গোলমালের খবর আসছে। অনেক নাকি মারা গিয়েছেন।

আরও পড়ুন- উড়ন্ত গোল করতে করতেই মারাত্মক সংঘর্ষ, বাইসাইকেল কিক কেড়েছিল ফুটবলারের প্রাণ

১৯৮০। ১৬ অগাস্ট। ইডেন উদ্যানে সে দিন ডি-ব্লকে অতিরিক্ত দর্শক ভিড় করেন। ম্যাচ পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন রেফারি সুধীন চট্টোপাধ্যায়। ৭০ হাজার দর্শকের তুমুল উন্মাদনা। হিস্টিরিয়া। ১১ মিনিটের মাথায় ইস্টবেঙ্গলের রাইট ব্যাক দিলীপ পালিত মোহনবাগানের লেফট আউট বিদেশ বসুকে জঘন্য ট্যাকল করেন। রেফারি কার্ড দেখাতে পারতেন। কিন্তু দেখাননি। ৫৭ মিনিটে এ'বার ফাউল করেন বিদেশ বসু। রেফারি লাল কার্ড দেখিয়ে মাঠ থেকে বার করে দেন। জিনিসটাকে ব্যালান্স করতে গিয়ে লাল কার্ড দেখান দিলীপ পালিতকেও। খেলার শেষে আগুনে ঘি পড়ে। সংঘর্ষ ছড়ায় গ্যালারিতে। কলকাতা পুলিসের ব্যর্থতায় সেই গোলমাল দাবানলের আকার নেয়। গ্যালারির উপর থেকে ঝাঁপিয়ে পালাতে গিয়ে মারা যান অনেকে। অনেকে সরু একমাত্র খোলা গেট দিয়ে পালাতে গিয়ে হাজার মানুষের ভিড়ের চাপে পদপিষ্ট হয়ে মারা যান।

অভিনেতা সত্য বন্দ্যোপাধ্যায় এই মর্মান্তিক ঘটনা নিয়ে কবিতা লেখেন। 'খেলা ফুটবল খেলা। খোকা গেল দেখতে সেই সকালবেলা।' সুপর্ণকান্তি ঘোষ সেই কবিতায় সুর বসান। কণ্ঠ দেন মান্না দে। কিশোরের মামার বাড়িতে রেকর্ড প্লেয়ারে বাজে। 'খোকা খোকা খোকা, অন্ধকারে যায় না কিছুই দেখা।' ঠাকুরের সামনে ধ্যানমগ্ন কিশোরের ঠাকুরমা। ছেলে বাড়ি ফেরেনি। গানের ভিতর খোকাকে খুঁজতে খুঁজতে রাত বারোটায় ফাঁকা এক মাঠে গিয়ে দাঁড়ান বাবা। ছেঁড়া জুতো, ছেঁড়া জামা কুড়িয়ে কুড়িয়ে আকুল হয়ে খুঁজে চলেন তাঁর সন্তানকে।

'পরের দিন ভোরের বেলা খেলার মাঠে গেল দেখা
গোলপোস্টের কাছে কী যেন এক লেখা
কাছে গিয়ে আঁতকে উঠে কেঁপে উঠল বুক
দুটো টিমের জার্সির ফাঁসে খোকার বাবার মুখ

বুকের কাছে সাদা কাগজে রক্ত দিয়ে লেখা
তোমরা আমার একটা কথাই রেখ
খেলার মাঠে কারও খোকা আর না হারায় দেখ...'

পরে সিপিএম সরকার এই গান নিষিদ্ধ করে দেয়। সে আর এক কাহিনি।

More Articles